×

পুরনো খবর

করোনাযুদ্ধে সঠিক তথ্য দিতে হবে মানুষকে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২০, ০৬:০৬ পিএম

করোনাযুদ্ধে সঠিক তথ্য দিতে হবে মানুষকে

প্রতীকী ছবি

করোনাযুদ্ধে সঠিক তথ্য দিতে হবে মানুষকে

ইউশা রহমান

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘একটি তুলসি গাছের কাহিনী’ গল্পটির কথা মনে পড়ে যায়। সেখানে ইউনুস নামের এক চরিত্র ছিলো। রোগাটে ইউনুস থাকতো ম্যাকলিওড স্ট্রিটে। রাস্তাটি ছিলো সকাল বেলার আবর্জনা ভরা ডাস্টবিনের মত। আবার চামড়ার উৎকট গন্ধে এতটাই ভরপুর ছিলো যে ড্রেনের পচা দুর্গন্ধও নাকে এসে পৌঁছাতো না। তবুও ইউনুস একটা কারণে পাড়া ছেড়ে যায় নি। কেউ একজন তাকে বলেছিলো, চামড়ার গন্ধ নাকি যক্ষ্মার জীবাণু ধ্বংস করে।

কথাটি ইউনুস ভালোমতই বিশ্বাস করেছিলো। তাই সুস্বাস্থ্যের আশায় দুর্গন্ধময় বাতাসেই বুকভরে নিঃশ্বাস নিতো সে। ইউনুস যেভাবে কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই অন্ধবিশ্বাস নিয়ে বসে ছিলো তা যেন আমাদের সমাজেরই বাস্তব চিত্র। সামাজিক পরিসরে এ ধরনের ভুল বা অবৈজ্ঞানিক বার্তা আমরা অহরহই দেখি। বৈশ্বিক দুর্যোগ পরিস্থিতিতে ভুল তথ্য দ্বারা প্রভাবিত হলে অঘটন ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

স্বাভাবিক কারণেই বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে করোনা মানুষের আলোচনা ও চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সামাজিক পরিসরে মানুষ বিভিন্ন উপায়ে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে অনেকক্ষেত্রে মানুষ গল্পচ্ছলে বা হেসেখেলেই বিভিন্ন বার্তা বা তথ্য তৈরি করছে। সেগুলো সহজে ছড়িয়েও পড়ছে সমাজে। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, মুখে মুখে বা প্রযুক্তির ব্যবহারে অনেকে সেগুলো ছড়াতে ভূমিকা রাখছে।

এ বার্তাগুলো আবার কিছু মানুষ সহজেই বিশ্বাস করছে এবং তাদের আচরণে এ তথ্যগুলোর প্রভাব পড়ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এ প্রভাব যে কোনোভাবেই ইতিবাচক নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বৈশ্বিক মহামারির ইতিহাসগুলো যদি আমরা পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখা যাবে সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে ভুল ও অবৈজ্ঞানিক তথ্য বিপর্যয়ের মাত্রা অনেকটাই বাড়িয়েছে।

অন্তত এতটুকু সবাই স্বীকার করি কোভিড-১৯ নিয়ে সামাজিক পরিসরে উৎপাদিত এসব বার্তা গবেষণানির্ভর নয়। তাই সঠিক তথ্য জানতে হলে কোনো অনুমাননির্ভর বার্তা গ্রহণ না করে বরং নির্ভরযোগ্য সূত্রের মুখাপেক্ষী হতে পারি। অনুমাননির্ভর বা ভুল বার্তাগুলো আবার অনেকক্ষেত্রে মানুষের বিভিন্ন আচরণকে বৈধকরণের কাজ করছে। এটা অনেকটা মনকে প্রবোধ দেয়ার মতই।

আমাদের দেশের তাপমাত্রায় করোনা ভাইরাস ছাড়াবে না বা আমাদের সুনির্দিষ্ট এই এই আচরণে রোগটি ছাড়াবে না এ ধরনের কিছু অমূলক কথা। কিন্তু এ প্রবোধ দিয়ে এ বড় সংকট থেকে মুক্তি মিলবে? যেখানে অধিকাংশ তথ্যই বিজ্ঞাননির্ভর তথ্যগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে তথ্য গ্রহণ ও প্রচার করা সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করতে হবে।

সামাজিক পর্যায়ে তথ্যের এ বিশৃঙ্খলা দূর করে মানুষের কাছে সুগঠিত ও সঠিক তথ্য পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু ও সমন্বিত যোগাযোগ। সবচেয়ে এক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ কাজটা রাষ্ট্রই করে থাকে। সুষ্ঠু যোগাযোগের মাধ্যমে মানুষের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেয়া, গুজব বা ভুল তথ্যগুলো চিহ্নিত ও খণ্ডন করা, তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করা এবং আচরণে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ থাকে। এ ধরনের সংকটের সময় মানুষের আচার-আচরণের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এবং সঠিক পথে পরিচালিত করতেও যোগাযোগের ভূমিকা অনন্য।

সুষ্ঠু ও সমন্বিত যোগাযোগ জনগণের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গা বাড়াতে সহায়তা করে। অন্যদিকে জনগণকে সময়মত সঠিক আচরণে উদ্বুদ্ধ করতে না পারলে বিপর্যয়ের মাত্রা অনেক বেড়ে যেতে পারে যা দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে।

এক্ষেত্রে জ্ঞানের প্রয়োজনীয় শাখাগুলোর সমন্বয় যোগাযোগ প্রক্রিয়াকে সমৃদ্ধ করতে সক্ষম। সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞদের কাজের সমন্বয় সাধন এবং গবেষণানির্ভর তথ্য ও যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ কথা সত্য যে বাংলাদেশ আগে এত বড় সংকটের মধ্যে পড়ে নি।

সংকট মোকাবেলায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নানামুখী কার্যক্রম পুরোদমেই চলছে। যেহেতু নীতিনির্ধারক, জনগণ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তঃসম্পর্কিত তাই এক্ষেত্রে সঠিক সমন্বয়ের দিকে গুরুত্ব দিলে সফলতার মাত্রা নিঃসন্দেহে বাড়বে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের রূপকল্পে গতিশীল, অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ তথ্যপ্রবাহ ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছে। এটি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে।

জনগণের কাছে কোন কোন মাধ্যমে তথ্য বা বার্তা পৌঁছালে সর্বাধিক কার্যকরী তা যথাযথ প্রক্রিয়ায় নির্ণয় করতে হবে এবং সেভাবে অগ্রসর হতে হবে। এ অঞ্চলের মানুষের আচার ব্যবহার, সামাজিক কাঠামো ও যোগাযোগের ধরন ভালোভাবে বিবেচনায় নিলে নিঃসন্দেহে যোগাযোগের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পাবে। কারণ যোগাযোগ ও সংস্কৃতির আন্তঃসম্পর্ক অনেক গভীর।

যোগাযোগের সঠিক পরিকল্পনা তৈরির পাশাপাশি পরিকল্পনাটির কার্যকরিতা মূল্যায়ন খুব বেশি প্রয়োজন। কোনো সুনির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে তা কতটুকু কার্যকরী হচ্ছে তা বোঝার মাপকাঠি মূল্যায়ন। এক্ষেত্রে জনগোষ্ঠীর সবার কাছে তথ্য ঠিকমত যাচ্ছে কিনা, জনগণ তথ্য কীভাবে নিচ্ছে, তথ্য বা বার্তা যথেষ্ট অর্থবোধক হচ্ছে কিনা বা এর প্রভাব কেমন পড়ছে- এ বিষয়গুলো জানা যাবে নিয়মিত মূল্যায়নে। আবার মনে রাখতে হবে দুর্যোগ পরিস্থিতিতে জনগণকে শুধু জানানো নয়, আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণেরও প্রয়োজন পড়ে। এক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রভাবিত করার বিকল্প নেই।

[caption id="attachment_215214" align="alignleft" width="227"] ইউশা রহমান[/caption]

আমরা জানি বৈশ্বিক মহামারি পরিস্থিতি বারবার এবং দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। আবার ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এর আচরণের ভিন্নতাও পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এবং প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে যোগাযোগ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। যোগাযোগ সফল হতে আমাদের সাংস্কৃতিক কিছু বাধা আছে এটা স্বীকার করে নিতে হয়। কিন্তু সমন্বিত প্রচেষ্টার যাতে ঘাটতি না থাকে সেটা নিশ্চিত করাই এখন কর্তব্য।

  লেখক: যোগাযোগ গবেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App