হায় ইতালি, হায় কোয়ারেন্টাইন
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২০, ০৭:০৮ পিএম
সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্যের কারণে ইতালি অসংখ্য পর্যটককে আকর্ষণ করে, সেই ইতালি এখন মৃত্যুপুরী। কিন্তু যে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব দেশটিকে গৌরব এনে দিয়েছে সেই অর্জন পুনর্জীবন পাবে আশা করা যায়। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ইতালির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আক্রান্ত হয়েছে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীরা। মারাও গেছেন। তবু আমরা আশাবাদী রেনেসাঁসের সূতিকাঘর ইতালি পুনরায় জীবনের জয়গান গাইবে।
একসময় ব্ল্যাক ডেথের কবলে পড়ে ইতালির ফ্লোরেন্স ও ভেনিস ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। অথচ মধ্যযুগে এ দুটি শহর ছিল পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর, সম্পদশালী এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধ। এদের সমক্ষক আর একটিও ছিল না। ‘ইনফার্নো’ উপন্যাসে ইতালির ভেনিস শহরে ত্রয়োদশ শতাব্দীর ‘প্লেগ’ ও ‘কোয়ারেন্টাইন’ সম্পর্কে ড্যান ব্রাউন লিখেছেন- “এই শহরের অধিবাসীদের বিদেশপ্রীতিই এর সর্বনাশ ঘটিয়েছে- প্রাণঘাতী প্লেগ চীন থেকে ভেনিসে চলে আসে বাণিজ্যিক জাহাজের মালামালের সঙ্গে জীবাণু আক্রান্ত ইঁদুরের মাধ্যমে। ১৩৪০ সালে প্রাদুর্ভাব হওয়া এই প্লেগের মরণ ছোবলেই চীনের এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা বিনাশ হয়ে গিয়েছিল। ইউরোপে আসামাত্র এই রোগের ছোবলে প্রতি তিনজনের একজন আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে- নারী-পুরুষ, যুবা-বৃদ্ধ, ধনী-গরিব কেউ বাদ যায়নি।... একটা সময় এসেছিল যে মৃতদের কবর দেয়ার মতো শুকনো জায়গা পাওয়া যেত না। উপায়ান্তর না দেখে লাশ ভাসিয়ে দেয়া হতো খাল-বিলে। কিছু কিছু খাল-বিলে এত লাশ ভাসত যে নৌকা চালাতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হতো। লগি-বৈঠা দিয়ে লাশ সরিয়ে মানুষকে চলাচল করতে হতো। কোনো প্রার্থনায় এই মহামারির প্রকোপ কমত না। শহরের শাসকরা যখন বুঝতে পারল ইঁদুরের মাধ্যমেই এই দুর্বিপাকের শুরু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তারপরও একটা নির্দেশ জারি করেন তারা। বাইরে থেকে কোনো জাহাজ বন্দরে ঢুকতে পারবে না, বন্দর থেকে বেশ কিছুটা দূরে ৪০ দিন থাকার পর জাহাজগুলোকে মালামাল নামানোর অনুমতি দেয়া হতো- আজকের দিনে ইতালীয় ভাষায় চল্লিশ সংখ্যাটি ‘কোয়ারান্তা’- খুব তিক্ত স্মৃতি বহন করে ‘কোয়ারেন্টাইন’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।” (অধ্যায় ৬৮) ২০২০ সালেও ইতালির অধিবাসীরা ‘কোয়ারেন্টাইন’-এ আছেন। কারণ ত্রয়োদশ শতাব্দীর মতোই ভয়াবহতার বছর এটি। চীনে শুরু হওয়ার পর করোনা সবচেয়ে ভয়াল থাবা বসিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালিতে। ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ইতালিতে প্রায় সবকিছু বন্ধ রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে মানুষকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। করোনা ভাইরাসের কালো থাবায় মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে দেশটি। প্রতিদিনই সেখানে শত শত মানুষ মারা যাচ্ছেন। আক্রান্তও হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। করোনা ভাইরাসের বৈজ্ঞানিক আচরণ স্মরণে রেখেই বলতে হয় একটি ভাইরাস মানুষের মাঝে বিস্ময়কর গতিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। পরজীবী হিসেবে ভাইরাসগুলো প্রাণিদেহে প্রবেশ করে কোনো কোষের মধ্যে আস্তানা গাড়ে। তারপর এগুলো নিজেদের আরএনএ কিংবা ডিএনএ প্রবেশ করায় হোস্ট কোষের মধ্যে। দখল করে নেয়া কোষকে বাধ্য করে জ্যামিতিক হারে তাদের প্রতিরূপ তৈরি করতে। যথেষ্ট পরিমাণে প্রতিরূপ তৈরি হওয়ার পর তারা সম্মিলিতভাবে কোষকে মেরে ফেলে, কোষের প্রাচীর ভেদ করে ঢুকে পড়ে নতুন হোস্ট কোষে। এভাবে একই কাজ করে যেতে থাকে তারা। আক্রান্ত ব্যক্তি তখন দুর্বল হয়ে পড়ে, শ্বাস-প্রশ্বাস কিংবা হাঁচির মাধ্যমে শরীরের ভেতরে থাকা ভাইরাস নির্গত করে দেয় বাইরে। এসব ভাইরাস বাতাসে ভেসে বেড়ায় যতক্ষণ না অন্য কারোর নিশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে ঢুকে পড়ে। একবার ঢুকতে পারলে সেই একই কাজ শুরু করে দেয় আবার। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, ইতালির এক-তৃতীয়াংশ লোক ১৩৪৮ সালের মহামারিতে প্রাণ হারায় তার প্রধান কারণই ছিল ‘প্লেগ ভাইরাস’। তবে সেই ‘মহামড়কে’র বিপর্যয় থেকে পুনরুত্থান ঘটে দেশটির। ভেনিস, ফ্লোরেন্স, মিলান প্রভৃতি নগরজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। একই সময় সাংস্কৃতিক অর্জনের দিক দিয়ে যা ছিল মানবতা এবং রেনেসাঁসের (নবজাগরণের) সাফল্যমণ্ডিত অর্জন। বর্তমান ইতালি একটি গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যাকে বিশ্বের ২৩তম উন্নত দেশ হিসেবে গণ্য করা হয়। জীবনযাত্রার মান বিচারে বিশ্বের সেরা দশে এর স্থান। ইতালীয়রা উন্নত জীবনযাপনে অভ্যস্ত এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এটি ইউরোজোনেরও একটি অংশ। এছাড়া দেশটির জি ৮, জি ২০ এবং ন্যাটোর সদস্যপদ রয়েছে। কেবল ধনী দেশ হিসেবে নয় বরং শিল্প-সাহিত্যের দিক থেকে ইতালির সমৃদ্ধি সারা বিশ্বের মানুষকে আকর্ষণ করে। অসংখ্য পর্যটকের পদচারণে মুখরিত হয়ে থাকে প্রধান শহরগুলো। প্রতি বছর এদেশে বিপুলসংখ্যক পর্যটক আসে। এক হিসাবে দেখা গেছে সংখ্যাটি পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের এক শতাংশ- আনুমানিক প্রায় ৫০ মিলিয়ন পর্যটক। এ দেশের ভেনিস কিংবা ফ্লোরেন্স সীমিত জায়গা কিন্তু পর্যটকদের বিপুল চাপে দিশাহারা। করোনা ভাইরাসের কারণে ভেনিস নগর এখন শূন্য। কিন্তু এই শহরটির আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বলতে গেলে কোনো ধরনের মোটরগাড়ি নেই এখানে। নগর সভ্যতার ট্রাফিক, সাইরেন, হর্ন আর সাবওয়ের কোলাহল থেকে পুরোপুরি মুক্ত। কেবল মানুষের পদচারণা, কবুতরের ডাক আর ক্যাফেগুলোতে বেজে চলা বেহালার সুর কানে আসে। পৃথিবীর আর কোনো শহরে এ রকম শব্দ শুনতে পাওয়া যাবে না। এখানে আছে সেন্ট মার্কসের ব্যাসিলিকা, আছে বাইজেন্টাইন সভ্যতার অনেক নিদর্শন। আর ক্যাথেড্রাল ও জাদুঘরগুলো সত্যিই দর্শনীয়। কোনো কোনো চার্চে শত শত মূর্তি, ক্রিপ্ট আর সমাধিকক্ষ রয়েছে। ভ‚গর্ভস্থ অনেক কক্ষ হাজার বছরের পুরানো। অন্যদিকে ফ্লোরেন্সের মনোরম দৃশ্য রয়েছে আর্নো নদীর তীরে। ভিয়া দেই কাস্তেলানি, পালাজ্জো ভেচ্চিও, উফিৎজি (টভরুর সঁংবঁস), এক-হাতওয়ালা ঘড়ি আর খাঁজকাটা মিনারওয়ালা পালাজ্জো ক্যাথেড্রাল, পিয়াজ্জা দি সান ফিরেঞ্চি, বার্জেলো, বাদিয়া টাওয়ার অনন্য সৃষ্টিকর্ম। ওপর থেকে দেখলে মনে হবে, পিয়াজ্জা (বাঁধানো উঠোন) যেন এক শান্ত মরুদ্যানের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই শহরে একসময় অবাধে বিচরণ করতেন গিয়োত্তো, দোনাতেল্লো, ব্রুনেলেশি, মিকেলেঞ্জেলো, বতিচেল্লি। মহাকবি দান্তের দৃষ্টিতে ফ্লোরেন্স আশীর্বাদপুষ্ট শহর; যে শহর তাকে নির্বাসিত করেছিল অথচ দণ্ডদাতাদের কাছ থেকে এই শহরকে তিনি অভয়ারণ্য হিসেবে পেয়েছিলেন। অথচ ফ্লোরেন্সের সান্তা মারিয়া দেল ফিওরের ক্যাথেড্রাল এখন জনশূন্য। সিস্টিন চ্যাপেল বন্ধ। সবচেয়ে সুন্দর আর মনোরম ময়দান ‘ববোলি গার্ডেন’ এখন খাঁ খাঁ করছে। ভিয়ালে দেল পোগিগও ইম্পেরিয়াল এখন ছবির মতো নিশ্চল। ভাসারির ম্যুরালগুলো হতাশার চাদরে মোড়া। বেল টাওয়ারের তিনশ ফুট উচ্চতা এখন কেবল কান্নার প্রতিধ্বনি করছে। গেটস অব প্যারাডাইসে দশটি বর্গাকৃতির প্যানেল এখন দর্শনার্থী শূন্য। যে সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্যের কারণে ইতালি অসংখ্য পর্যটককে আকর্ষণ করে, সেই ইতালি এখন মৃত্যুপুরী। কিন্তু যে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব দেশটিকে গৌরব এনে দিয়েছে সেই অর্জন পুনর্জীবন পাবে আশা করা যায়। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ইতালির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আক্রান্ত হয়েছে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীরা। মারাও গেছেন। তবু আমরা আশাবাদী রেনেসাঁসের সূতিকাঘর ইতালি পুনরায় জীবনের জয়গান গাইবে।
ড. মিল্টন বিশ্বাস : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]