×

মুক্তচিন্তা

করোনায় বদলে গেল চিরচেনা দৃশ্যপট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২০, ০৬:৩৮ পিএম

করোনায় বদলে গেল চিরচেনা দৃশ্যপট

করোনাকালের জনশূন্য মহানগরী।

করোনা প্রভাবিত এই দুর্যোগ সময়ে ঘরবন্দি থাকতে বাধ্য হচ্ছেন সবাই। প্রতিরোধের নিয়মটাই এমন। গণজমায়েত এড়িয়ে গৃহে অবস্থান। উৎসবমুখর, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা সামাজিক সব অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করে ‘দূরত্ব বজায়’ রাখার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। ব্যাকফুটে গিয়ে আপাতত বাঁচার এটাই উত্তম পন্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সে কথাই বলছে। যান্ত্রিক সময়ের ব্যস্ত সব মানুষরা এখন ঘরবন্দি। জীবনাচারে এসেছে অনেক পরিবর্তন। চিরচেনা দৃশ্যপট বদলে গেছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক সবকিছুতেই এসেছে পরিবর্তন-

পাল্টে গেছে বাজার পদ্ধতি একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশের মানুষ বাজারে গেলে খালই (এক ধরণের বেত দিয়ে তৈরি) সঙ্গে নিয়ে যেতেন। এক খালইতে মাছ ও তরিতরকারি কিনে নিয়ে আসতেন। এর কিছুকাল পর চট ও কাপড়ের ব্যাগের প্রচলন শুরু হলো। আধুনিকতার ছোঁয়ায় খালই কিংবা কাপড়ের ব্যাগের ব্যবহার কমে গিয়ে সেই জায়গা দখল করে নিলো পলিথিন ব্যাগ। যা ক্রমেই পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ালো। নানাবিধ কর্মসূচি ও বিকল্পের সন্ধান বের করা হলেও পলিথিন থেকে এখনো আমরা একেবারেই বের হতে পারিনি। ঘুরেফিরে পলিথিন এসেছে বার বার। অথচ পরিবেশ বান্ধব খালই, চট কিংবা কাপড়ের ব্যাগ আর ফিরে এলো না। চেষ্টা করা হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু ব্যবহার বাড়ছে না। এখন করোনা সময়ে প্লাস্টিকের ব্যবহার অথবা পলিথিনে বাজার করতে ইতস্তত প্রকাশ করছেন অনেকে।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় মনোনিবেশ ইসলাম ধর্মে আছে পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। ধর্মীয় আচারের পূর্ব শর্তই হলো পরিচ্ছন্ন বা পাক-সাফ থাকা। সব ধর্মই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার ওপর গুরুত্ব দেয়। মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের উপায় হিসেবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। বাসা-বাড়ির মানুষগুলো এখন অনেকটাই এ বিষয়ে সচেতন। পরিচ্ছন্নতায় সময় দিচ্ছেন সবাই। স্বামী বিবেকানন্দ জাপানীদের ‘পৃথিবীর সবচেয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জনগণের অন্যতম’ বলে অভিহিত করেছেন। বৌদ্ধ ধর্মে রান্না আর পরিচ্ছন্নতা আধ্যাত্মিক বিষয় বলে বিবেচিত হয়।

বন্ধ সভা-সমাবেশ-গণজমায়েত উন্নত বিশ্বে রাজনৈতিক নেতাদের যেখানে লোক সমাগম কম ঘটিয়ে যত দ্রুত সম্ভব বক্তৃতা, বিবৃতি শেষ করতে দেখা যায়, সেখানে আমাদের এই উপমহাদেশে বিশেষত বাংলাদেশে সভা-সমাবেশে লোক জড়ো করা বহু পুরনো একটা রেওয়াজ। কালক্রমে এখন তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যিনি যত লোকের শোডাউন দেখা পারেন তিনি যেন তত বড় নেতা! করোনার প্রকোপে এখন অবশ্য একেবারেই উল্টো চিত্র। সভা-সমাবেশ বন্ধ থাকার পাশাপাশি বাড়তি লোকের কোনো সমাগম নেই কোথাও। বরং তা এড়িয়ে চলতে নানা ধরণের পরমার্শ দেয়া হচ্ছে। ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মসজিদে ওয়াক্ত নামাজে পাঁচজন ও জুম্মায় সর্বোচ্চ ১০ জনের বেশি মুসল্লি একসঙ্গে হওয়ার নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। সৌদি আরবের মক্কা ও মদিনায়ও চলছে কড়া লকডাউন। সেখানেও ঘরের বাইরে তারাবি ও ঈদের নামাজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশেও এমনটি বলা হয়েছে।

ঘরে বসে উৎসব পালন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, মহান স্বাধীনতা দিবস, পবিত্র শব-ই বরাত, বাংলার অসাম্প্রদায়িকতার চিরন্তন প্রতীক ‘বাংলা নববর্ষ’ উদাযাপন সবই এবার ঘরে বসে পালন করতে হয়েছে। প্রতিটি অনুষ্ঠানের আগে প্রধানমন্ত্রী নিজে দেশের মানুষকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা স্মরণ করে দিয়েছেন। আগামীর কথা বলে আশা জুগিয়েছেন। এ এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা।

সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ বিপদে পড়লেই আমরা সাধারণত এই কাজটি করতে থাকি। করোনাকালে এখন প্রায়ই কোরআন, গীতা পাঠের সুর কানে ভেসে আসছে। দেশ স্বাধীনের আগে ও পরে অনেক হিন্দু-মুসলিম বাড়িতে এই ধর্মীয় আচার দেখা যেত। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চিত্র ফুটে উঠতো। পরবর্তী সময় দেশে সাম্প্রদায়িকতা, উগ্রতা বাড়লেও ধর্মীয় আচার সেভাবে বাড়েনি। প্রকৃত ধর্মাচারের জায়গা থেকে দিন দিন মানুষ দূরে সরে গেছে।

পারস্পরিক সৌহার্দ্যতা বৃদ্ধি সামাজিক পরিবর্তনে পারস্পরিক সৌহার্দ্যতা অনেকটাই কমে এসেছে। পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজ-খবর রাখার চিরন্তন বাঙালি প্রথায় কোথায় যেন একটা ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। যান্ত্রিক সময়ের মানুষগুলো যেন এক একটা যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। তীব্র প্রতিযোগিতা সবখানে। করোনার এই সময়ে পারস্পরিক সৌহার্দ্য বেড়েছে লক্ষ্যণীয় মাত্রায়। এটা আমাদের সুখী করে তোলে।

ধৈর্য্য পরীক্ষায় ডাক্তাররা করোনায় চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের ৬ ডাক্তারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অনেক বেসরকারি ক্লিনিক বন্ধ করে রাখা হয়েছে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে। এতে, অনেক সাধারণ রোগীও সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকার এসব প্রতিষ্ঠান ও ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, শহুরে ডাক্তারদের একটি অংশ যখন রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়া থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখছেন, তখন ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা, উপজেলায় অবস্থান করা গ্রাম ডাক্তারদের একটি বড় অংশ রোগীদের সেবা দিতে কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের সাফ কথা, এই মানুষগুলো তাদের গ্রামেরই। আত্মীয়-পরিজনের মতো। বিপদের এই সময়ে তারা তাদের ফেলে দিতে চান না। জনপদের এসব সাহসী ডাক্তারদের দিকে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি দেয়া উচিত।

গণমাধ্যমে ঘন ঘন ছুটি অন্য পেশার মানুষদের চেয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের ছুটিছাটা সাধারণত কম থাকে। কিন্তু করোনাকালে এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মতো টানা ছুটি না হলেও এই প্রথমবারের মতো ঘন ঘন ছুটিতে যাচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। আসলে গণমাধ্যমে সবার একসঙ্গে ছুটি কাটানো সম্ভব নয়। কেউ ছুটিতে যাবেন, কেউ ছুটি কাটিয়ে আসবেন। একটি সমন্বিত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই গণমাধ্যমগুলো তাদের কাজ চালিযে যায়। দেশবাসী জানতে পারেন ঘটে যাওয়া সর্বশেষ সংবাদটি।

যতো রাগ বিদেশফেরতদের ওপর অনেক আগে বিলেতফেরত কাউকে দেখতে গ্রাম কি শহর সর্বত্রই একটা উৎসবের অবস্থা তৈরি হয়ে যেত। স্থানীয় বন্ধু-বান্ধব ছাড়াও দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়-স্বজনরা আসতেন বিদেশফেরত মানুষটিকে দেখতে। করমর্দন, কোলাকুলি, খাওয়া-দাওয়া সবই হতো। করোনা সেই অবস্থা পুরোটাই পাল্টে দিয়েছে। অন্তত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইতালিফেরত যে কেউ এখন সবার চক্ষুশূল। বিদেশ থেকে স্বদেশে এসে অনেককেই পরিচয় গোপন করে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা এশীয় বলে কোন কথা নেই। দেশের বাইরে হলেই ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের অবস্থাও এখন ইতালির মতো। এই দুটি অঞ্চল থেকে কেউ ঢাকার বাইরে গেলেই হলো!

খাঁ খাঁ করছে সবুজ মাঠ বিশ্বে সব ধরণের খেলা এখন বন্ধ। ইংলিশ, স্প্যানিশ, বাছাইপর্ব ফুটবল, উইম্বলডন টেনিস, অলিম্পিক প্রতিযোগিতা, আইপিএল, বিপিএল, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের বিদেশ সফর সব বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সবুজ মাঠ খা খা করছে। বিশ্বের চিরচেনা অনেক মাঠই এখন অস্থায়ীভাবে করোনা আক্রান্তদের সেবার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সম্প্রতি ঘরে সময় কাটানোর পরামর্শ হিসেবে টিভিতে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখার কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় যখন একে একে লকডাউন দেয়া শুরু হলো তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের পক্ষ থেকে এক জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘কোথাও কেউ নেই’ ও ‘বহুব্রীহি’র প্রচারের সিদ্ধান্ত নেয়। দর্শকরা প্রাণ ভরে উপভোগ করছেন সেই নাটক। তবে, ঈদ কেন্দ্রিক নাটক ও বিনোদমূলক অনুষ্ঠান আদৌ নির্মাণ হবে কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

অর্থনেতিক অবস্থা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর কারম্যান এম রেইনহার্ড ১০০ বছর আগে স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জার অভিঘাতে কীভাবে বিশ্ব অর্থনীতি আক্রান্ত হয়েছিল তা দেখিয়েছেন। ১৯১৮ সালে যখন ওই ইনফ্লুয়েঞ্জায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছিল ঝড়ের গতিতে, তখন বিশ্বজুড়ে একে একে ঝরে পড়ছিল ব্যবসা। ১৯১৮ সালে মার্কিনিদের প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৬ শতাংশে পৌঁছলেও ফ্লুর সংক্রমণ পরবর্তীতে তা কমে ১ শতাংশে দাঁড়ায়। সম্প্রতি বিশ্ব শ্রম সংস্থা আইএলও জানিয়েছে, করোনা মহামারীর প্রভাবে কম করে হলেও চাকরি হারাবেন বিশ্বের ৮০ লাখ মানুষ। আর প্রভাব বেশি মাত্রায় পড়লে বেকার হবেন ২ কোটি ৪৭ লাখ মানুষ। তবে, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বাংলাদেশের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এ জন্য ঘোষণা করা হয়েছে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা। ‘কাউকে চাকরি থেকে বিতাড়িত করা হবে না’ বলে আশ্বস্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। করোনা প্রতিরোধে যেমন বৈশ্বিক পরামর্শ গ্রহণ করার পরও প্রতিটি দেশই যার যার মতো স্বতন্ত্রভাবে এগুচ্ছে; তেমনি নিজেদের অর্থনৈতিক ক্যারিশমা দেখিয়ে যে কোন দেশই বিশ্ব মন্দা মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।

শুধু পাল্টায়নি দুর্নীতিবাজরা দুর্নীতি এখনো বাংলাদেশের মানুষের মাথা ব্যথার অন্যতম কারণ। হাতেনাতে ধরা পড়ছে দুর্নীতিবাজ। শাস্তিও হচ্ছে। এদের মধ্যে একটা শ্রেণি আছে, দুর্নীতি যাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে। করোনার এই সংকটকালেও তারা ত্রাণের চাল, তেল চুরি করছে। কেউ কেউ যখন ব্যক্তিগত উদ্যোগী হয়ে নিভৃতে ত্রাণ বিতরণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন, ঠিক তখনই দুর্নীতিবাজরা কোন গোডাউন থেকে ক’বস্তা চাল সরাবেন কিংবা বাড়ির কোন ঘরের খাটের নিচে কী পরিমাণ তেল মজুদ করবেন, সেই হিসেব কষছেন। করোনার এই মহাদুর্যোগকালেও কি তাদের চরিত্রে কোনো পরিবর্তন আসবে না?

লেখক: সাংবাদিক, ঢাকা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App