×

স্বাস্থ্য

কমিটির বহর, সমন্বয় নেই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২০, ০৯:২৮ এএম

ক্রমেই জটিল হচ্ছে করোনা সংকট। বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি কখন ও কোথায় গিয়ে থামবে তাও অনিশ্চিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস ঘেব্রেয়াসাস বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে করোনা মহামারি মোকাবিলায় পৃথিবীর বহু দেশ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলে সতর্ক করেন। তিনি বলেন, আরো দীর্ঘদিন এই ভাইরাস পৃথিবীতে থাকবে। এই প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশে জাতীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তিন স্তরে কমিটি গঠনের কথা বলে আসছে সরকার। জাতীয় কমিটির সভাপতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, জেলা কমিটির প্রধান জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। তবে জাতীয় কমিটিতে কী সিদ্ধান্ত হয় সেই তথ্য সভাপতি নিজেও জানেন না বলে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

এরপর করোনা ভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ১৭ জন বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে গঠন করা হয় জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি। এই পরামর্শক কমিটির সভাপতি করা হয় বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সভাপতি ও শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে। ওই কমিটি সরকারকে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ, হাসপাতালে সেবার মান বাড়ানো, যেসব চিকিৎসক স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন তাদের সক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া, স্বাস্থ্যসেবা দানকারী চিকিৎসকসহ অন্যদের উৎসাহ দিতে কী কী ব্যবস্থা নেয়া যায় ও কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন সংক্রান্ত গবেষণার বিষয়ে পরামর্শ দেবে। বিশেষজ্ঞ এবং ওই সব কমিটিতে থাকা সদস্যরা বলছেন, এত কমিটি করেও এখনো পর্যন্ত কাজের সমন্বয় করা সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আক্রান্তদের ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালকে সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত করার কথা শুরু থেকেই বলে আসছে। আশ্বাস দিয়েও বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আশানুরূপ কোনো ভ‚মিকা রাখেনি। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিছু বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ইতোমধ্যেই কর্মীদের করোনা আক্রান্তের দোহাই দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, চিকিৎসকদের অর্ধেক বেতন দিয়ে, জোরপূর্বক ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। করোনা আক্রান্ত চিকিৎসকদের দায়িত্ব নিতেও অস্বীকৃতি জানাচ্ছে হাসপাতালগুলো। চিকিৎসকদের ওপর দায় চাপানোসহ নানা উছিলায় সেবা কার্যক্রম বন্ধ রাখছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসকদের ব্যবহার করে ব্যবসা বড় করেছে। অথচ মাত্র দুই মাস হাসপাতালে রোগী কম হওয়ায় চিকিৎসকদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করছে। এতে হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসকদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে চিকিৎসকদের দূরত্ব বাড়ছে।

অব্যবস্থাপনার চিত্র সর্বত্র দৃশ্যমান বেসরকারি হাসপাতালের পিছটান

অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, প্রজ্ঞাপনটি জারি হয়েছে ১৮ এপ্রিল রাতে। আমরা যারা এই কমিটির সদস্য তারা বিষয়টি জেনেছি ১৯ এপ্রিল। এর পরদিন অর্থাৎ ২০ এপ্রিল বিএমডিসিতে কমিটির প্রথম সভা হয়। প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী ওই সভায় করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের চলমান কাজ নিয়ে কথা হয়েছে। যেসব ক্ষেত্রে কাজের আরো বেশি সমন্বয় এবং উন্নয়ন দরকার সেই বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সভায় মোটা দাগে চারটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেগুলো হলো : চিকিৎসাসেবা, হাসপাতালগুলোর বর্তমান সেবার উন্নতি, নমুনা পরীক্ষার অবস্থা এবং পরিস্থিতি কতটা ‘প্রজেকশন’ হতে পারে সেই বিষয়টি বিবেচনা করে ব্যবস্থা নেয়া। এই চারটি বিষয়ে কাজ করার জন্য চারটি উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা আমাদের পরামর্শ দিয়েছি। এই কমিটির কাজই হলো পরামর্শ দেয়া। সেগুলো বাস্তবায়ন করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আমরা আশা করছি তারা আমাদের পরামর্শ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবে। সরকারের ডাকে এখনো বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আশানুরূপ সাড়া না দেয়া প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, এখানে সরকারি-বেসরকারি বলে কোনো কিছু নেই। সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমি জানি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেসরকারি হাসপাতাল মালিক ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সভা করেছে। রোডম্যাপ অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কিনা সেই বিষয়টিও আমরা মনিটরিং করব। পরামর্শক কমিটির সদস্য স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান। কমিটিতে থাকার বিষয়টি তিনি গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানতে পারেন। করোনা মোকাবিলার কাজে এখনো সমন্বয় হয়নি উল্লেখ করে এই চিকিৎসক নেতা ভোরের কাগজকে বলেন, এই যে এত কমিটি করা হচ্ছে তা দিয়ে কাজের কাজ কী হচ্ছে? এসব কমিটি কাজের চেয়ে প্যাঁচ লাগচ্ছে বেশি। হযবরল অবস্থা। জাতীয় কমিটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওই কমিটি আছে কিনা সেটি আমি নিজেও জানি না। জাতীয় কমিটিটি মূলত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ওই কমিটি গঠিত হয়েছে। কিন্তু সেখানে কাজের কথা কতটা হয়েছে? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা ও অবহেলা এখনো স্পষ্ট। আমাদের কথা কেউ শুনছে না। কমিটির অপর এক সদস্য অবসটেট্রিকেল এন্ড গাইনোকলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি এবং প্রসূূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগমও কমিটিতে থাকার বিষয়টি আগে থেকে জানতেন না। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, প্রজ্ঞাপন জারির পর বিষয়টি আমি জানতে পেরেছি। এ পর্যন্ত কমিটির যে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে সেখানে আমরা বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছি। আমরা নমুনা পরীক্ষার বিষয়ে জোর দিয়েছি। বেশি বেশি নমুনা পরীক্ষা না হলে প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা জানাতে পারব না। ওজিএসবির পক্ষ থেকেও আমরা সরকার এবং বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের আহ্বান, তারা যেন রোগীদের ফিরিয়ে না দেন। তবে কাজটি সহজ নয়। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ এসোসিয়েশনের সভাপতি এম এ মুবিন খান জানান, এরই মধ্যে তিনটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য ডেডিকেটেড করা হয়েছে। এসব হাসপাতালে আইসিইউ বা অন্যান্য সব সুযোগ-সুবিধা আছে। আরো কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালকে যুক্ত করার কাজ চলছে। তবে এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, এই ক্রান্তিকালে বেসরকারি হাসপাতালগুলো নামেই যুক্ত আছে। কিন্তু কাজে নেই। সেবার নামে হাসপাতাল করে তারা মূলত দোকান খুলে বসেছে। মানবসেবা কিংবা আর্তমানবতার সেবার ধারে কাছেও তারা নেই। তাদের কাছে ব্যবসাই মুখ্য। এই পরিস্থিতিতে তাদের ব্যবসায় ভাটা পড়েছে। রাজধানীর বড় হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা নেমেছে অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশে। ব্যবসায় লোকসান দেখে তারা এখন সব দোষ চাপাচ্ছে চিকিৎসকদের ওপর। অথচ তাদের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা হচ্ছে না। চিকিৎসকদের অর্ধেক বেতন ও ছাঁটাই কিংবা জোরপূর্বক চাকরি ছাড়তে বাধ্য করার বিষয়ে সজাগ আছেন বলে ভোরের কাগজকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক এসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া। তিনি বলেন, আমরা এ বিষয়ে সজাগ আছি। তবে কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App