×

সাহিত্য

এই পৃথিবী এই দেশ আমার অচেনা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২০, ১০:৩৪ পিএম

এই পৃথিবী এই দেশ আমার অচেনা

কথাশিল্পী নাসরীন জাহান

নাসরীন জাহান আমাদের কথনশিল্পের উল্লেখযোগ্য কথাশিল্পী। তার লেখা আমরা পড়ছি সেই আশির দশক থেকেই। তিনি গল্পের মানুষ, উপন্যাসের মানুষ, এমনকি নাটক আর লিটলম্যাগেরও মানুষ। বাংলা সাহিত্যের সেই আবহমান ধারারই লেখক তিনি, যে ধারায় মানব জীবনের আলো অন্ধকারকে স্বচ্ছ চোখে দেখা যায়। যে ধারায় বাংলা সাহিত্যের বড় লেখকরা আছেন। তাকে লেখালেখি দিয়ে এমনিতর নানাভাবে দেখা যায়। সেটা শুধু দেখাদেখির ভেতর রাখার কোনো সুযোগ নেই। কারণ তাকে দিয়ে আমরা একটা সময়কে চিহ্নিত করা যায়। সে সময়টা আমাদের মুক্তচৈতন্য চিহ্নিত করার সময়, একে বিকশিত করার সময়। এ জন্য যত ধরনের অপশক্তি আছে, তাকে নাশ করারও সময়। স্বৈর শাসনকে মোকাবিলা করার সময়। তিনি সেই সময় লিটলম্যাগের সঙ্গে যুক্ত হন। সময়টাই যেন ছিল দ্রোহের, প্রতিবাদের, প্রতিষ্ঠানকে মোকাবিলা করার। সাহিত্যের আড্ডায় তিনি মেতে থাকেন। তাকে আমরা অনেকেই ‘উড়ুক্কুর’ লেখক হিসেবে জানি, এভাবে আমরা তাঁকে আলাদাও করে থাকি। অথবা তাকে আমরা মনে রাখি। কিন্তু এই মনে রাখার ভেতর তাকে কিন্তু আমরা ভুলেও যাই। কারণ তিনি তো ‘চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার’ বা ‘এলেন পোর বিড়াল’ নামে গল্পের সিরিজই লেখেননি, নাটক লিখেছেন, টিভি নাট্যরূপ দিয়েছেন, লিটলম্যাগ আন্দোলনে ছিলেন, সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন কবিতাও লিখছেন। বহুমাত্রিক এই লেখকের করোনাকাল কেমন কাটছে ভোরের কাগজের এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, করোনাকালের প্রথমদিকে লিখতাম, পড়তাম। কিন্তু এটা আমাদের দিকে যেভাবে ধেয়ে আসছে, সেই তুলনায় এখনও মানুষের সচেতনতা কম। আমরা তো শুরু থেকেই ঘরে থেকে নিয়ম মেনে চলছি। কিন্তু আচমকা গার্মেন্টস খুলে দেয়ায় যে হাড়ে একজনের গায়ে অন্যজন ল্যাপ্টেচ্যাপ্টে হাজার হাজার মানুষ কোয়ারান্টাইনের চৌদ্দটা বাজিয়ে পেটে বাঁচার তাগিদে ঢাকায় এলো। এরপর সেদিনই মালিকরা গার্মেন্টস বন্ধ করে দিল। শ্রমিকরা ওদের হাতের পুতুল তখন থেকেই আমার ভয়ের শুরু। এরপর, এখনও ত্রাণের জন্য ভিড় করছে হাজার মানুষ। এর মধ্যে একাত্তর টিভিতে মেডিক্যাল বিশেষজ্ঞ বললেন, আমেরিকাই যেখানে হাসপাতাল নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, এ দেশের আক্রান্ত মানুষের অর্ধেকেরও কম মানুষ শনাক্ত করার মেশিন আছে আমাদের। এসব রোগীকে আলাদা করে এক রুমে রাখতে হয়। এদেশের হাসপালের বারান্দায় ভিড় করে স্বাভাবিক অবস্থায়ই রোগীরা ঘুমায়। পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে, আগামী দু’মাসে পৃথিবী করোনা যখন আয়ত্তে আনবে আমাদের প্রচুর অসচেতন মানুষের কারণে (কেউ পেটের দায়ে কেউ এখনও তোয়াক্কা না করায়) আমাদের রোগী দ্বিগুণ হাড়ে বাড়তে থাকবে, আমরা চিকিৎসা দিতে পারব না। এছাড়া দিনমজুর ছাড়াও, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত প্রায় দু’মাস বেতনহীন তারা কেমন আছে, তার খবর কে রাখে? কি লিখছেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি খুব সেনসেটিভ। ক্রমশ বিমর্ষতায় ডুবছি ভবিষ্যতের কথা ভেবে। এ অবস্থায় আমার কলম চলে না, বইয়ের অক্ষর ঝাপসা লাগে। দুপুর একটায় ঘুম থেকে উঠি। গোসল খাওয়া দাওয়া শেষে মুভিতে ঢুকি। বিকেলে আশরাফকে নিয়ে ছাদে যাই, বাম্পার ফলন সেখানে, আম লেবু সফেদা, আরও কতো কিছু। ফের দুজন মুভিতে ঢুকি। আমার বাড়িতে স্বামী, স্ত্রী বোন তাদের দুই বাচ্চা সহ একটা পরিবার থাকে। বাচ্চারা গৃহকর্মী নয়। তাই ঘরের কাজ করতে হয় না। ওরা খুব সচেতন। গৃহকর্মীরা পনেরো বছর ধরে আছে। ড্রাইভারের ডিউটি নেই, বেতন দিয়ে ছুটি দিয়েছি। গৃহকর্মীরাও এক তারিখেই বেতন পেয়েছে। আমার মেয়ে অর্চিকে বি.বি.সির কাজে রোজ অফিসে যেতে হয়। ভয়াবহ নির্জন রাস্তা দিয়ে ফিরতে এগারোটা বেজে যায়। এই নিয়ে ওর হার্ট আক্রান্ত বাবা মারাত্মক টেনশনে থাকে। আমি ভেতরে ছটফট করি। তারপরও এর ভেতর তিনটা কবিতা লিখেছি। আপনার কি মনে হয় প্রকৃতির উপর যথেচ্ছার করার কারণেই কি করোনার এই মানববিধ্বংসি আচরণ? নাসরীন জাহান বলেন, অবশ্যই প্রকৃতির প্রতিশোধ। পৃথিবীজুড়ে গাছের পর গাছ কেটে, পানিভর্তি জায়গায় মাটি বসিয়ে অট্টালিকা বানানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। এছাড়াও লাগামহীন ক্রাইম। ধনীদেশ গরীব দেশের ওপর শোষণ চালিয়েছে। এক দেশের সাথে আরেক দেশের যুদ্ধ কমার নাম নেই। হু হু করে বাড়ছিল, হত্যার পর হত্যা, গণধর্ষণ, এক বছরের শিশুর শরীরে কী থাকে? তাকেও ধর্ষণ করে খুন করে যাচ্ছিল ঠাণ্ডা মাথার বিকারগ্রস্ততা। এতো অনাচার কীভাবে সহ্য করে প্রকৃতি? সৃষ্টিকর্তার ক্রুদ্ধতার সামনে আজ মানুষ অসহায়। যেখানে পৃথিবীর বেশিরভাগেরও বেশিরভাগ দেশের কয়েকটা দেশের কাছে চলে যায়, পাওয়ার আর সম্পদ, তখন পৃথিবীর প্রকৃতিতে কীভাবে ভারসাম্য থাকে? আজীবনের আশাবাদী মানুষ আমি যে শত্রুকে চোখে দেখা যায় না, যার চিকিৎসা আবিস্কৃত হয়নি, কীভাবে লড়বে মানুষ। তাও পৃথিবীর বড় স্পেশালিস্টরা নিজেকে এ থেকে রক্ষা করতে যেসব নিয়ম পালনের কথা বলেছেন,তা মেনে মেনে ধনী দেশগুলো একটা বিন্যস্ততায় এলেও আমাদের দরিদ্র, মূর্খ অসচেতন মানুষের দেশের কী ভবিষ্যৎ? এদেশের প্রচুর গ্রামের মানুষরা ভাবে, করোনা আবার কী? ওটা দূরে, ঢাকায়। তারা আগের মতোই পানবিড়ি ভিড়ের জগতেই আছে। সরকার যদি গার্মেন্টস মালিক, না শ্রমিকদের সহ, চাকরিজীবীদের বেতন বন্ধ থাকা অবস্থাই ভাগ করে করে বিকল্প ব্যবস্থায় কর্মীদের দেওয়ানোর ব্যবস্থা করতো, দিন মজুরদের তালিকা তৈরী করে ঘরে ঘরে ত্রাণ পাঠানোর ব্যবস্থা করতো, তবে বলতাম, কারফিউ দিয়ে দিন। এদেশের শহরের গলিতে গলিতে এখনও মুদির দোকানের সামনে আড্ডারত পোলাপানদের সরাতে পুলিশ স্বাস্থ্যকর্মীরা হিমশিম খাচ্ছে। কী বলব? এমন চলতে থাকলে এই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী কী কথা বলবো? ভবিষ্যৎ ভেবে অসহায় বোধ করি। এই করোনাসংকট কিভাবে মোকাবেলা করবে সরকার। আপনার পরামর্শ কি? এর জবাবে বিশিষ্ট এই কথাশিল্পী বলেন, সরকার একা নয়, উচ্চবিত্ত প্রচুর লোক, মন্ত্রী, আমলা, যাদের অনেকেই গরীবের টাকা মেরে শত হাজার কোটি নিয়ে বসে আছে, এই অবস্থায় তারাও তুমুলভাবে এগিয়ে আসুক। কী এগুবে এরা? এই অবস্থায়ও অসভ্য মানুষ নামের অমানুষগুলো, ত্রানের মাল মেরে খাচ্ছে? এই আমার সোনার বাংলা? আমার ছোটবোন ঝর্নার এক বিধবা বান্ধবী, যার এখনকার বাস্তবতায় বড় মেয়ের অনলাইনে পড়ানো, একমাত্র উপার্জনের পথ। তার আরও দু’সন্তান আছে। পড়ে। ঝর্না একসময় যতটা পেরেছে, করেছে। আমিও। দীর্ঘদিন তারা লকডাউনে আছে। স্রেফ আলুর সাথে মরিচ ভর্তা খাচ্ছে। সাহায্যের লিস্ট নিয়েছিল সরকার পক্ষের লোক। ২০ দিন হয়ে গেলো সাহায্যের খবর নিয়েছে। দিন মজুরদের চেয়ে এই নিম্নবিত্তের অবস্থা কী ভালো? ঘরে বসে বসে কী করছেন? নাসরীন জাহান বলেন, সন্ধ্যায় খবর দেখি, গানের প্রতিযোগিতা, ক্রাইম পেট্রোল দেখি। পায়চারি করি। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি রোজ, এ থেকে দেশব্যাপী, বিশ্বব্যাপী মানুষকে উদ্ধার করার। করোনার কারণে পরিপার্শ্ব বদলে যাচ্ছে বলে মনে করেন? অবশ্যই। তা কেমন? তিনি বলেন, নিজের বাড়িতে যারা আছি, তা ছাড়া যেদিকেই তাকাই, বিশ্বের খবর রাস্তাঘাট মনে হয়, বাজ পড়ার মতো আচমকা আমরা পৃথিবী নামের গ্রহ ছেড়ে অন্যগ্রহে এসে পড়েছি। যুদ্ধ হলে তারও একটা শেষের প্রত্যাশা করে মানুষ। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর নেই বলে, সেখানে অনেক মানুষের মৃত্যু হবে। সেখানে পৃথিবীর সহস্র কোটি ভাইরাসের এক কণাও যেদিন পৃথিবীতে থাকবে, পৃথিবীর মুক্তি নেই। খাঁ খাঁ করছে শহর। আর ঘরেই কী আগের মতো দিন কাটছে? সন্তানকে জড়িয়ে ধরতে পারছি না (যা চিরদিনের অভ্যাস) আমার গৃহকর্মীর দু’বছরের মেয়েটি মা মা বলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় বুকে, মা মেয়ের বাঁচার স্বার্থে মেয়েকে সরিয়ে দেয়। আর নিরন্তর আতংক। আজীবন শুনেছি একের বিপদে অন্যে তার পাশে এসে দাঁড়াও, এখন বলা হচ্ছে, একজনের সাথে আরেকজন, এক দেশের সাথে আরেকদেশ যত দূরে থাকবে, ততই নিরাপদ। চার্লস, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, কানাডার মন্ত্রীর স্ত্রী হাজার সাবধানতায়ও যেখানে আক্রান্ত, স্বার্থপরের মতো নিয়ম ভেঙ্গে এখনও এ দেশের অলিগলি বাজারে ভিড় দেখলে ভয়ার্ত যৌক্তিক মনও বলে, আমরা মহামারির দিকে এগোচ্ছি। একসাথে একটি রোগ নিয়ে সারা পৃথিবীর ভাবনা, আতংক কল্পনাও কেউ করেছে? বাসার সামনে এখনও মাছ, সবজি রাখি, হাজার সাবধানতায়। এর মধ্য দিয়ে আমার ঘরে ভাইরাস ঢুকবে না কী গ্যারান্টি। আগেই বলেছি, আশাবাদী মানুষ আমি নিজের জন্য না, সন্তানের কথা ভেবে আঁতকে উঠি। যার চিকিৎসা পৃথিবীর বিশাল বিশাল চিকিৎসক প্রাণপণ চেষ্টায়ও আবিষ্কার করতে পারছে না, এই পৃথিবী এই দেশ আমার অচেনা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App