×

প্রবাস

প্রবাসীদের ফেরাতে চাপ দিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য

Icon

nakib

প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল ২০২০, ১০:৪৬ এএম

করোনা ভাইরাসের কারণে প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে যারা অবৈধ, রোজ বা সপ্তাহের ভিত্তিতে কাজ করতেন এবং যারা বিভিন্ন অপরাধে জেলে আছেন তাদের স্বভূমে ফিরিয়ে নিতে চাপ দিচ্ছে বিভিন্ন দেশ। এরমধ্যে সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন নিজেরা উদ্যোগী হয়ে তাদের টাকায় বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠাতে ফ্লাইট পর্যন্ত প্রস্তুত করে ফেলেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার রাজি না হওয়ায় ফ্লাইটগুলোকে আপাতত আকাশে উড়ানো থেকে ঠেকানো গেছে। তবে লেবানন আর্থিক সংকটে পড়ায় সেখান থেকে শ্রমিকরা এমনিতেই ফিরে আসছেন। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও ধনী দেশগুলোর মধ্যে ব্রিটেন, স্পেন, জার্মানি, ইতালি, কানাডা ও জর্জিয়া থেকে বহু বাংলাদেশি সেখানে খাবার পাঠানোর জন্য সরকারের ওপর আরেক ধরনের চাপ তৈরি করেছেন। মালদ্বীপও তাদের দেশ থেকে বাংলাদেশিদের ফেরত আনার বিষয়ে চাপ দিচ্ছে। তবে দেশটিতে ১০০ টন চাল পাঠিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ সরকার। সবমিলিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশি এবং শ্রমিকদের নিয়ে ভীষণ চাপে আছে শেখ হাসিনা সরকার। প্রাণঘাতী করোনার কারণে ওই দেশগুলোয় সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে যারা রোজ বা সপ্তাহের ভিত্তিতে কাজ করতেন তারা পড়েছেন মহাসংকটে। অনেকের নিয়োগকর্তা বেতন, খাদ্য, বাসস্থান, ওষুধ ইত্যাদি দিলেও যাদের নির্দিষ্ট নিয়োগকর্তা নেই, বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছেন, তাদের আয় শূন্য। অবৈধ হওয়ার দেশগুলোর সরকার থেকে তারা খাবারও পাবেন না। এ অবস্থায় দেশগুলোর সরকার তাদেরকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দিতে চাপ দিচ্ছে। পাশাপাশি যারা অবৈধ ছিলেন তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছে দেশগুলোর সরকার। এরপরও যদি তাদের ফেরত আনা না হয় তবে বাংলাদেশকে কালো তালিকাভুক্ত করার হুমকি দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ভোরের কাগজকে বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক এবং জেলে থাকা বাংলাদেশিদের ফেরত নিতে বারবার তাগাদা দিচ্ছে। তাদের এখনই নিজ খরচে ফেরত পাঠাতে দেশগুলো ফ্লাইট পর্যন্ত প্রস্তুত করেছে। আপাতত ফ্লাইটগুলোর অনুমতি না দিয়ে আমরা বলেছি, একসঙ্গে আমরা এতলোক আনতে পারব না। ধাপে ধাপে আনব। কারণ তাদেরকে এনে কোয়ারেন্টাইন করতে হবে। আমাদের এত জায়গা নেই যে, একসঙ্গে তাদের কোয়ারেন্টাই করতে পারব। বরং তোমরা কোয়ারেন্টাইন করে দাও। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো রাজি হচ্ছে না। সবমিলিয়ে বিষয়টি একটু জটিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা সংকটের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে তেলের দাম পড়ে গেছে। ব্যবসা বন্ধ। পরিস্থিতি খুবই খারাপ। এই অবস্থায় সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বলছে, দেশগুলোতে ডে লেবারদের (ছুটা শ্রমিক) যেহেতু কাজ নেই তাদেরকে ফিরিয়ে নিতে হবে। একইসঙ্গে অবৈধ বাংলাদেশি কিংবা অপরাধী হয়ে জেল খেটেছেন তাদেরকেও ফিরিয়ে নিতে হবে। দেশগুলো বলছে, যেসব দেশ অবৈধ শ্রমিকদের এখন ফেরত নেবেনা ভবিষ্যতে তাদের দেশ থেকে আর কোনো শ্রমিক পাঠাতে পারবে না। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার কুয়েতে চিকিৎসকসহ চিকিৎসা উপকরণ পাঠিয়েছিল। যাতে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেয়া যায়। কিন্তু তাতেও কুয়েতের মন গলেনি। শ্রমিকদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য তারা নিজেরাই নিজেদের টাকায় আজ ১৮ ও কাচল ১৯ এপ্রিল দুটো ফ্লাইট প্রস্তুত করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাতে রাজি না হয়ে বলেছে, আমরা এভাবে শ্রমিক নেব না। ধাপে ধাপে নেব। তাতে কুয়েত সরকার মনোক্ষুণœ হয়েছে বলে জানা গেছে। এই ইস্যু নিয়ে একটি সংকট তৈরি হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতও দু’দফায় অবৈধ বাংলাদেশি ও জেল থাকা বিভিন্ন অপরাধে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে নিতে বলছে। জবাবে বাংলাদেশ সরকার বলছে, আমরা একসঙ্গে এত লোক এনে কোয়ারেন্টাইনে রাখতে পারব না। তারচে আমরা টাকা পাঠাচ্ছি, ওখানেই তাদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন করার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু তাও সংযুক্ত আরব আমিরাত শুনছে না। বাহরাইনেও একই অবস্থা। সৌদি আরব বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য শোনার পর ওইভাবে আর চাপ দিচ্ছে না। তবে আকারে ইঙ্গিতে বাংলাদেশ সরকারকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, দ্রুত লোক ফেরত নিতে। অবশ্য গত ১৫ এপ্রিল সৌদি আরব থেকে কিছু বাংলাদেশি ফেরত এসেছেন। লেবানন ওইভাবে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিচ্ছে না। কারণ দেশটির অর্থনীতির অবস্থা খারাপ থাকায় বাংলাদেশিরা আগেই ফেরত চলে এসেছেন। যারা রয়েছেন তাদের সংখ্যা খুবই কম। ১০০ টন খাদ্য সহায়তা পাঠানোর পর মালদ্বীপ সরকার অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরত নেয়ার কথা বলছে না। তবে দেশটিতে থাকা ৩৮ হাজার বাংলাদেশি দেশে ফেরার জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন। এই ৩৮ হাজার বাংলাদেশি সেখানে ছুটা কাজের লোক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এখন সব বন্ধ থাকায় তাদের কাজ নেই। মালদ্বীপ সরকার দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য তাদের নিবন্ধন করিয়েছিল। এই নিবন্ধেনের জেরেই তারা বাংলাদেশ সরকারকে বলছে, কাজ নেই, কর্ম নেই-বেকার বসে আছি। আমরা দেশে ফিরতে চাই। প্রবাসে থাকা বাংলাদেশি শ্রমিকদের যখন এই অবস্থা তখন ধনী দেশ হিসেবে পরিচিতি ব্রিটেন, স্পেন, জার্মানি, ইতালি, কানাডা ও জর্জিয়ায় থাকা বেশ কিছু বাংলাদেশি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করে খাদ্য সহায়তা দেয়ার দাবি তুলেছে। তারা নিজেদের ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ দাবি করে বলেছেন, দেশে মুক্তিযোদ্ধারা ভাতা পেলে আমরা পাব না কেন? আমরা এতদিন দেশে টাকা পাঠিয়েছি। এখন আমরা বিপদে, খেতে পারছি না-সরকার আমাদের এই দুর্দিনে কেন পাশে দাঁড়াবে না। কেন খাদ্য সহায়তা দেবে না? এসব বিষয় নিয়ে চলতি মাসের শুরুর দিকে, ঢাকায় আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে বিশদ আলোচনা হয়। বৈঠকে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমেদ। বৈঠকে কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ থেকে বাংলাদেশিদের ফিরিতে আনতে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। ওই বৈঠকে দেশগুলোতে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাসে শ্রমিকদের জন্য টাকা পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত মেনে ২৪টি দূতাবাসে টাকাও পাঠানো হয়েছে। তবে মালদ্বীপ ও সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশিদের ফেরানোর বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি ঢাকা। মালদ্বীপে প্রায় ৩৮ হাজার বাংলাদেশি অবৈধ। করোনার কারণে তারা এখন কর্মহীন অবস্থায় রয়েছেন। সিঙ্গাপুরে কয়েকশ বাংলাদেশি অবৈধ। সূত্র বলছে, কঠোর নিয়মের দেশ সিঙ্গাপুর থেকেও অবৈধদের ফেরাতে হবে। তবে সেক্ষেত্রে হয়তো সময় নেয়া যাবে। বর্তমান বৈশ্বিক মহামারি কাটিয়ে ওঠা পর্যন্ত সময় নিতে চায় বাংলাদেশ। সূত্র জানায়, করোনা ভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য সরকার, বায়রা, বিদেশি স্টেকহোল্ডাররা একসঙ্গে কাজ করছে। ইতোমধ্যে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে। ওই কমিটি সুপারিশ করেছে, কোনো শ্রমিক দেশে ফিরে এলে তাকে নগদ ৫ হাজার টাকা দেয়া হবে। এ ছাড়াও তাকে সুরক্ষা দিতে যা যা প্রয়োজন তা সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হবে। কিন্তু তার আগে শ্রমিক ফিরিয়ে আনতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যে চাপ দিচ্ছে সেই চাপ মোকাবিলার কৌশল খুঁজছে সরকার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App