×

সরকার

প্রণোদনা বাস্তবায়নে ধোঁয়াশা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২০, ১০:১৮ এএম

বাংলাদেশ ব্যাংকের অধিকাংশ নীতিমালা কঠিন যোগ্যতা নির্ধারণের শর্তে জটিলতা মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সুদ মওকুফের দাবি

করোনা ভাইরাসের কারণে দেশের অর্থনৈতিক স্থবিরতা কাটাতে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় প্রণোদনা প্যাকেজ। তবে প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব নীতিমালা জারি করেছে তার অধিকাংশই জটিল। সহজ শর্তের বিপরীতে কঠিন সব শর্তজুড়ে দেয়া হয়েছে ঋণ নীতিমালায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণপ্রাপ্তির যোগ্যতা নির্ধারণে জটিল শর্তগুলোর কারণে বাস্তবায়ন নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।

জানা গেছে, সরকার ঘোষিত প্রণোদনার মধ্যে শিল্পঋণ খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা, বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা, কৃষি খাতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা, প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রেফারেন্স স্কিম নামে পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা ও রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেতনভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকা রয়েছে। এছাড়া নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য নগদ সহায়তা ৭৬১ কোটি টাকাসহ ২১ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়।

করোনা ভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে চলতি মূলধন বাবদ ঋণ-বিনিয়োগ সুবিধা দিতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের উপকারভোগীদের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নীতিমালা জারি করেছে। তাতে ঋণ প্রাপ্তির যোগ্যতা নির্ধারণে জটিল সব শর্তজুড়ে দেয়া হয়েছে। প্রণোদনা তহবিল থেকে বর্তমান ঋণ খেলাপিরা, অতীতে তিনবার ঋণ পুনঃতফসিল করা প্রতিষ্ঠান কেন ঋণ পাবে না এবং ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের চিহ্নিত করার বিষয়েও সুনির্দিষ্ট কিছু বলা হয়নি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অদক্ষতার কারণে নীতিমালাটি সার্বজনীন হয়নি। রয়েছে সুশাসনের অভাব। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের পরামর্শ না নেয়ায় প্যাকেজ বাস্তবায়ন হবে না। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা সুবিধা পাবে না। যাদের সঙ্গে ব্যাংকের যোগাযোগ ভালো তারাই সুবিধা পাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো খেলাপিকে ঋণ দেয়া যাবে না। কিন্তু খেলাপি হওয়ার সময় উল্লেখ করা হয়নি। এতে জটিলতা তৈরি হয়েছে। যেমন কোনো প্রতিষ্ঠান ১০ বছর ধরে ভালোভাবে ব্যবসা করে আসছে এবং ঋণও পরিশোধ করেছে নিয়মিত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কোনো কারণে খেলাপি হয়ে গেছেন। তাদের বিষয়ে নীতিমালায় কিছু করা হয়নি। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিতের বিষয়েও বিশদ কিছু উল্লেখ না থাকায় বিষয়টি ব্যাংকগুলোর জন্য জটিল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়াও কোনো কোম্পানি তিনবার ঋণ পুনঃতফসিল করলেও ঋণ সুবিধা পাবে না। এখন তিনবার বলতে কখন বা কত বছরে সুনির্দিষ্ট কোনো সময় উল্লেখ নেই। পাঁচ বছর আগে যদি তিনবার ঋণ পুনঃতফসিল করে কিন্তু এখন অনেক ভালো প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবসা করছে তাদের বিষয়ে কী ব্যবস্থা রয়েছে সেটাও কেউ বলতে পারছে না। যদিও করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় প্রণোদনার কথা বলা হচ্ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নীতিমালা করার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুয়েকজন বিশ্লেষকের পরামর্শ নিতে পারত। অথবা নীতিমালা করতে একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিতে পারত। তিনি বলেন, একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা এক সময় খারাপ হতেই পারে। তখন সে খেলাপি ছিল। এখন তো ভালো করছে। তাহলে সে কেন ঋণ পাবে না? নীতিমালায় বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেকোনো প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ঋণের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল স্থিতির সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত নতুন ঋণ সুবিধা প্রাপ্ত হবে। এক্ষেত্রে ফানডেড ও নন-ফানডেড ঋণের স্থিতির ওপর সবটুকু ফানডেড নেয়া যাবে- তা উল্লেখ নেই।

অন্যদিকে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থিতির ওপর নতুন ঋণ দেয়ার বিষয়টিতেও জটিলতা রয়েছে। কারণ ৩১ ডিসেম্বর প্রত্যেক ব্যাংক বার্ষিক আয়-ব্যয় ও মুনাফার চূড়ান্ত হিসাব করে। আর এজন্য ব্যাংক তাদের প্রত্যেক গ্রাহককে তাগিদ দিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা সমন্বয় করে। তাই বেশিরভাগ গ্রাহক ওই ঋণ সমন্বয় করলেও আবারো প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে জানুয়ারি মাস থেকে লিমিটেডের আওতায় আবারো সর্বোচ্চ ঋণ সুবিধা ভোগ করে। এক্ষেত্রে স্থিতির ওপর হিসাব করে প্রকৃত প্রণোদনা পেতে জটিলতার মুখোমুখি হবেন গ্রাহকরা।

এছাড়া প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রেফারেন্স স্কিম নামে পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা ও রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেতনভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকা রয়েছে তা বেশ জটিল বলে মনে করছেন পোশাক রপ্তানিকারকরা। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের জন্য কঠিন শর্ত দিয়েছে। আবেদন প্রক্রিয়া বেশ জটিল। ছোট কারখানাকে ঋণ আবেদনের জন্য প্রায় ২০০-৪০০ পাতা পূরণ করতে হবে। আর বড় কারখানা হলে তো শ্রমিকদের তথ্য সংবলিত হাজার পাতা পূরণ করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এত নথিপত্র জোগাড় করা কষ্টসাধ্য। তারপর এগুলো এসোসিয়েশন প্রত্যয়নের জন্য পাঠাতে হবে। এরপর সংশ্লিষ্ট কারখানা তাদের সিডিউল ব্যাংকে পাঠাবে। ব্যাংক সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবে।

এদিকে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের (এমএসএমই) জন্য মোট ৩০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে সরকার। এরমধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা পুনঃঅর্থায়ন তহবিল। গত ১৩ এপ্রিল এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, করোনা ভাইরাসের ক্ষতি মোকাবিলায় এই তহবিল থেকে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে পারবেন উদ্যোক্তারা। কোনো ঋণখেলাপি এবং খেলাপি হিসেবে সুবিধা নিয়েছেন এমন কেউ প্রণোদনার ঋণ পাবেন না। করোনার ক্ষতি কাটাতে গঠিত এই তহবিলের ঋণ বিতরণে কোনো ধরনের অনিয়ম হলে প্রদত্ত সুবিধা বাতিল করা হবে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, করোনা ভাইরাস মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত সারাদেশের ৫৩ লাখ ৭২ হাজার ৭১৬টি প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্র, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পাবেন না। কারণ প্রণোদনার শর্তে বলা হয়েছে- ব্যাংকে যাদের ঋণ আছে, তারা সেই ঋণের ৩০ শতাংশ পাবেন। কিন্তু ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের পছন্দ না করলে ঋণ দেবে না। ব্যাংকগুলো সবসময় বড় ব্যবসায়ীদের পছন্দ করে। তাদের শত শত কোটি টাকা দিলেও খুচরা ব্যবসায়ীদের কয়েক লাখ টাকা দিতে অনাগ্রহী। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো চালু রাখতে মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সব ধরনের ঋণের ও ব্যাংকগুলোতে থাকা সরকারি আমানতের সুদ মওকুফ করার দাবি উঠেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App