×

জাতীয়

চূড়ান্ত পর্যায়ে সংক্রমণ!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২০, ০৯:৪০ এএম

চূড়ান্ত পর্যায়ে সংক্রমণ!

করোনাভাইরাস।

২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু ১০, আক্রান্ত ৩৪১ ,প্রতি ১০০ জনে ১৬ জন সংক্রমিত, রাজধানীর ১৬ এলাকা রেড জোনে

নমুনা পরীক্ষা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ব্যাপকতাও চূড়ান্ত মাত্রায় উন্নীত হচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাবে- এমনই আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। একই সঙ্গে বাড়বে মৃত্যুর সংখ্যাও। এ অবস্থায় সারাদেশকে করোনা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। উল্লেখ্য, গতকাল নমুনা সংগ্রহের পরিমাণ বেড়েছে ৪ শতাংশ আর নমুনা পরীক্ষা বেড়েছে ১৬ শতাংশ। ঠিক এরকম পরিস্থিতিতে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ স্বাক্ষরিত এক আদেশে বলা হয়, ‘পুরো বাংলাদেশকেই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা’ ঘোষণা করা হয়েছে। জানতে চাইলে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা দেখছি দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই ভাইরাসের সংক্রমণ হু হু করে বাড়ছে। এ অবস্থায় সংক্রমণ যাতে তীব্রভাবে ছড়াতে না পারে এবং সবাই যাতে ঘরে থাকে সেজন্য সংক্রমণ আইনে মহাপরিচালক দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, সংক্রমণের তীব্রতা লক্ষ্য করে আমরা নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়িয়েছি। যাতে দ্রুত সংক্রমণের চিত্র জেনে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে পারি। বিশ্লেষণে জানা গেছে, গত ১১ এপ্রিল যেখানে দেশে ৫৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিলেন সেখানে এর ৫ দিন পর এসে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত রোগীর সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়ে গেছে। শুধু গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ২০১৯টি। এর বিপরীতে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৩৪১ জন। আর মারা গেছেন ১০ জন। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জনে ১৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এর আগের দিন প্রতি ১০০ জনে ১২ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। তারা বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, আর তাতেই একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা পাওয়া গেছে। আগামী কয়েকদিনে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা আরো বাড়ানো হবে। এতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাও বেড়ে যাবে। দেশে ঠিক কতজন করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন- তার চিত্র পাওয়ার জন্যই পরীক্ষা বাড়ানো হচ্ছে। এতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার খবর শুনে মানুষের মন খারাপ হবে, তবে কিছুই করার নেই। মানুষকে এ সময় অবশ্যই ঘরে থাকতে হবে। জানতে চাইলে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির সদস্য ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, আমার ব্যক্তিগত ধারণা হচ্ছে- পরবর্তী দুয়েকটা দিনে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো হবে এবং এতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। আর এর মাধ্যমে দেশে করোনা সংক্রমণের একটা চিত্র পেয়ে যাব। এরপর থেকে প্রকোপটি কমে আসবে বলে মনে করছি। তিনি বলেন, দেশে করোনা যা ছড়ানোর ছড়িয়ে গেছে। ফলে এখন আর বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নিয়েও লাভ নেই। পরীক্ষা বাড়িয়ে সংক্রমণের

চিত্রটা জানাই এখন উত্তম। তবে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ পেতে সবাইকে আবারো ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তবে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নমুনা পরীক্ষা অনুপাতে যে হারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে তা উদ্বেগজনক। মৃত্যুর হারও বেশি। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছিলেন। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ৪৯ জন। আর মারা গেছেন ৬০ জন। জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্যবিদ ও বিএমএর সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব ভোরের কাগজকে বলেন, সারাদেশের সঠিক চিত্র জানার জন্য এখন পরীক্ষা বাড়ানো হয়েছে। এতে কত লোক আক্রান্ত হচ্ছে তা জানা যাবে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে এখানে রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে। আক্রান্ত হওয়াদের মধ্যে ৮০ শতাংশই ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে থেকে সুস্থ হয়ে যাবে। বাকি ২০ শতাংশের মধ্যে ১০ শতাংশের হাসপাতাল ও ১০ শতাংশের আইসিইউর চিকিৎসা প্রয়োজন হবে। ২৪ ঘণ্টায় মৃতের সংখ্যা দুই অঙ্কে : দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে করোনা ভাইরাসে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৬০ জনে। একদিনে নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছেন আরো ৩৪১ জন। এনিয়ে করোনায় মোট শনাক্ত হলেন ১ হাজার ৫৭২ জন। গত কয়েকদিনের ধারাবাহিকতায় বেড়েছে মৃত ও শনাক্তের সংখ্যা। তবে এই প্রথম দেশে একদিনে মৃতের সংখ্যা দুই অঙ্কে পৌঁছাল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত স্বাস্থ্য বুলেটিনে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে দেশের কোভিড-১৯ সম্পর্কিত সার্বিক যে পরিস্থিতির বর্ণনা দেন তাতে এসব চিত্র উঠে আসে। নতুন ১০ জন মৃতের বিষয়ে তিনি বলেন, পুরুষ ৭ জন এবং নারী ৩ জন। তাদের মধ্যে ঢাকায় রয়েছেন ৬ জন এবং ঢাকার বাইরে ৪ জন। মারা যাওয়াদের মধ্যে ৫ জনের বয়স ৬১ থেকে ৭০ এর মধ্যে আর ৩ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০র মধ্যে। বাকি দুজনের একজনের বয়স ৭১ থেকে ৮০র মধ্যে এবং আরেকজনের বয়স ২১ থেকে ৩০র মধ্যে। এদিকে আইইডিসিআরের ৬ কর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্তরা মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। এ ঘটনার পর প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাসহ সব কর্মকর্তা কোয়ারেন্টাইনে আছেন। গাজীপুরের কাপাসিয়া ও কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৫ চিকিৎসকসহ ২৪ স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর থানার ১০ পুলিশ সদস্যের নমুনা পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তদের দুজন সহকারী উপপরিদর্শক ও ৮ জন কনস্টেবল বলে জানিয়েছেন থানার উপপরিদর্শক নব কুমার।

রাজধানীর ১৬ এলাকা করোনার ‘রেড জোন’ : এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষ (৬০৮ জন) শনাক্ত হয়েছেন ঢাকা মহানগরীতে। এ পর্যন্ত ঢাকা মহানগরের ১০৫টি এলাকায় করোনা সংক্রমিত হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর ১৬ এলাকাকে করোনা ভাইরাসের ‘রেড জোন’ চিহ্নিত করা হয়েছে। আইইডিসিআরের তথ্যানুযায়ী, ঢাকার ওই ১৬ এলাকা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা লকডাউন করেছে প্রশাসন। আইইডিসিআরের তথ্যানুযায়ী, রাজধানীতে ১০ জনের বেশি করোনা আক্রান্তের মধ্যে ওয়ারীতে ২৬, মোহাম্মদপুরে ২০, টোলারবাগে ১৯, যাত্রাবাড়ীতে ১৯, ধানমন্ডিতে ১৮, লালবাগে ১৮, উত্তরায় ১৭, তেজগাঁওয়ে ১৬, বাসাবোতে ১৪, গেন্ডারিয়ায় ১৩, মগবাজারে ১০, মহাখালীতে ১০, মিরপুর ১১ তে ১১, মিরপুর ১২তে ১০, গ্রিন রোড-১০ ও বাবুবাজারে ১১ জন রোগী আছেন। এছাড়া বনানী, গুলশান, বাড্ডা, আজিমপুর, আদাবর, নাখালপাড়া, রাজারবাগ, ঝিগাতলাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। যা দেশের মোট রোগীর ৪৫ শতাংশের বেশি।

যেসব জেলা সবচেয়ে বেশি সংকটে : গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশের ৫১ জেলায় করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্তের খবর জানায় আইইডিসিআর। এর মধ্যে শুধু ঢাকা মহানগরেই সংক্রমিত হয়েছেন ৬০৮ জন। আর ঢাকা বিভাগের অন্য জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২১৪ জন শনাক্ত হয়েছেন নারায়ণগঞ্জে। ঢাকা জেলায় ২৬, নরসিংদীতে ৪৩ এবং মুন্সীগঞ্জে ২৬ জন শনাক্ত হয়েছেন। গাজীপুরে ৯৮, মাদারীপুরে ২৩ ও কিশোরগঞ্জে ২২ জন সংক্রমিত হয়েছেন। এছাড়া গোপালগঞ্জে ১৭ এবং টাঙ্গাইলে ৯ জন সংক্রমিত বলে শনাক্ত করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের চট্টগ্রাম জেলাতেই ৩৬ জন শনাক্ত হয়েছেন। এছাড়া কুমিল্লায় ১৪ জন এবং চাঁদপুরে ৭ এবং ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় ৮ জন শনাক্ত হয়েছেন। বিভাগের অন্য জেলাগুলোতেও এক-দুজন করে সংক্রমিত হয়েছেন। রংপুর বিভাগের গাইবান্ধায় ১৩ এবং দিনাজপুরে ৮ জন সংক্রমিত হয়েছেন। বিভাগের অন্য জেলাগুলোতেও সংক্রমিত আছেন। ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুরে ১২ জন শনাক্ত হয়েছেন। বরিশাল জেলায় ১২ জন। রাজশাহীতে শনাক্ত হয়েছেন ৪ জন। দেরিতে হলেও করোনার চিকিৎসা শুরু হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে : দেরিতে হলেও করোনা টেস্ট ও চিকিৎসা শুরু করতে যাচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল। বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক মালিকদের সংগঠন বিপিসিডিওএ জানিয়েছে দুই সপ্তাহের মধ্যে ১২শ শয্যা নিয়ে কোভিড-১৯ রোগীদের সেবা দেয়া শুরু করবে রাজধানীর দুটি হাসপাতাল। আর সরকারের অনুমতি ও কিট হাতে পেলে শিগগিরই পরীক্ষা শুরু করবে ল্যাবএইড ও শমরিতা হাসপাতাল। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার পরীক্ষা, চিকিৎসার ফি নির্ধারণ ও মনিটরিং করতে হবে সরকারকে। বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক ওনার্স এসোসিয়েশন বিপিসিডিওএর তথ্য মতে, দেশে বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৭ হাজার। যাতে আইসিইউ সুবিধা আছে প্রায় ৫০০০ বেডের। সংগঠনটি বলছে, আগামী দুসপ্তাহের মধ্যে করোনা রোগীদের চিকিৎসা শুরু করবে রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন ও শাহাবুদ্দিন মেডিকেল। যাতে প্রস্তুত আছে ১২শ শয্যা। আরো ৫টি বেসরকারি হাসপাতাল প্রস্তুত হচ্ছে জানিয়ে বিপিসিডিওএর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভুইয়া বলেন, যদি আমরা ২টা দেই, ২টার পরে ৩টা, তারপরে ৪টা এভাবে ক্রমান্বয়ে প্রয়োজন অনুসারে বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। করোনা টেস্টের জন্য পিসিআর মেশিনের প্রয়োজন হয়। ল্যাবএইডে ও শমরিতায় একটি করে পিসিআর মেশিন রয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তারা প্রস্তুত আছে। কিট পেলেই তারা পরীক্ষা শুরু করে দিতে পারবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App