×

পুরনো খবর

কোথায় যাব আমরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২০, ০৮:৫৯ পিএম

কোথায় যাব আমরা

বহুমাত্রিক দূষণ ঢাকায়, রয়েছে ডেঙ্গুর ভয়, ভ‚মিকম্পের ভয়, ট্রাফিক জ্যামের ভয়, বায়ুদূষণের ভয়, খাদ্য ভেজালের ভয়, অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভয়, বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধির ভয় এবং সর্বোপরি করোনা ভাইরাসের ভয়। করোনা ভাইরাস নিয়ে সারা ঢাকা শহরের মানুষের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। সব ঢাকাবাসীর ইচ্ছা এই মুহূর্তে যদি সম্ভব হতো ঢাকা ছেড়ে মফস্বল শহরে গিয়ে থিতু হওয়া।

মানুষের সহজাত স্বভাব হলো সে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে চায়, অদেখা জগৎকে দেখার আকাক্সক্ষা। এভাবেই মানুষ জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে এক জায়গা থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। এভাবেই মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে আদিম মানুষের উৎপত্তিস্থল হলো আফ্রিকা মহাদেশ। তবে আফ্রিকার কোথায় তা নিশ্চিত করে বলতে পারেনি। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন গবেষণা করে সেই জায়গার সন্ধান পেয়েছে, তা হলো বতসোয়ানার উত্তরাঞ্চল। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রখ্যাত সাময়িকী ন্যাচার এই গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গবেষকরা বলছেন, হোমো স্যাপিয়েন্সকে মানুষের আধুনিক প্রজাতি হিসেবে ধরা হয়। আর এই প্রজাতির মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছিল বৃহত্তর জামবেজি নদীর অববাহিকার দক্ষিণাঞ্চলে। সময়টা ছিল দুই লাখ বছর আগে। জামবেজি আফ্রিকার চতুর্থ বৃহত্তম নদী। এটি পড়েছে বতসোয়ানা এবং নামিবিয়া ও জিম্বাবুয়ের কিছু অংশ। নদীটির দক্ষিণে পড়েছে বতসোয়ানা। এর পর তারা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সেই অঞ্চল ছাড়তে বাধ্য হয় এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই সূচনা সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন সভ্যতার। এই অঞ্চলে প্রায় ৭০ হাজার বছর ধরে তারা বহালতবিয়তে বসবাস করেছিল। আজো পৃথিবীর মানুষ বিভিন্ন কারণে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মাইগ্রেট হচ্ছে, এমনকি এই মাইগ্রেশন প্রাণিকুলের মধ্যেও দেখা যায়। এই মাইগ্রেশনের মূল কারণ কী, মানুষ একটু ভালোভাবে একটু সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বাঁচতে চায়। বিজ্ঞানীরা এত কিছু গবেষণা করে নতুন নতুন পণ্য সামগ্রী ও ওষুধ আবিষ্কার করছে শুধু মানুষের জীবনকে একটু আরাম-আয়েশ ও জীবনের মান উন্নয়নের জন্য। মূলত মানুষ বাঁচতে চায়, বাঁচার জন্য প্রাণান্তর প্রচেষ্টা মানুষকে জীবকুলের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রাণীতে পরিণত করেছে। এবারে আসি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটের কথা, সব নাগরিক জীবনের সুযোগ-সুবিধা যেন ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করেই, আর তাই সব দেশের মানুষ ছুটে আসছে ঢাকা শহরে এবং ঢাকা নিজেই যেন মানুষের পদভারে ঢেকে গেছে। এখন ঢাকা শহর আর মানুষের বসবাসের উপযোগী নেই। ঢাকায় শুধু মানুষ আর মানুষ, এই মানুষগুলো কত অসহায় তারা শুধু জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে তাদের জন্ম ভিটা ছেড়ে ঢাকায় এসে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ঢাকা শহরের যদি ১০০ মানুষের ওপর আপনি জরিপ চালান তাহলে দেখবেন প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ বলবে তারা ঢাকায় থাকতে চায় না প্রায় বাধ্য হয়েই বসবাস করছে। এখন সময় এসেছে ঢাকা শহর ত্যাগ করার; কারণ ঢাকায় সব ভীতির এবং আতঙ্কের উৎসস্থলে পরিণত হয়েছে। বহুমাত্রিক দূষণ ঢাকায়, রয়েছে ডেঙ্গুর ভয়, ভ‚মিকম্পের ভয়, ট্রাফিক জ্যামের ভয়, বায়ুদূষণের ভয়, খাদ্য ভেজালের ভয়, অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভয়, বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধির ভয় এবং সর্বোপরি করোনা ভাইরাসের ভয়। করোনা ভাইরাস নিয়ে সারা ঢাকা শহরের মানুষের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। সব ঢাকাবাসীর ইচ্ছা এই মুহূর্তে যদি সম্ভব হতো ঢাকা ছেড়ে মফস্বল শহরে গিয়ে থিতু হওয়া। কিন্তু আমরা চাইলেও সবকিছু করতে পারি না। ভীষণ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে আমাদের এই শহরে থাকতে হবে। যদিও একজন বিজ্ঞানের গবেষক হিসেবে আমি মনে করি আতঙ্কের তেমন কিছু নেই, বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা যে পরামর্শ দিচ্ছেন এবং দেশের সরকার দ্রুত যেসব কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তাতে আমরা কিছুটা শঙ্কা মুক্ত থাকতে পারি। আমাদের দেশবাসীর উচিত হবে এখন বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা, সরকারের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সচেতনতামূলক উপদেশ মেনে চলা। আমরা উৎসবমুখর জাতি, সবাই মিলে মেলা বা একত্রে আড্ডা দিতে পছন্দ করি, আপাতত সেই ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা। শুধু ঢাকা শহর নয়, পুরো দেশবাসীর উচিত এই মুহূর্তে বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা, সরকারের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সচেতনতামূলক উপদেশ মেনে চলা। এখন ভাবতে অবাক লাগে মানুষ প্রকৃতির কাছে কত অসহায়, পৃথিবীর বাঘা বাঘা চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের প্রতিষেধক বা কোনো ওষুধ আবিষ্কার করতে পারছেন না। হয়তো পারবেন, সে ক্ষেত্রে সময় লাগতে পারে। আমরা বাঙালিরা গুজবে বিশ^াস করি, অনুরোধ রইল গুজবে কান দেবেন না, সরকারের ও সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কী বলেন, সেগুলো শুনুন। বর্তমানে স্মার্ট মোবাইল ফোন সবার হাতে থাকায় এবং ইন্টারনেটের কানেকশন সহজলভ্য হওয়ায় সবাই আমরা ইউটিউব দেখে থাকি। যারা ইউটিউবার বা বিভিন্ন সচেতনতামূলক ভিডিও তৈরি করে ইউটিউবে ছেড়ে দেন, তাদের প্রতি অনুরোধ রইল অহেতুক মানুষ উদ্বিগ্ন হয় করোনা ভাইরাস নিয়ে এমন ভিডিও ইউটিউবে আপলোড করবেন না। এটা একটা সাময়িক প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা এক সময় চলে যাবে, শুধু আমাদের একটু সচেতনতা আর দায়িত্বশীল হওয়া দরকার। দেখুন করোনা ভাইরাসের চেয়ে আমাদের দেশে বড় সমস্যা হলো সড়ক দুর্ঘটনা, এর কারণে প্রতি বছর দেশে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। এই মৃত্যুহার আমরা একটু সচেতন ও ট্রাফিক আইন মেনে চললেই কমিয়ে আনতে পারি। আসুন আমরা সমাজের জন্য, জাতির জন্য এবং সর্বোপরি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটু সচেতন হই। এখন সবাই যেমন করোনা ভাইরাসের জন্য একটু নড়েচড়ে বসেছি, ঠিক তেমনিভাবে স্বাস্থ্য, পরিবেশ, খাদ্য, পরিবহন ও সুশিক্ষা সম্পর্কে একটু সচেতন হই এবং যে যার অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল ভ‚মিকা পালন করি। করোনা ভাইরাস নিয়ে সারা বিশে^ যেভাবে আতঙ্ক ছড়িয়েছে, সেই তুলনায় মৃত্যুহার অন্যান্য মহামারির চেয়ে অনেক কম। আসল ঘটনা হলো এই ভাইরাসের জিনগত মিউটেশনের কারণে এর আকার-আকৃতি এবং চেহারা ও আচরণ পরিবর্তন হয়, তাই ওষুধ প্রয়োগের আগেই এটি প্রাণঘাতী আকার ধারণ করে। তারপরেও বলতে চাই এই ভাইরাসের কারণে ১০০ জনের মধ্যে ২ জনের মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে; বাকি ৯৮ জন মানুষ তাদের দেহের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করছেন। তবে এই সময়ে সরকারের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সংবাদ সম্মেলনে যেসব সচেতনতামূলক উপদেশ দিয়েছেন, তা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত এবং বাস্তবধর্মী, সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে আমাদের পালন করা উচিত। তবুও ঢাকার রাস্তায় যখন কোনো মাকে দেখি বায়ুদূষণের কারণে তার দুগ্ধপোষ্য শিশুর মুখে মাক্স লাগিয়ে কোথাও যাচ্ছেন, তখন খুব খারাপ লাগে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। সত্যি কথা তো, কোথায় যাব আমরা! আমরা কি পারি না ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দূষণমুক্ত একটি সমাজ ও পরিবেশ তাদের উপহার দিতে।

লিটন মহন্ত : বিজ্ঞান গবেষক ও গল্পকার। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App