×

সাহিত্য

জীববৈচিত্রের প্রতি নির্মম আচরণেই করোনার থাবা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২০, ১১:৪৯ পিএম

জীববৈচিত্রের প্রতি নির্মম আচরণেই করোনার থাবা

মুহাম্মদ সামাদ

মুহাম্মদ সামাদ, কবি

বিশিষ্ট কবি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য মুহাম্মদ সামাদ। ১৯৮৩ সালে ‘একজন রাজনৈতিক নেতার মেনিফেস্টো’ নিয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের রাজপথে অংশ নিয়েছিলেন। দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি সাহসী ও নিরাপস ভূমিকা পালন করছেন সেই ছাত্রজীবন থেকেই। বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিরুদ্ধে, জেলহত্যার বিরুদ্ধে এবং সকল হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী উচ্চারণ শারীরিক অংশগ্রহণ কিংবা লেখনীর মাধ্যমে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উৎস হিসেবে ব্যবহারের প্রতিবাদ করেছেন কবি।

জনসভায় বোমাহামলা কিংবা সৈনিকের সক্রিয় রাজনীতি করারও প্রতিবাদ করেছেন তিনি। অনৈতিক-অপ্রীতিকর-অমানবিক-অস্বাভাবিক ঘটনারও তিনি প্রতিবাদ করেন কাব্যের ভাষায়। কবি সোচ্চার হয়েছেন শিল্প সাহিত্যে অশ্লীলতার বিরুদ্ধে, ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে, উন্নয়নের নামে অনিয়ম ও লুটপাটের বিরুদ্ধে। দেশের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রের ক্ষতি ও সর্বনাশ দেখে কবির হৃদয় বিদীর্ণ হয়। তারই শিল্পিত প্রকাশ ঘটান কবিতায়।

এই কবির করোনাকাল কেমন কাটছে জানতে চাইলে ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, সময়টা দুঃসহ। মানুষের কষ্ট দেখে আর ভালো লাগছে না। মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে আমাদের মতো দরিদ্র মেধ দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ও নাজুক প্রস্তুতি নিয়ে দেশের চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা এ মরণব্যাধি মোকাবিলা করছেন। তা নিয়ে উদ্বেগ-আতঙ্ক হুহু করে বাড়ছে।

তিনি বলেন, আমি তো সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমার মতে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত পুরোপুরিই রাষ্ট্রিয় মালিকানায় থাকা উচিত এবং আরো স্বয়ংসম্পূর্ণ করা উচিৎ। বঙ্গবন্ধুও মানুষে মানুষে ভেদ-বৈষম্যহীন সমাজ এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্য থেকেই সমাজতন্ত্রের কথা বলেছেন।

তিনি আরো বলেছিলেন, দুঃখী মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন তথা তাদের খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মতো মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে না পারলে দুঃখী মানুষ দুঃখীই থেকে যাবে। করোনা যুদ্ধে জিততে হলে সমাজের কল্যাণকামী, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তিকে এক প্লাটফরমে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। প্রতিটি দেশেরই উচিৎ অস্ত্রের পেছনে, চোরাচালানের পেছনে, যুদ্ধের পেছনে অর্থ ব্যয় না করে শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের পেছনে বরাদ্দ বাড়ানো। কেবল বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সব দেশকেই এই রোল প্লে করতে হবে। করোনা আমাদের তা আঙুল দিয়েই বুঝিয়ে দিল।

করোনা মোকাবেলায় কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি কিংবা পরামর্শ আছে কী না জানতে চাইলে মুহাম্মদ সামাদ আরো বলেন, সেদিন টিভিতে দেখলাম প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কোনো উপসর্গ দেখা দিলে তা গোপন না করে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে। তিনি আরো বলেছেন, সরকার দেশকে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস থেকে মুক্ত রাখতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবন ধ্বংস করার অধিকার কারও নেই। খাদ্য মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছাতে হবে। কাজেই এই প্রাণঘাতী ভাইরাস থেকে দেশকে মুক্ত রাখতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সঠিকভাবে অনুসরণ করা উচিত।

মাথায় রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধুর সময় খাদ্য সংকট সৃষ্টি করে সংঘবদ্ধভাবে চতুর্মুখী তৎপরতা শুরু করেছিল বঙ্গবন্ধুকে বেকায়দায় ফেলার জন্য। তাদের তৎপরতায় ১৯৭৪ সালে দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়।

তিনি বলেন, একদিকে আমেরিকা বাংলাদেশের ক্ষুধার অন্ন নিয়ে রাজনীতি করেছে, জনগণের কাছে বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারকে হেয় করার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে খাদ্য সাহায্য পাঠায়নি। তাই খাদ্য সংকটে যাতে মানুষ মারা না যায় এদিকটায় খেয়াল রাখতে হবে। এ সময় নেতা কর্মীরা মানুষের প্রতি মানবিক সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করুক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

আরেকটা কথা না বললেই নয়, সেটা হচ্ছে আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজে যেভাবে সব কিছু মনিটরিং করছেন তা দেখে আমি বিস্মিত। এরকম নেতা আর আসবে কি না আমি জানি না। তার যদি জীবন সংশয় না থাকতো তাহলে তিনি মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে খোঁজ নিতেন। তাকে ধন্যবাদ।

কাটছে কেমন দিন? এর জবাবে বিশিষ্ট এই শিক্ষক বলেন, এলেমেলো ভাবনার মধ্যেও পড়ছি আইন-ই-আকবরি। খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত সম্রাট আকবরের প্রশাসনের বিস্তারিত বর্ণনাসমৃদ্ধ একটি গ্রন্থ। আরেকটি বই পড়ছি। নাম হচ্ছে ‘স্যাপিয়েন্স’। যেখানে মানব ইতিহাসের সূচনা থেকে আজকের বিশ্বে পদার্পণের ইতিহাস, অর্থাৎ মানবজাতির বিবর্তন তুলে ধরা হয়েছে জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে। গ্রন্থটি শুধু তথ্য-উপাত্তে ঠাসা নয়, এর তত্ত্বগুলো ভাবনাকে আলোড়িত করছে।

আপনার কি মনে হয় জীববৈচিত্রের প্রতি মানুষের নির্দয়, নির্মম আচরণই আজ করোনার থাবা? তিনি বলেন, অবশ্যই। প্রকৃতির রক্ষক হওয়ার বদলে আমরা যখন তার ভক্ষক হয়ে দাঁড়াই, তখন তার ফল কী ভয়াবহ হতে পারে, তার আরেক উদাহরণ করোনাভাইরাস। প্রকৃতিতে জীববৈচিত্র্য, প্রাণীকূল স্বাধীনভাবে বিচরণের কথা, মানুষ সেই সব প্রাণী ধরে এনে গাদাগাদি করে খাঁচাবদ্ধ করে রেখেছে মানুষ। প্রকৃতির ওপর তার আধিপত্য বিস্তার করছেই। গাছপালার সঙ্গে সবসময় নির্দয়, নির্মম ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করছেই। জীববৈচিত্রের প্রতি মানুষের আক্রোশ বড়ই তীব্রতর। নির্দয় সেসব আচরণের নানামাত্রিক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তার উদাহরণ করোনা।

আসল কথা হচ্ছে- অর্থের প্রতি প্রমত্ত আকর্ষণ কেড়ে নিয়েছে মানুষের বোধশক্তি। আমাজন জ্বালিয়ে দিবে, বায়ু দূষণ করবে, জল দূষণ করবে, নদী দূষণ করবে- অথচ প্রকৃতি আপনাকে জবাব দিবে না- এটি তো হয় না। তাই আসুন আচরণে বিনয়ী হই। বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষের যুগেও মানবজাতির অসহায়ত্ব উপলব্ধি করি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App