×

মুক্তচিন্তা

গৃহবন্দি করোনা দর্শন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ এপ্রিল ২০২০, ০১:১৯ পিএম

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এই নিবন্ধটি লিখতে বসে এবারের মার্চের আনন্দবর্জিত ইতিহাস মণ্ডিত দিনগুলো কীভাবে যে হারিয়ে গেল, তা স্মরণে আসছিল। বাঙালির প্রাণের তিনটি দিন- ৭ মার্চ, ১৭ মার্চ ও ২৬ মার্চ কীভাবে যে হারিয়ে গেল তা ভাবলে বেদনার্ত না হয়ে পারা যায় না। যে মানুষ এই দিন তিনটিকে ইতিহাসের দিনে প্রায় অর্ধশত বছর আগে পরিণত করেছিলেন, সেই মানুষ এবার কোথাও সমবেত হতে পারেননি। মানুষকে এবার গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হয়েছে, যা অতীতে কোনোদিন হয়নি। যার যার বাড়িতে স্বেচ্ছা বন্দি হয়ে থেকে স্মৃতিতে দিনগুলোকে আনা আর টেলিভিশনে নানা চ্যানেল না করেই কাটাতে হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা ব্যাপক পূর্ব প্রস্তুতি সত্ত্বেও শেষ মুহূর্তে এসে স্থগিত করা, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি বাতিল এবং এপ্রিলে এসে জানা গেল পহেলা বৈশাখ বাঙালির নববর্ষের দিনমান সব অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ। কল্পনার বাইরে ছিল এমন এমন সিদ্ধান্ত। কিন্তু তা করতে হলো, মানুষ বাঁচানোর জন্য নিশ্চিত বিপদের হাত থেকে কোটি কোটি মানুষকে রক্ষা করার জন্য।

এমন সিদ্ধান্ত শুধু বাংলাদেশে নেয়া হচ্ছে তা নয়। সমগ্র বিশ্বব্যাপীই মানুষ কোথাও সমবেত হতে পারছেন গানের, নাচের, আবৃত্তির কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারছেন না। এমনকি একে অপরের খবর নিতে কেউ কারো কাছে ছুটে যেতে পারছেন না। আনন্দে কেউ কারো সঙ্গে হাত মেলাতে, পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে আলিঙ্গন করতেও পারছেন না। যেন এক আতঙ্কের অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়েছে পৃথিবী। মানুষ গৃহবন্দি কিন্তু তার ভাবনার অপমৃত্যু ঘটেনি। ঘটবেও না কোনোদিন। কারণ ভাবনার মৃত্যু নেই আর ভাবনারাই তো এ বিশ্বকে গড়েছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উত্থান ও প্রসার ঘটিয়েছে। সেই ভাবনা থেকেই মানুষ উদ্বিগ্নচিত্তে আজ প্রশ্ন তুলছেন : মেডিসিনের শহর সুইজারল্যান্ড অসহায়; প্রযুক্তির শহর জার্মানি নিরুপায়; মানবতার শহর ইতালি কাঁদছে; ক্ষমতার দেশ আমেরিকা দিশাহারা বস্তুত চীনে ডিসেম্বরে শুরু হয়ে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে করোনা ভাইরাস দৃশ্যত বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে দেশে দেশে যে মৃত্যুর মিছিল সংঘটিত করেছে তার ভরাবহতা এবং মানুষের অসহায়তা বুঝাতেই সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি ও আমেরিকার প্রসঙ্গ তুলেছেন। গোটা পৃথিবীর সংবাদ মাধ্যমগুলো ঘণ্টায় ঘণ্টায় মৃত্যু ও আক্রান্তের যে তালিকা প্রকাশ করে চলেছে তা থেকেই মানুষের মনে ওই চারটি দেশ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন মানুষের ভাবনার স্থান পেয়েছে। চীনে যখন ঘটল- লাখের মতো মানুষ আক্রান্ত হলো কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে হাজার তিনেক মানুষের মৃত্যুর পর তারা যে দ্রুততায় রোগটিকে বিদায় দিল- তেমন বা তার চেয়ে দ্রুততার সঙ্গে ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড ও আমেরিকা কেন পারল না- তা ভেবে সত্যিই ক‚ল-কিনারা পাচ্ছেন না সারা পৃথিবীর চিন্তাশীল ঘরে বসে থাকা কোটি কোটি মানুষ। ওই উন্নত দেশগুলোর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কি এতই দুর্বল? তাদের স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরাও এতটাই পেছনে পড়ে আছেন যে করোনার হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর কোনো ওষুধ আজো তারা আবিষ্কার করতে পারছেন না? বিস্মিত হতে হয়, কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যুও পর এবং লক্ষাধিক মানুষের দেশে সংক্রমণের পর সংবাদ সম্মেলন করে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, আমেরিকায় আরো ১ থেকে ২ লাখ লোক এপ্রিলে মারা যেতে পারেন।

উন্নততর দেশগুলোর অবস্থাই সর্বাধিক বেহাল। অপরপক্ষে এখন পর্যন্ত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো অবস্থায়। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এখন বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যদি অধিকতর সচেতন হয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণ করতে পারে তবে হয়তো এই দেশগুলো অনেক কম ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারবে। কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সরাসরি অভিযোগ এনেছে যে, বাংলাদেশের মানুষ অসচেতনÑ তাই সেখানে ২০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে।

অপরদিকে খোদ ব্রিটেনের খবর- ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী করোনায় আক্রান্ত। আফ্রিকার (সম্ভবত) একটি দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী দেশবাসীকে করোনা আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। বহু গৌরবের অধিকারী, ফুটবলে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশ এবং আর অসংখ্য গৌরবের অধিকারী উন্নত দেশ ইতালি যখন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়, ফ্রান্স-জার্মানির মতো জ্ঞান-বিজ্ঞান-সভ্যতায় শীর্ষ স্থানে অধিষ্ঠিত ইউরোপীয় দেশে যখন প্রতিদিন শত শত মানুষ আক্রান্ত হন, মৃত্যুবরণ করেন তখন মানুষ আতঙ্কিত না হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া দুরূহ।

আবার দক্ষিণ আমেরিকার ছোট্ট সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবা যখন করোনা আক্রমণ থেকে প্রায় মুক্ত থাকে- দশকের পর দশক ধরে আমেরিকার আরোপকৃত অবরোধের মতো চরম প্রতিক‚লতাকে পরাজিত করে করোনার ওষুধ (স্বল্পমূল্যে) আবিষ্কার করে, অসংখ্য ডাক্তার-নার্স গড়ে তুলে বিপুল সংখ্যায় ইতালি ও অন্যান্য দেশে পাঠায় তখন একদিকে যেমন বিস্ময়-বিমূঢ় হয়ে পড়তে হয়- তেমনই আবার তাদের এই সাফল্যে বিপুল আশাবাদেরও সৃষ্টি হয়। তবে বহু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে স্বাস্থ্য বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা, চিকিৎসার সুযোগহীনতা এবং উপযুক্ত শিক্ষা, বিশেষ করে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার নিদারুণ অভাবের দেশ বাংলাদেশকে নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা মানুষের মনে কম নেই। ‘লকডাউন’। আনুষ্ঠানিকভাবে না ঘোষণা করা হলেও দেশব্যাপী সামরিক বাহিনীকে যখন নামানো হয় রাস্তাঘাটে চলাচলে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে অথবা সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে তখন আমাদের বিজ্ঞানমনস্কতাহীনতা উলঙ্গভাবে ধরা পড়ে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, বাজার-বিপণি, গণপরিবহন পর্যন্ত বন্ধ থাকা অবস্থায় বারবার টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় সবাইকে সতর্ক করে দেয়া সত্তে¡¡ও রাস্তাঘাটে জটলা আমাদের অসচেতনাকেই নগ্নভাবে প্রকাশ করছে মাত্র। ফলে বিপদের আশঙ্কা কমছে না, বাড়ছে বরং। সবার অন্তর থেকে বুঝা দরকার যে নিয়মবিধি না মেনে বাইরে ঘোরাফেরা করলে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা প্রবল। আর তা যদি হয় তাহলে তার গোটা সংসার, প্রতিবেশীসহ বহু লোকের বিপদ ঘটে যেতে পারে।

আসলে মনে হয়, অনেকে এই বিষয়টিকে হালকাভাবে নিচ্ছেন এই ভেবে যে বাংলাদেশে সরকারি প্রচারণা অনুযায়ীই করোনা সংক্রমণ নামমাত্র। তাই কঠোরভাবে ওই নিয়মগুলো প্রয়োগ, তাদের মতে যুক্তিহীন। সে কারণেই হয়তো নিয়ম মানার তেমন একটা প্রয়োজন অনুভব করছেন না আমাদের তরুণরা। প্রকৃত পরিস্থিতি ঢাকায় বসে বোঝা যাবে না। যেতে হবে গ্রাম-গ্রামান্তরে সেখানে সরকারি নিষেধাজ্ঞা, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা এবংবিধ কথাবর্তার প্রয়োগ চোখেই পড়ে না প্রায়। হাটবাজার, দোকানপাট মোটামুটি স্বাভাবিকভাবেই চলছে। উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারাও পেরে উঠছেন না বহু ক্ষেত্রেই কারণ নিজ নিজ এলাকার নির্বাচিত নানা স্তরের জনপ্রতিনিধির একটি বড় অংশই ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত এবং তারা তাদের ব্যবসা যথারীতি চালিয়ে যেতে সচেষ্ট। স্বীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থ বা এমনকি নিজ এলাকার ভোটারদের স্বার্থ রক্ষায় এগিয়ে আসতে তাদের অনেকেই রাজি নন। এ কথা ঠিক, বহু লোকই নিজেদের গৃহবন্দি করে রেখেছেন। কিন্তু তা কতদিন সম্ভব হবে? হাটবাজার তো দৈনন্দিন ব্যাপার ছিল। এখনকার পরিস্থিতিতে তা না হয় দৈনন্দিন না হয়ে সাপ্তাহিক ব্যাপার তো হবেই। অর্থাৎ সপ্তাহে অন্তত একবার তো বাজারে যেতেই হবে এবং সেখানে অজস্র মানুষের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি এড়িয়ে চলা অসম্ভব। তাই বাজারের সংখ্যা বাড়ানো হলে এ সমস্যার অনেকটা সমাধান হতে পারে। অন্তত সাময়িকভাবে। সর্বাধিক সংকটে পড়েছেন গরিব ও বেকার মানুষরা। রিকশাচালক, ভ্যানচালক প্রভৃতির সংখ্যা বিপুল। তাদের তো না বেরিয়ে উপায় নেই- পেটের দায়েই বেরুতে হয়। আবার বের হয়েও খুব একটা লাভ হচ্ছে না, তাদের বাড়িতে খাবার পৌঁছাতে হবে।

সরকার ও নানা সামাজিক সংগঠন যেভাবে গরিব মানুষদের মধ্যে খাবার পৌঁছাচ্ছে, তাও ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ তারা ক্যামেরাম্যান সঙ্গে নেন এবং বহুসংখ্যক মানুষকে একত্রে জমা করে বিলি করতে পছন্দ করেন। ঝুঁকির দিকটা এতে অবহেলিত হচ্ছে, ঝুঁকিও বাড়ছে। ফলে বিপদাশঙ্কা গরিব মানুষদের বিনামূল্যে খাবার যেমন দিতে হবে, তেমনি তা আবার ঝুঁকিমুক্তভাবেও দিতে হবে। তাই পুলিশ বা প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সহায়তা নিয়ে যতটা সম্ভব বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়াই সর্বাধিক নিরাপদ পদ্ধতি।

লক্ষণীয় যে, উন্নততর দেশগুলোর অবস্থাই সর্বাধিক বেহাল। অপরপক্ষে এখন পর্যন্ত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো অবস্থায়। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এখন বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যদি অধিকতর সচেতন হয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণ করতে পারে তবে হয়তো এই দেশগুলো অনেক কম ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারবে। কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সরাসরি অভিযোগ এনেছে যে, বাংলাদেশের মানুষ অসচেতন- তাই সেখানে ২০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে। মানুষ যে অসচেতন আমরা নিজেরাই স্বীকার করি এবং সে কারণেই মানুষকে অযথা রাস্তায় না বেরিয়ে ঘরে থাকতে বাধ্য করার চেষ্টা করছি- প্রয়োজনে নিয়ম ভঙ্গকারীদের জেল-জরিমানার মতো শাস্তিও দিচ্ছি। তাই বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শগুলো বাড়াবাড়িভাবে মানার ও মানানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

এই অঞ্চলে ধর্মীয় অন্ধত্ব একটি মারাত্মক সমস্যা সংকট সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বলা যায়, নববর্ষের সাংস্কৃতিক সমাবেশ, বঙ্গবন্ধুর শতবার্ষিকীর যাবতীয় সমাবেশ, সব রাজনৈতিক সমাবেশ বন্ধ করাতে কোনো সমস্যা না হলেও মসজিদগুলোতে জুমা আর নামাজ বন্ধ করতে সরকার অহেতুক দুর্বল চিত্ততার পরিচয় দিচ্ছে। যেখানে সৌদি আরব সব ধর্মীয় সমাবেশ বন্ধ করেছে, করোনা প্রতিরোধ করতে কারফিউ জারি করেছে, ইরান লকআউট করেছে সেখানে বাংলাদেশে কেন এটা করা হবে না? যতদিন সংকটটি থাকবে ততদিন জুমা, অন্যান্য জলসা, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্মীয় সমাবেশ কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক। ততদিন সব নামাজ, সব পূজা, সব প্রার্থনা ঘরে বসে করলে সওয়াব বা পুণ্য আদৌ কম হবে না। গোটা বিশ্বের এই দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতে সৌদি আরব এ বছরের জন্য মুসলিমদের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পবিত্র হজ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করতে চলেছে। এ থেকেও আমাদের শিক্ষা নেয়া কর্তব্য।

রণেশ মৈত্র : রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App