জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে গত শনিবার (১১ এপ্রিল) দিনগত রাতে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে যান কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের বেডফোর্ড লেনের বাসিন্দারা। তাদের সেই শিক্ষকমশাই বঙ্গবন্ধুর খুনি! এতদিন তাহলে আত্মগোপনে ছিলেন এখানে? পার্ক স্ট্রিটের বেডফোর্ড লেনে খুনি মাজেদের আত্মগোপনের সেই রহস্যময় ঘটনা নিয়ে কলকাতার গণমাধ্যম বর্তমান পত্রিকার অনুসন্ধানীমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এরপরই বাংলাদেশেও জানাজানি হয় মাজেদের আত্মগোপনের চাঞ্চল্যকর খবর। মঙ্গলবার (১৪ এপ্রিল) প্রকাশিত হয়েছে সেই প্রতিবেদনটির দ্বিতীয় পর্ব। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজন খুনি মাজেদকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন অজ্ঞাতস্থানে। এক ঝলক দেখলে যে কেউ ভুল করে তাদের কাবুলিওয়ালা ভাববেন। ষণ্ডামার্কা চেহারা, গালে ঘন কালো চাপ দাড়ি, ব্যাক ব্রাশ করা চুল। একজনের পরনে ডেনিম জিন্স আর নীল ফুল হাতা টি-শার্ট। অন্যজনের গায়ে বড় চেক শার্ট। দু’জনের হাতেই মোবাইল ফোন। কলকাতা বিভিন্ন স্থানে পাওয়া সিসিটিভির ফুটেজে নাকি এমনই দেখা গেছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, সিসিটিভির ফুটেজ ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা ৪ মিনিটে বেডফোর্ড লেনের ভাড়া বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর একটি ওষুধের দোকানে গিয়েছিলেন মাজেদ। সেখানে মিনিট আটেক কাটানোর পর ঠিক ১০টা ১২ মিনিটে যখন রিপন স্ট্রিটের দিকে মুখ করে ফের পথ চলতে শুরু করেন, তখন থেকেই তাকে অনুসরণ করা শুরু করে ওই দুই ব্যক্তি। পরে তাদের সঙ্গে আরও দু’জন যোগ দেন। মোট চারজন সেদিন পিছু নিয়েছিলেন মাজেদের। সিসিটিভি’র ফুটেজে সবার ছবিই ধরা আছে। তদন্তে নেমে পুলিশ ও এসটিএফ-এর অফিসাররা পিছু নেয়া ওই ষণ্ডামার্কাদের কাবুলিওয়ালা ভেবে প্রথমে ভুল করেছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আলিমুদ্দিন স্ট্রিট ধরে এসে রাস্তা পার হয়ে এজেসি বোস রোডে আসেন মাজেদ। উদ্দেশ্য, বাস ধরা। গন্তব্য পিজি হাসপাতাল। এর পরের ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, ওই চারজন মাজেদের সঙ্গে কথা বলছে। তবে ক্যামেরা উন্নত না হওয়ায় কী কথা হয়েছিল, তা শোনার উপায় নেই। ঠিক তখনই মৌলালির দিক থেকে আসা একটি সল্টলেক-সাঁতরাগাছি রুটের বাসে উঠতে দেখা যায় মাজেদকে। যথারীতি সেই বাসে চাপেন ওই চারজনও। এরপর আর কোনও ফুটেজ নেই। তদন্তে নেমে পুলিশ এজেসি বোস রোডের প্রতিটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখেছে। তবে, আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বাস স্টপ থেকে পিজি হাসপাতাল পর্যন্ত কোথাও বাস থেকে নামতে দেখা যায়নি মাজেদকে। গোয়েন্দারা জানতে পারেন, মাজেদের মোবাইলের সর্বশেষ টাওয়ার লোকেশন ছিল মালদহ। যা থেকে গোয়েন্দাদের অনুমান, মাজেদকে ঘুরপথে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল হাওড়া স্টেশনে। সেখান থেকে ট্রেনে প্রথমে গুয়াহাটি। পরে শিলং হয়ে ডাওকি সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ যান। তবে তিনি স্বেচ্ছায় বাংলাদেশে গিয়েছিলেন, নাকি বাধ্য করা হয়েছিল, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। মনে করা হচ্ছে, ট্রেন মালদহ স্টেশনের আশপাশে থাকাকালীন তিনি তার মোবাইলটি একবার অন করেছিলেন। বর্তমান পত্রিকা প্রশ্ন তোলে, সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়া ওই চারজন কারা? তারা কি বাংলাদেশের কোনও গোয়েন্দা এজেন্সির অফিসার? প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়েছে, কলকাতা পুলিশের অজান্তে কে বা কারা তুলে নিয়ে গেছে মাজেদকে। আইনত কোনও বিদেশি গোয়েন্দা এজেন্সি বিনা অনুমতিতে অন্য দেশে ঢুকে অভিযান চালাতে পারে না। এদিকে, বাংলাদেশ থেকে সরকারিভাবেই তথ্য দেয়া হয়েছে, করোনার ভয়েই মার্চ মাসের শেষদিকে ভারত থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনি। বাংলাদেশের কাউন্টার টেররিজমের গোয়েন্দারা তাকে মিরপুর থেকে গ্রেপ্তার করে। প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের এই যুক্তি তেমন জোরালো নয়। কারণ ভারতে প্রথম করোনা আক্রান্তের খোঁজ মেলে ৩০ জানুয়ারি। তাও আবার দক্ষিণ ভারতের রাজ্য কেরলে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর খুনি লুকিয়ে ছিলেন কলকাতায়। এখানে করোনা ধরা পড়ে ১৮ মার্চ। ফলে ২২ ফেব্রুয়ারি মাজেদ কলকাতা থেকে বাংলাদেশে যাবেন কেন?