×

মুক্তচিন্তা

করোনা: মানবধ্বংসের এক নিষ্ঠুর খেলার নাম?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২০, ১১:১৩ পিএম

করোনা: মানবধ্বংসের এক নিষ্ঠুর খেলার নাম?

বোরহান বিশ্বাস

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথমবারের মতো করোনার উপস্থিতি ধরা পড়ে। উহান ছাড়া চীনের অন্য অঞ্চলগুলোতে করোনার প্রকোপ তেমনভাবে ছড়াতে পারেনি বা চীন ছড়াতে দেয়নি। কিন্তু চীন থেকে উৎপত্তি ভাইরাসটি এখন বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলেই ছড়িয়ে পড়েছে। করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুতে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ৫০টি অঙ্গরাজ্যেই করোনার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে। ইউরোপের স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়ামের মতো উন্নত দেশ ছাড়িয়েও, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা এমনকি আফ্রিকাতেও আঘাত হেনেছে করোনা। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে যথেষ্ট পদক্ষেপ না নেয়া এবং অতি সংক্রামক এ রোগ নিয়ে মিথ্যা বলার অভিযোগ তুলে চীন সরকার ও দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি একটি মামলা হয়েছে। মামলায় বলা হয়েছে, চীন সরকার কোভিড-১৯ এর বিপদ ও এর অতি-সংক্রামক প্রকৃতির বিষয়ে বিশ্বকে মিথ্যা বলেছিল। এছাড়া প্রথম যে চিকিৎসক এই ভাইরাস সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করেন তারও মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়। মামলার অভিযোগে আরও বলা হয়, চীন মহামারি এই রোগের বিস্তার থামাতে কমই চেষ্টা করেছে। এ কারণে তাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। বিশ্বের ওপর এখন যে বিরাট মৃত্যু, যন্ত্রণা ও অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে তার জন্য চীন দায়ী। এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনকে এই বলে হুঁশিয়ারি দেন যে, চীন ইচ্ছাকৃততভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। প্রমাণ পেলেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ট্রাম্প বলেন, চীনের ভুলের জন্য এখন পুরো পৃথিবীকে ভুগতে হচ্ছে। তারা চাইলেই ভাইরাসটিকে ছড়ানো থেকে আটকাতে পারতো। কিন্তু সেটা করা হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র ধোয়া তুলশি পাতা না হলেও চীনকে ঘিরে তারা যে অভিযোগ তুলেছে সেটি একেবারে অমূলক নয়। জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স, বৃটেন ও অস্ট্রেলিয়াও এখন যুক্তরাষ্ট্রের সুরে কথা বলা শুরু করেছে। সম্প্রতি করোনাভাইরাসের কারণে চীনের কাছে ১৩ হাজার কোটি পাউন্ডের ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে জার্মানির জনপ্রিয় জাতীয় পত্রিকা ‘বিল্ড’। করোনা মহামারির জন্য বেইজিংকে দায়ী করে প্রকাশিত এক মন্তব্য প্রতিবেদনে এমন দাবি জানায় পত্রিকাটি। এতে দাবি করা হয়, চীনের উহান থেকেই করোনাভাইরাসের উৎপত্তি এবং বিষয়টিকে চীন ধামাচাপা দিয়ে রাখতে চেয়েছিল। ‘বিল্ড’ যুক্তরাষ্ট্রের মতোই করোনায় চীন মৃতের সংখ্যাকে অনেক কম করে দেখিয়েছে বলে কথা তুলেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের দাবির প্রেক্ষিতেই চীন সম্প্রতি উহানে মৃতের সংখ্যা সংশোধন করেছে। এ ঘটনায় চীন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি দাবি ভিত্তি খুঁজে পেলো। মজার বিষয় হলো, কারোনার উৎস উহান থেকে যখন লকডাউন তুলে নেয়ার ঘোষণা এলো তখনও ইউরোপ ও আমেরিকা করোনায় মৃত্যু ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছিল। কোথাও কোথাও লকডাউন কিছুদিনের জন্য বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছিল। যদিও লকডাউন ভেঙে কোনো কোনো রাষ্ট্র স্বল্প মাত্রায় কাজ শুরুর ঘোষণাও দিয়েছে। তবে, সার্বিক অবস্থা এখনো একেবারেই নাজুক। বিশ্লেষকদের মতে, করোনার উৎপত্তিস্থল হিসেবে চীন যেখানে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের প্রচুর মানুষ মারা যাওয়ার কথা সেখানে তারা শুধুমাত্র লকডাউনে গিয়েই চার মাসের মাথায় করোনাশূন্য হয়ে উঠলো! অথচ অনেক দেশ লকডাউনে গিয়েও মৃত্যু কমাতে হিমশিম খাচ্ছে এখনো। তাছাড়া, উহান ব্যতিত চীনের অন্য কোনো শহরে করোনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। অথচ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, এশিয়াসহ প্রায় পুরো পৃথিবী এখন এ ভাইরাসের কারণে অচল হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) চীনের সুরেই কথা বলছে। বিষয়টি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। অন্তত পরাক্রমশালী কোনো দেশ যখন এমন অভিযোগ করে সেটা অবশ্যই গুরুত্বের দাবি রাখে। করোনাভাইরাস রোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে না পারার অভিযোগে সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অর্থ জোগান বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, যুক্তরাষ্ট্র যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সহযোগিতা দেয়া স্থগিত ঘোষণা করে, ঠিক তখনই এই সংস্থাটিকে ৩০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে চীন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, ইথিওপিয়ার নাগরিক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল ড. টেড্রস আধানম গেব্রিয়েসাসকে ২০১৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাচনে পূর্ণ সমর্থন দেয় চীন। এছাড়াও, ইথিওপিয়ায় চীনের অনেক বড় ধরণের বিনিয়োগের কথাও শোনা যায়।
সম্প্রতি ‘করোনাভাইরাসের সূত্রপাত নিয়ে নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্তের’ আহবান প্রত্যাখান করেছে চীন। তারা বলেছে যখন তারা ভাইরাস মোকাবেলায় ব্যস্ত তখন এই তদন্তের আহবান অনভিপ্রেত। ব্রিটেনে চীনের একজন শীর্ষ কূটনীতিক চেন ওয়েন বিবিসিকে বলেছেন, এই দাবি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং এটা করা হলে এই মহামারি মোকাবেলায় চীন যেভাবে কাজ করছে তা ব্যাহত হবে।
মনে করা হচ্ছে, কোভিড নাইনটিনের উৎস এবং প্রথমদিকে কীভাবে তা ছড়িয়েছে সে সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেলে তা এ রোগ মোকাবেলায় সহায়তা করবে। গত বছর উহান শহরে একটা বন্যপ্রাণী বিক্রির বাজার থেকে এ ভাইরাসের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়। তবে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিবেদনে অভিযোগ আনা হয়েছে চীন এই সঙ্কট সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন সম্প্রতি বলেছেন, আন্তর্জাতিক তদন্তকারীদের চীনে যেতে দেয়া এবং কোথা থেকে এই ভাইরাস ছড়ালো সে বিষয়ে আগামী সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য পরিষদের বার্ষিক বৈঠকে তিনি তদন্তের জন্য চাপ দেবেন। এদিকে, মহামারি করোনাভাইরাস চীনের একটি সামরিক জীবাণু অস্ত্র গবেষণাগার থেকে ছড়িয়ে পড়ার যে অভিযোগ বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে উঠেছিল তা অতি সম্প্রতি নাকচ করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। প্রায় চার মাস পর সংস্থাটি সম্প্রতি জানিয়েছে, হাতে আসা সব প্রমাণাদি বিশ্লেষণ করে তারা জানতে পেরেছে, জৈব গবেষণাগার নয় বাদুড়ের মাধ্যমেই করোনার উৎপত্তি হতে পারে। তবে, প্রাণী থেকে কীভাবে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে বার বার আঙুল উঠছে চীনের উহানের একটি গবেষণা কেন্দ্রের দিকে। ডিসেম্বরের শেষ দিকে এই শহরটি থেকেই প্রথম চীনে, এরপর বিশ্বজুড়ে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন এই ভাইরাসের নাম দেয় কভিড-১৯। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিরুদ্ধে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, চীনে করোনাভাইরাস দেখা দেয়ার পর সংস্থাটি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার তথ্য গোপন করেছিল। তাই তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত। অথচ নিজ দেশেই তিনি করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের বিষয় নিয়ে যথেষ্ট সমালোচিত। অনেকে মনে করেন, নিজের ব্যর্থতা ঢাকতেই তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ব্যর্থতার কথা বলছেন বার বার।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইলের দাবি, উহানের সেই গবেষণাকেন্দ্রে ৩৭ লাখ ডলার অর্থ সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (এনআইএইচ)। বাদুড় থেকে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে গবেষণা হচ্ছিল সেখানে। হুবেই প্রদেশ থেকে এক হাজার মাইল দূরে ইউনানের একটি গুহা থেকে বাদুড়গুলো ধরা হয়। করোনাভাইরাস নিয়ে তাদের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে নতুন করোনাভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থাৎ, চীনের এই গবেষণার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের আগ থেকেই জানা ছিল।
ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিনিক রাব এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, প্রাদুর্ভাব কীভাবে শুরু হলো এবং কেন তা আরও আগে থামানো গেল না- তা নিয়ে চীনকে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি করতে হবে। তিনি বলেছেন, চীন থেকে এই ভাইরাস কীভাবে বাইরে ছড়ালো তা গভীরভাবে অনুসন্ধান করতে হবে। করোনার মহামারিতে পরিণত হলেও সার্স ভাইরাসের ক্ষেত্রে কিন্তু চিত্রটা ছিল ভিন্ন। ২০১৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তখন ভ্রমণ সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। সবাইকে বলা হয়েছিল, দক্ষিণ চীনে যেন ভ্রমণ না করা হয়। কেননা ওটা রোগের এপিসেন্টার। সার্স ভাইরাসে ৮ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ৮শ মানুষ মারা যায়। এই সামান্যতম সংখ্যাতেই চীনকে ডব্লিউএইচও-এর পক্ষ থেকে তখন ভর্ৎসনা জানানো হয়েছিল। নিজের শক্তিমত্তা জানান দিতেই হয়তো চীন ব্রিটেনের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কথা জানার পরপরই তাদের আবিষ্কারের কথা জানিয়ে দেয়। সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় জানায়, সেপ্টেম্বরের ভেতর ভ্যাকসিন প্রস্তুতের বিষয়ে তারা ৮০ শতাংশ আশাবাদী এবং ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের তৈরি এই ভ্যাকসিন সফল হলে বড় ধরণের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে গোটা বিশ্ব। এ ঘটনার অল্প ক’দিন পরে চীনও করোনাভাইরাসের কার্যকরী একটি ভ্যাকসিন প্রস্তুত করেছে বলে গণমাধ্যমে খবর আসে। যা জরুরি অবস্থায় ব্যবহারের জন্য আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ও সর্ব সাধারণের ব্যবহারের জন্য আগামী বছরের প্রথম দিকে উন্মুক্ত করে দেয়া যাবে বলে জানিয়েছে চীন। এর মধ্য দিয়ে প্রথম কোনো চীনা কর্মকর্তা করোনা ভ্যাকসিন তৈরির জন্য সময়রেখা ঘোষণা করেন। করোনা ভাইরাসের ওপর প্রতিদিনই বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ আপডেট, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, জার্নালসহ নানা রকম বিশ্লেষণ চলছে। সচেতন পাঠক মাত্রই করোনার উৎপত্তি এবং বিশ্বজুড়ে তা ছড়িয়ে পড়ার পেছনে চীন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার বিষয়ে ইতোমধ্যে ধারণা পেতে শুরু করেছেন। ভাইরাস নামে সুপার পাওয়ারদের মানবধ্বংসের নৃশংস খেলা বিশ্ববাসী বুঝতে শুরু করেছে। সময়ই একদিন সবকিছু প্রকাশ করে দেবে। লেখক: সাংবাদিক বোরহান বিশ্বাস  

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App