×

জাতীয়

ঠেকানো যাচ্ছে না জনস্রোত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২০, ০৯:৩৫ এএম

ঠেকানো যাচ্ছে না জনস্রোত

করোনা মোকাবিলায় ‘সামাজিক দূরত্ব’ মেনে চলা জরুরি হলেও তা অবজ্ঞা করেন অনেকেই। সব বয়সী মানুষ জুমার নামাজে অংশ নেন গাদাগাদি দাঁড়িয়ে। মসজিদে স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেকে দাঁড়িয়ে পড়েন সংলগ্ন প্রধান সড়কে। ৩ এপ্রিল রাজধানীর নয়াপল্টন এলাকার দৃশ্য -ভোরের কাগজ

ঠেকানো যাচ্ছে না জনস্রোত

করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্বজুড়েই কয়েকটি বিষয় বারবার মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে। যেমন- বারবার হাত ধোয়া, মুখে স্পর্শ না করা, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। করোনা সংক্রমণ দমিয়ে রাখতে বাংলাদেশেও মানুষকে ঘরে রাখা বা সামাজিক দূরত্ব রক্ষার কার্যক্রমকে প্রধান কৌশল হিসেবে নিয়েছে সরকার। সে জন্য ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে সাধারণ ছুটি। সামাজিক দূরত্ব ও হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে কঠোর হচ্ছে পুলিশ এবং সেনাবাহিনী। কিন্তু এরপরও কাক্সিক্ষত মাত্রায় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। গতকাল শুক্রবার দেশের প্রায় সব মসজিদেই আগের মতো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাতারবদ্ধ হয়ে জুমার নামাজ পড়েছেন মুসল্লিরা। অন্যান্য ওয়াক্তেও একইভাবে নামাজ আদায় করা হচ্ছে। এছাড়া হাট-বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতারা প্রায় একে অন্যের গা-ঘেঁষে দাঁড়াচ্ছেন। চায়ের দোকানে, অলি-গলির মোড়ে মোড়ে চলছে বিভিন্ন বয়সী মানুষের আড্ডাবাজি। যা করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির উচ্চ ঝুঁকি তৈরি করছে।

প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ইসলামিক ফাউন্ডেশন (ইফা) থেকে জুমার নামাজে দেশের সব মসজিদে বাংলা বয়ানকে নিরুৎসাহিত করার আহ্বান করা হয়েছিল। শুধু সংক্ষিপ্ত খুতবা ও ফরজ নামাজ পড়ার আহ্বান জানিয়েছিল সংস্থাটি। এছাড়া নামাজের কাতারে ফাঁকা ফাঁকা হয়ে দাঁড়ানোরও অনুরোধ করেছিল ইফা। কিন্তু দেশের অধিকাংশ মসজিদেই এসব আহ্বান ও অনুরোধ পুরোপুরি মানা হয়নি। অনেক মসজিদেই আগের মতো গা-ঘেঁষে কাতারবদ্ধ হয়ে নামাজ আদায় করেছেন মুসল্লিরা। তবে ব্যতিক্রম ছিল জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ অল্প কিছু মসজিদ।

শুক্রবার (৩ এপ্রিল) বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজ ও মোনাজাত পরিচালনা করেন ভারপ্রাপ্ত খতিব মুফতি মাওলানা এসানুল হক জিলানী। করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সরকার ও বিশেষজ্ঞরা সতর্কতার জন্য যেসব নির্দেশনা প্রদান করছেন তা মেনে চলার জন্য জনগণকে অনুরোধ জানানো হয় বায়তুল মোকাররম থেকে। নামাজের আগে মসজিদে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে মুসল্লিদের হাত ধোয়ানো ও হ্যান্ড টাওয়াল (টিস্যু) সরবরাহ করা হয়। ফরজ নামাজের আগে বাসায় ওজু করে সুন্নত-নফল পড়ে মসজিদে আসতে বলা হয়।

অন্যান্য শুক্রবার বায়তুল মোকাররমে যে চিত্র দেখা যায়, গতকাল ছিল ঠিক তার উল্টো। জ্বর, সর্দি-কাশি থাকলে মসজিদে না আসার নির্দেশনার কারণে মসজিদে মুসল্লিদের সমাগম ছিল খুবই কম। মুসল্লিরা দূরত্ব বজায় রেখে মসজিদে প্রবেশ করেছেন। ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় হাত মোজা ও মাস্ক ব্যবহার করে মসজিদে এসেছেন। নামাজ শেষে বেরও হয়েছেন দূরত্ব বজায় রেখেই।

জাতীয় মসজিদে গতকাল বাংলা বয়ান হয়নি। সংক্ষিপ্ত আরবি খুতবার পর ফরজ নামাজ শেষ করা হয়। নামাজের পর পরই মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বিশ্বের সব দেশকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখতে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করেন মাওলানা এসানুল হক জিলানী। এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের আরোগ্য কামনা করে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করা হয়।

রাজধানীর মিরপুর, শ্যামলী, শুক্রাবাদ, মগবাজার, সার্কিট রোড, পল্টন, বায়তুল মোকাররম, ধানমন্ডি, কলবাগান এলাকার মসজিদগুলো ঘুরে দেখা গেছে, অনেক বয়স্ক মানুষ জুমার জামাতে অংশ নিতে মসজিদে গেছেন। অনেকেই সঙ্গে নিয়ে গেছেন শিশুদের। এছাড়া নামাজের আগে ও শেষে মুসল্লিদের অনেককেই জড়ো হয়ে গল্প করতেও দেখা গেছে। কোনো কোনো মসজিদের সামনে জড়ো হয়েছেন ভিক্ষুকরাও। বেশিরভাগ মুসল্লির মধ্যেই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নির্দেশনা মানার আগ্রহ দেখা যায়নি। এদিকে করোনাভীতি কিংবা সাবধানতার কারণে শহরাঞ্চলের অনেক মসজিদে যেমন মুসল্লির সংখ্যা কমেছে, তেমনি গ্রামাঞ্চলে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। কোথাও কোথাও আগের চেয়ে বেশি মুসল্লি আসছেন মসজিদে। দীর্ঘ ছুটির কারণে গ্রামে লোক বেড়ে যাওয়ায় এমটা হচ্ছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। কেউবা বলছেন, মৃত্যুর ভয়ে ইবাদতে মনযোগী হয়েছেন অনেকে।

অন্যদিকে সৌদি আরব, ইরানসহ অধিকাংশ মুসলিম দেশ করোনা ঠেকাতে জুমার নামাজ বন্ধ রাখলেও বাংলাদেশে কেন বন্ধ করা হচ্ছে না- তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সচেতন মহল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক ভোরের কাগজকে বলেন, ইতোমধ্যে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ তৃতীয় পর্যায়ে চলে এসেছে, অর্থাৎ সামাজিক সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। পরিস্থিতি খুব খারাপ হওয়া ঠেকাতে অতি দ্রুত মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় বন্ধ করা উচিত। জুমার নামাজ বন্ধ রাখতে গতকাল পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে ৩ ঘণ্টার জন্য কার্ফু জারি করা হয়েছিল। আর আমাদের দেশে আগের মতোই সব মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় চলছে। মহামারির এই সময়ে যা পুরোপুরি আত্মঘাতী।

আবার ভিন্ন মতও আছে অনেক। ঢাকার মালিবাগ এলাকায় একটি মসজিদে গতকাল জুমার নামাজে অংশ নেন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা তানভীর হাসান। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপীই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে প্রচারণা চলছে। কিন্তু একটা বিশ্বাস থেকে আমার কাছে মনে হয় যে, মসজিদে গেলে আমার কিছু হবে না। এটাই আমার বিশ্বাস।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড-১৯ প্রতিরোধের যে কয়েকটি ধাপ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম ধাপ হলো- সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। এক গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে ৬০ ভাগেরও বেশি রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। করোনা একজন মানুষ থেকে অন্য মানুষে সর্বনিম্ন ৩ ফুট ও সর্বোচ্চ ৬ ফুট পর্যন্ত দূরত্বে ছড়াতে পারে। তাই মানুষে-মানুষে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি।

এই প্রেক্ষাপটে আলেম-ওলামাদের অনেকে বলছেন, মসজিদগুলো সাধারণ মুসল্লিদের ঘরে নামাজ পড়ার পরামর্শ দিচ্ছে, কিন্তু তারা মসজিদে এসে নামাজ পড়া বন্ধ করতে চাইছেন না। আর সরকার বলছে, মসজিদে আপাতত নামাজ বন্ধ রাখার ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত থাকায় আলোচনা চালানো হচ্ছে।

এ বিষয়ে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আবদুল্লাহ গত সপ্তাহে বিবিসি বাংলাকে জানান, জামাতে নামাজ বন্ধ রাখার ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। সে জন্য তারা আলোচনা চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, আলেম-ওলামাদের এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনাটা অনেক নিকটে এসে গেছে। তারাও মনে করছেন, এভাবে চলতে দেয়া ঠিক হবে না। আমরা একটা সিদ্ধান্তের একেবারে কাছাকাছি এসে গেছি। আমরা সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে এ বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব। তিনি আরো বলেন, ইতোমধ্যে মক্কা-মদিনার সিদ্ধান্ত আমরা জানি, পাকিস্তানও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে। অল্প সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।

এরপর পেরিয়ে গেছে এক সপ্তাহ। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। এদিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নির্দেশনাও মানা হচ্ছে না ঠিকমতো। ফলে বাংলাদেশে মহামারি আকারে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App