×

জাতীয়

লকডাউন ভেঙে জানাজায় জনস্রোতের দায় কার?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২০, ১০:৩৪ এএম

 করোনা ভাইরাসের কারণে চলমান লকডাউনের নির্দেশনা অকার্যকর করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় একটি জানাজায় লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটার পর প্রশ্ন উঠেছে এর দায় কার? স্থানীয় প্রশাসন এ নিয়ে মুখ খুলছে না। তবে পুলিশ তড়িঘড়ি করে সরাইল সার্কেলের এএসপি ও সরাইল থানার ওসিকে প্রত্যাহার করে মুখরক্ষা করতে চাইছে। লকডাউন ভেঙে কীভাবে এত লোকের জমায়েত হলো তার কারণ নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লার জেলা প্রশাসনের কাছে জানতে চেয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। শত শত গাড়ি নিয়ে এসব জেলা থেকে লোকজন শনিবার ওই জানাজায় অংশ নেন। এ সময় স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ ছিল নমনীয়। তারা জনসমাগম ঠেকানোর কোনো উদ্যোগই নেয়নি। ওই এলাকার জনপ্রতিনিধিরাও কোনো ভূমিকা পালন করেনি। সচেতন মহলের মতে, সাম্প্রদায়িক চক্র ও মৌলবাদীদের আখড়া হিসেবে পরিচিত ওই অঞ্চলে প্রশাসনের আচরণ বরাবরই রহস্যময়। অতীতেও বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক উসকানির ঘটনায় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কাউকে কাউকে মৌলবাদীদের প্রশ্রয় দিতে দেখা গেছে।

এদিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভৈরবের মেঘনা সেতু দিয়ে গতকাল রবিবার যান চলাচল বন্ধ করে স্থানীয় প্রশাসন বোঝাতে

চাইছে, তারা তৎপর। কিন্তু এর আগের দিন তাদের ঢিলেমির কারণে দেশের মানুষের ভয়ঙ্কর সর্বনাশ হয়ে গেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জানাজায় যত লোক জড়ো হয়েছিলেন তাদের মধ্যে যদি করোনার সংক্রমণ ঘটে তবে ওইসব এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। এক জানাজা থেকে বহু জানাজার সৃষ্টি হবে। আর এটি এমন এক রোগ, এই রোগে মারা গেলে নতুন সৃষ্টি হওয়া জানাজা পড়াও যাবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, অদ্বৈত মল্লবর্মণের স্মৃতিধন্য একসময়ের অসাম্প্রদায়িক, মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীল চেতনার ব্রাহ্মণবাড়িয়া এখন ধর্মান্ধতার আতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে। ’৭৫ এর পটপরিবর্তন ওই এলাকায় মৌলবাদের যে বিস্তার করেছে তা এখন মহীরুহে পরিণত হয়েছে। ২০০৯ এর আগে প্রায় ৩৪ বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থেকে প্রতিক্রিয়াশীল বিএনপি-জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা এমপি হয়েছেন। এদের প্রশ্রয়ে এখানে ধর্মান্ধতা এতটা বেড়েছে, প্রায়ই সেখানে প্রশাসনের নির্দেশনার তোয়াক্কা করে না মৌলবাদীরা। আর প্রশাসনও ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে তেমন ঘাটাতে চায় না।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার বেড়তলা জামিয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসা মাঠে মাওলানা জুবায়ের আহমেদ আনসারীর জানাজা অনুষ্ঠিত হয় গত শনিবার সকাল ১০টায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছাড়াও পাশ্ববর্তী কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নরসিংদী, কুমিল্লা ও ঢাকা থেকে লোক গিয়ে ওই জানাজায় অংশ নেন। নামাজের জন্য নির্ধারিত মাঠে জায়গা না হওয়ায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কয়েক কিলোমিটার অংশে জানাজা পড়েন লাখো মানুষ। বাইরের মানুষের সঙ্গে জানাজায় অংশ নিয়েছিলেন মাদ্রাসার বহু ছাত্রও।

বর্তমান প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের জন্য পুরো দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এছাড়া গত ১১ এপ্রিল সন্ধ্যা ৬টা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যেই শনিবার জুবায়ের আহমেদ আনসারীর জানাজায় লাখো মানুষ অংশ নেয়ায় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কীভাবে এত লোকের সমাগম ঘটল? প্রশ্ন উঠেছে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আগাম গোয়েন্দা তৎপরতা নিয়েও। এই বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসন ও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা এখন দায়সারা বক্তব্য দিয়ে গা বাঁচাতে চাইছেন। আবার অনেকেই এই বিষয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের এড়িয়েও যাচ্ছেন। আর বিএনপি থেকে নির্বাচিত স্থানীয় সাংসদ উকিল আবদুস ছাত্তারের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বিএনপির নারী সাংসদ রুমিন ফারহানার বাড়িও ওই জেলায়। তাকেও এ ঘটনার পর কোনো বার্তা দিতে দেখা যায়নি।

তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সমাগমকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিশেষ একটি জানাজায় হাজার হাজার লোক শরিক হয়েছেন। এ সময়ে এ ধরনের জমায়েত খুবই ক্ষতিকর হয়েছে। আশঙ্কা করছি, অনেক লোক হয়তো বা আক্রান্ত হয়েছে। এ ধরনের দায়িত্বহীন কাজ হওয়া উচিত হয়নি। এখানে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

সত্যি কি প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে? জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সদর আসনের সাংসদ রা আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, মানুষের অজ্ঞতাপ্রসূত একটি কাজ হয়েছে। এই জানাজায় বাধা দিলে প্রশাসনের সঙ্গে মানুষের সংঘর্ষ হতো। আর এই সংঘর্ষে বহু প্রাণহানি ঘটত। হয়তো এ কারণে প্রশাসন বাধা দেয়নি। তবে প্রশাসনের দায় যে একেবারে নেই তা আমি বলব না। তিনি বলেন, যে এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে সেটি বিএনপির এলাকা। তাহের উদ্দিন ঠাকুরের বাড়ি। এমনিতেই ওই এলাকা প্রগতিবিরোধী। ৯০ শতাংশ লোক মাদ্রাসার ভক্ত। তিনি বলেন, নাসিরনগরের সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় যদি বিচার হতো, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাংস্কৃতিক অঙ্গনে হামলার যদি বিচার হতো; তাহলে হয়তো এলাকাটিকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা যেত। কিন্তু এখন ধর্মান্ধতায় ভরে গেছে। অশিক্ষা ও বর্বরতার হার বেড়ে গেছে। সঙ্গে এও মনে রাখতে হবে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শুধু আমরাই প্লেয়ার নই। এখানে বিএনপি আছে, হেফাজত আছে। তারা ধর্মটাকেই প্রাধান্য দেয়।

তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনসাধারণের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লকডাউনের আদেশ জারি করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসন। আর এই আদেশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব যেমন পুলিশের রয়েছে; তেমনি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনেরও রয়েছে। যতই লকডাউন থাকুক না কেন প্রখ্যাত একজন আলেম মারা গেছেন, তার জানাজায় বহু লোকের সমাগম ঘটবেই। এটা কি জেলা প্রশাসন কিংবা পুলিশ প্রশাসন জানত না? পুলিশ কেন আগে থেকে সেখানকার ধর্মীয় নেতাদের কাছে গিয়ে বিষয়টি বুঝিয়ে বলল না? পুলিশ প্রশাসন বা জেলা প্রশাসনের লোকজন গিয়ে আলেমদের বলতে পারত, দেশে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ চলছে। এই ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। জানাজায় লোক জড়ো হলে তাদের মধ্যে ভাইরাসটি ব্যাপক সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন তা তো করেইনি; বরং নীরব দর্শকের মতো পাশে দাঁড়িয়ে থেকে জানাজায় জড়ো হওয়া লোকসমাগমের দৃশ্য দেখেছে।

জানতে চাইলে আশুগঞ্জের বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা প্রিন্সিপাল শাহজাহান ফাউন্ডেশনের (পিএসএফ) প্রধান ও শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু ভোরের কাগজকে বলেন, ওই জানাজায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোক ছিল, আশপাশের জেলাগুলো থেকে শত শত গাড়ি নিয়ে লোক অংশ নিয়েছেন, মাদ্রাসার ছাত্ররা অংশ নিয়েছেন। প্রশাসন যদি আগে থেকে বুঝিয়ে বলত তাহলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। এখানে প্রশাসন সময়মতো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

তবে একথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী মো. ফরহাদ হোসেন। গতকাল রাতে মৌলবাদী চক্র ও স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষে সাফাই গেয়ে ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, তাদের স্থানীয় প্রশাসন অবশ্যই বোঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু যিনি মারা গেছেন তার ভক্ত অনুরাগীর সংখ্যা এত বেশি, বুঝিয়েও স্থানীয় প্রশাসন কোনো কুলকিনারা করতে পারেনি। সবকিছু আইন দিয়ে সমাধান হয় না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। একই মন্তব্য করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খানও। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তারা আমাদের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেননি। বর্তমানে লকডাউন পরিস্থিতি চলছে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে এবং মানুষকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। শুক্রবার তাদের এই বিষয়টি আমরা জানিয়ে দিয়েছিলাম। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন নির্ধারিত নিয়ম মেনেই সীমিত পরিসরে তাদের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করবেন। কিন্তু তারা কথা রাখেননি।

এদিকে গতকাল পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা বলেন, সরাইলের ঘটনা তদন্ত করতে চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজিকে (প্রশাসন ও অর্থ) সভাপতি করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ২২ এপ্রিলের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জানাজার ঘটনায় পর ভৈরবের ব্রহ্মপুত্র নদে অবস্থিত সেতু ও কিশোরগঞ্জ সড়কের কাছেও পুলিশের চেকপোস্ট জোরদার করা হয়েছে। কিশোরগঞ্জের ভৈরব থানার ওসি মো. শাহিন জানান, শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জানাজার ঘটনায় ভৈরবের দিক থেকে কোনো মানুষ সেখানে অংশ নেয়নি। আগে থেকে ভৈরবের মেঘনা সেতুর টোলপ্লাজায় কড়াকড়ি ছিল। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে গতকাল রবিবার থেকে আরো কঠোর করা হয়েছে বলে তিনি জানান। তবে জরুরি পণ্য, কাঁচামাল, ওষুধ, কৃষিজাত দ্রব্য, ধান কাটার শ্রমিক, অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া কোনো ধরনের যানবাহন সেতু দিয়ে প্রবেশ বা যাওয়া-আসা করতে দেয়া হচ্ছে না। এছাড়া ঢাকা-সিলেট ও ভৈরব-কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ সড়ক পথেও একইভাবে কড়াকড়ি করা হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App