×

জাতীয়

বিপর্যয়ের সপ্তাহ শুরু!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২০, ১০:১৫ এএম

প্রতিদিনই বাড়ছে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ। বাড়ছে প্রাণহানিও। দেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার ৪৯তম দিনে এসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজারে। একই সঙ্গে এই সময়ে মারা গেছেন ১৪০ জন। গতকাল শনিবার পর্যন্ত রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, ঝিনাইদহ ও সাতক্ষীরা জেলা ছাড়া বাকি ৬০টি জেলাতেই করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। চলমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে চলতি সপ্তাহে দেশে করোনার সংক্রমণ, মৃতের সংখ্যাও চূড়া স্পর্শ করতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তারা এও বলেছেন, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে এবং এরপর থেকে কমতে শুরু করবে। এর ফলে বিপর্যয়ের সপ্তাহ শুরু হলো কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা ভোরের কাগজকে বলেছেন, এই প্রশ্নের উত্তর দেয়াটা একটু কঠিন। আর এখনই এই প্রশ্নের উত্তর দেয়াও যাবে না। স্বাস্থ্যবিধি যেভাবে মেনে চলার কথা, দেশের বহু মানুষ সেভাবে মেনে চলছেন না। এর ফলে রোগটি একজন থেকে তিনজনে ছড়াচ্ছে। এছাড়া ভয়ের বিষয় হচ্ছে, ইদানীং কোনো উপসর্গ ছাড়াই রোগটি ছড়াচ্ছে। পরিস্থিতি যা দাঁড়াচ্ছে তাতে বোঝা যায়, রোগটি এখন ‘রাইজিংয়ে’ আছে। যদি আক্রান্তের সংখ্যা ‘ফ্ল্যাটে’ও আসত তাহলেও না হয় একটা পূর্বাভাস দেয়া যেত। এ অবস্থায় এপ্রিল মাস তো চলেই যাচ্ছে। ফলে মে মাসে ঝুঁকি কমে যাবে- তা এখন কেমন করে বলি? স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এখনো কোনো আশার বাণী শোনাতে না পারলেও গত বৃহস্পতিবারই সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন, এ সময় অর্থাৎ করোনার আক্রমণ শুরু হওয়ায় ৪৫ দিন পর্যন্ত বিশ্বের অন্য দেশে যে হারে সংক্রমণ ছড়িয়েছিল তার তুলনায় বাংলাদেশে সংক্রমণের সংখ্যা কম। অবশ্য এর আগে গত ৭ এপ্রিল কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এপ্রিল মাস নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এপ্রিলের শেষের দিকে এসে দেখা গেছে, সংক্রমণের তীব্রতা পাওয়া যাচ্ছে। আর এ কারণে বিশেষজ্ঞরা এখন এসে বলছেন, আসন্ন মে মাসটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এ রকম পরিস্থিতিতে আজ রবিবার থেকে সরকারের ১৮টি বিভাগের অফিস চালু হচ্ছে। পোশাক কারখানাও খুলে দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। সঙ্গতকারণেই মানুষের চলাচল বাড়বে। এর ফলে সংক্রমণ ও মৃত্যু কোথায় গিয়ে ঠেকবে তার আভাস এখনই দিতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও যে বাড়তে থাকবে- এ নিয়েও বিশেষজ্ঞদের মনে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়ে শেষ পর্যন্ত কোথায় পৌঁছবে এবং কোন পর্যায়ে এসে এই হার কমতে শুরু করবে, এ সম্পর্কিত একটি মডেল আইইডিসিআরের হাতে রয়েছে। কিন্তু জনমনে আতঙ্ক ছড়াতে পারে সেই বিবেচনায় এই মডেলটি সরকার বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকাশ্যে আনতে চাইছে না। এ বিষয়ে বিবিসি বাংলার এক প্রশ্নের জবাবে ভাইরোলজিস্ট ড. নজরুল ইসলাম বলেন, ওই মডেল সামনে না এনে একদিক থেকে ঠিক কাজটিই করা হয়েছে। কারণ এই মুহূর্তে পূর্বাভাস দেয়ার মতো যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বলেন, কোভিড-১৯ রোগীদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহের কাজে নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। একদিন নমুনা সংগ্রহ করে আরেক দিন তা পরীক্ষা করা হচ্ছে। সেই তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে অন্য এক দিন। ফলে এর থেকে এখনই কোনো সুনির্দিষ্ট মডেল তৈরি করা কঠিন। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ হয়েছে ৩ হাজার ৪২২টি। এর মধ্যে নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৩ হাজার ৩৩৭টি। কারণ একদিন আগে শুক্রবার থাকায় বেশ কয়েকটি পরীক্ষাগারে পরীক্ষা হয়নি। এর ফলে আগের দিন শনাক্তের সংখ্যা ৫শ ছাড়ালেও গতকাল তা ৩০০-এ নেমে এসেছে। তার মানে করোনায় আক্রান্তের পরিমাণ কমে গেল বলে এখনই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর কোনো কারণ নেই। এই সংখ্যাটি আবার বাড়া শুরু করবে। দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বেশ কয়েক দিন ধরেই তিনশ বা চারশর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। একদিন মাত্র পাঁচশতে উঠেছিল। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি এপ্রিল মাসে ঝুঁকি ছিল না? বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা ভাইরাস সংক্রমিত বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে যে ধারণাটি পাওয়া যায় তা হলো, এই সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ার কথা ছিল। একটা পর্যায়ে এসে এ সংখ্যা প্রতিদিন এক হাজার কিংবা দুই হাজারো হতে পারত। আর এখানেই তারা বলেছেন, দেশে করোনা পরীক্ষা করার মডেলটিই এখনো সর্বজনীন হয়নি। চলতি এপ্রিলের শুরুর দিকে কেবল আইইডিসিআরে; এরপর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে ২১টি পরীক্ষাগারে নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে যেমন কম নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল, তেমনি শনাক্তও কম পাওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে করোনার পরীক্ষার সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। আগে মাত্র একটি ল্যাবে হলেও এখন ২১টি ল্যাবে এই পরীক্ষা হচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যে এই সংখ্যা আরো বাড়বে। তবে এখনও অনেকে সামাজিকভাবে হেনস্থা হওয়ার ভয় থেকেই পরীক্ষা করাতে যাচ্ছেন না। আবার অনেকেই মনে করছেন, করোনায় আক্রান্ত হলে চিকিৎসা নেই। হাসপাতালে গেলেও নাপা, প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেতে হবে। তারচেয়ে ফার্মেসি থেকে নিজে নিজেই নাপা প্যারাসিটামল খেয়ে নিচ্ছেন কেউ কেউ। অনেকে আবার ভেষজ চিকিৎসার থেরাপিও নিচ্ছেন। তবে গত কয়েক দিন ধরে করোনা ভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা বেশ বেড়েছে, ফলে আরো কিছুদিন ঝুঁকিতেই থাকতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দুই কারণে ঝুঁকিটা বিশ্লেষণ করা যায়। এর মধ্যে সংক্রমণ কতটা শনাক্ত হচ্ছে এবং সংক্রমণ মোকাবিলায় প্রস্তুতি কতটা রয়েছে। এই দুটো কারণেই চলতি এপ্রিল মাস অবশ্যই ঝুঁকিতে ছিল। কারণ এ সময়টাতেই লকডাউন করে যোগাযোগ বন্ধ করা হয়েছে। পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ করা হয়েছে। মানুষের যাতায়াত এবং রাস্তাঘাটে তাদের অবস্থান কম চোখে পড়েছে। অন্তত কিছু হলেও মানুষ ঘরে থেকেছে। সে হিসেবে লকডাউনটা বেশ ভালো কাজ করেছে এবং এটা বেশ ভালো পদক্ষেপ ছিল। আর এ কারণেই ঢাকা থেকে সংক্রমণ গ্রামে তেমন একটা পৌঁছাতে পারেনি। তবে আজ রবিবার থেকে সরকারি ১৮টি অফিস চালু হচ্ছে। ধাপে ধাপে পোশাক কারখানাও চালুর তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। ধীরে ধীরে যোগাযোগ ব্যবস্থাও চালু হবে। এ জন্য আসন্ন দিনগুলো আরো বেশি ঝুঁকিতে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ এখনই উপসর্গবিহীন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এখন এসব যখন চালু হবে বিশেষ করে পোশাক কারখানা চালু হবে, তখন পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়াবে- এ নিয়েই দুশ্চিন্তা করছেন সংশ্লিষ্টরা। মানুষের চলাচল যখন বাড়বে তখন আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়তে পারে। এর ফলে কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন ও চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি ফের সামনে আসবে। সর্বোচ্চ সংক্রমণের সংখ্যা (পিক) মে মাসে হবে নাকি সেটি জুন মাস নাগাদ হবে- তাও বিশেষজ্ঞদের কাছে একটি এক বড় প্রশ্ন। মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, আগামী কয়েক দিন সংক্রমণের হার বেশি হতে পারে। এরপর থেকে এটি ধীরে ধীরে কমে আসবে। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান সাইফুল্লাহ মুনশি বিবিসিকে বলেছেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে দেশে কোনো পূর্বাভাস দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, একটা দেশের মধ্যে ডেমোগ্রাফি, স্বাস্থ্য সুবিধা এবং এপিডেমিওলজিক্যাল তথ্যের ভিত্তিতে একটা কার্ভ তৈরি করা হয়। যার মাধ্যমে জানা যায়, রোগের পিকটা কখন হবে। তার মতে, বাংলাদেশে এটা করা হলে, এপ্রিল, মে নাকি অন্য কোনো সময় পিকটা হবে তার ধারণা পাওয়া যেত। কিন্তু আমাদের সেটা করা হয়নি। মে মাসকে ঝুঁকিপূর্ণ ধরতে হবে। কারণ বর্তমানে সংক্রমণের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, সে হারেই যদি বাড়তে থাকে তাহলে মনে হচ্ছে, মে মাসে গিয়ে হয়তো একটা পিকে পৌঁছে যাবে। সম্প্রতি জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহবুবও ভোরের কাগজকে বলেছিলেন, আগামী দিন পনেরোর মধ্যে করোনার গতিপ্রকৃতি বোঝা যাবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App