×

শিক্ষা

শিক্ষাপঞ্জি লণ্ডভণ্ড

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২০, ১০:৪৩ এএম

শিক্ষাপঞ্জি লণ্ডভণ্ড

ফাইল ছবি

শিক্ষাপঞ্জি লণ্ডভণ্ড

চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ১ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু করোনায় সেটি পিছিয়ে গেছে। কবে পরীক্ষাটি শুরু হবে তার সূচি এখনো ঠিক হয়নি। প্রাথমিকের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল ১৫ থেকে ২৩ এপ্রিলের মধ্যে। এ পরীক্ষাও ঠিক সময়ে হচ্ছে না। একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা ৩০ এপ্রিল থেকে ১৩ মে’র মধ্যে এবং নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিকের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা জুন মাসে হওয়ার কথা। কিন্তু সেটিও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ১ জুলাই থেকে একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু হওয়ার কথা, সেটির গতি কি হচ্ছে তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলো তাদের সেমিস্টার ভর্তি নিয়ে চিন্তিত। সবমিলিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় যে ধারাবাহিক রুটিন ছিল, তাতে বড়সড় ধাক্কা লেগেছে। দীর্ঘ এই ক্ষতি কিভাবে পোষানো হবে তার বিশ্লেষণ করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে এখন পর্যন্ত সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস প্রচার আর কিছু প্রতিষ্ঠানে অনলাইনে পড়াশোনা ছাড়া ক্ষতি পোষানোর দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগই নেই। সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস প্রচার নিয়ে রয়েছে নানামত।

বর্তমানে সংসদ টেলিভিশনে যেসব ক্লাস প্রচার হচ্ছে তাতে পিছিয়েপড়া স্কুলের কিছু শিক্ষার্থী উপকৃত হলেও শহর অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের কোনো লাভ হবে না। কারণ টেলিভিশেন যেসব ক্লাস প্রচার হচ্ছে শহর অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা পড়ে ফেলেছেন। গেল দশ বছর ধরে দেশে শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী চলা শিক্ষাব্যবস্থা করোনা ভাইরাসের কারণে ‘লণ্ডভণ্ড’ হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ঘোষণা অনুযায়ী সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগামী ১১ এপ্রিলের আগে চালু হচ্ছে না। শিক্ষাপঞ্জি অনুসারে রমজান, ঈদুল ফিতরসহ বেশকিছু ছুটি মিলিয়ে ২৫ এপ্রিল থেকে ৩০ মে পর্যন্ত এমনিতেই ছুটি থাকবে। এ ছাড়া চলতি এপ্রিল মাসে শবেবরাত, ইস্টার সানডে ও পহেলা বৈশাখের ছুটি রয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটি ও সরকারি ছুটি বাদে ১১ এপ্রিল থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ১১ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে। এর আগে, করোনায় গত ১৭ মার্চ প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়। সে হিসেবে ২৩ দিনের লকডাউনে লণ্ডভণ্ড শিক্ষাপঞ্জি ফিরিয়ে আনাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

একাধিক শিক্ষার্থী-অভিভাবক বলছেন, সিলেবাস অনুযায়ী স্কুলে পড়ানো হয়। এরপর প্রত্যেক শিক্ষার্থীই একাধিক প্রাইভেট-কোচিংয়ের দ্বারস্থ হয়। তার পরও ঠিকমতো প্রস্তুতি হয় না। অথচ এবার স্কুল বন্ধ, প্রাইভেট-কোচিং বন্ধ। তার পরও পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। আর স্কুল খোলার পর কোনো রকমে তাড়াহুড়ো করে সিলেবাস শেষ করা হলেও শিক্ষার্থীরা তা আত্মস্থ করতে পারবে না। এজন্য মেঘ কেটে গিয়ে যখন আলো আসবে তখন যে পরীক্ষা হবে সেই পরীক্ষাগুলোতে অপেক্ষাকৃত সহজ প্রশ্ন প্রণয়নের দাবি অভিভাবকদের। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক শিক্ষার শ্রেণি কার্যক্রম সংসদ টেলিভিশনে প্রচার হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে দেশের সেরা শিক্ষকদের ক্লাস করতে পারবে। প্রতিষ্ঠানে ক্লাস মিস হলেও পিছিয়ে পড়বে না শিক্ষার্থীরা। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলেও ক্ষতির শিকার হবে না শিক্ষার্থীরা। প্রয়োজন হবে না কোচিং কিংবা নোট-গাইডের। টিভিতে ক্লাস দেখানোর পাশাপাশি অনলাইনেও ক্লাস হচ্ছে। এতে ক্ষতি পোষাতে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন শিক্ষা পরিচালকরা। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সামান্য কয়েকটিতে অনলাইনে কিছু পাঠদান করানো হলেও ক্ষতি পোষাতে সহায়ক নয়। বহু বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সামার সেশনে ভর্তি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। এতে ছোট ও নতুন বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলো পথচলা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন ভোরের কাগজকে বলেছেন, করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঠিক কদিনের ক্ষতি হচ্ছে তা চিহ্নিত করার পর ঠিকঠাক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ক্ষতি পোষাতে বিরতিহীনভাবে কাজ চালানো হবে। তবে আপৎকালীন ক্ষতি পোষাতে সংসদ টেলিভিশনে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ক্লাস সম্প্রচার করা হচ্ছে। এতে সাময়িকভাবে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। তবে পুরো বিষয়রে ওপর আমাদের নজরদারি রয়েছে। এর আগে গত মঙ্গলবার করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে দেশব্যাপী চলমান কার্যক্রম সমন্বয়ের লক্ষ্যে মঙ্গলবার গণভবন থেকে ভিডিও সম্মেলনের সময় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ঘরে বসে সবাইকে পড়াশোনা করতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের কাছে এটা আমার অনুরোধ। একটা সুযোগ এসেছে ভালোভাবে পড়াশোনা করার। পড়াশোনার মাধ্যমে নিজেকে এখন থেকে প্রস্তুত করো যখনই পরীক্ষা আসবে তখনই যেন পরীক্ষা দিতে পারো। একই সঙ্গে ক্লাস যেন ধরতে পারো সেজন্য পড়াশোনা করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার এ সময় অনলাইন ও টেলিভিশনে ক্লাসের ব্যবস্থার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল পদ্ধতিতে স্কুলের ক্লাসগুলো আমরা করতে শুরু করেছি। ৬ষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত এই ক্লাসগুলো আমরা পর্যায়ক্রমিকভাবে করছি। ছেলেমেয়েরা ঘরে বসে থেকে লেখাপড়া যেন ভুলে না যায়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, করোনা ভাইরাসের কারণে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সংসদ টেলিভিশনে প্রচারের জন্য ভিডিও ক্লাস রেকর্ডিং করা হচ্ছে। শিগগিরই ক্লাস রুটিন তৈরি করে প্রচার করা হবে। জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম-আল-হোসেন বলেছেন, করোনা ভাইরাসের কারণে আমরা যে সংকটে পড়েছি, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষায় আমরা নতুন একটি দিগন্ত উন্মোচন করতে যাচ্ছি। অনেক সময় দেখা যায় শিশু শিক্ষার্থীরা ক্লাসে তাৎক্ষণিক পড়া বুঝতে পারছে না। ফলে তাদের কোচিং করাতে বাধ্য হন অভিভাবকরা। কিংবা নানা কারণে শিক্ষার্থীদের ক্লাস মিস হতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আমরা একটি নতুন অনলাইন পোর্টাল তৈরির পদক্ষেপ নিয়েছি। সেখানে বিষয়ভিত্তিক শ্রেণি কার্যক্রমের ভিডিও থাকবে। যা থেকে শিক্ষার্থীরা সারা বছর প্রয়োজন মতো তার পাঠ বুঝে নিতে পারবে। শুধু করোনা পরিস্থিতির জন্য এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা নয়, সারা বছরই শিক্ষার্থীরা এই ব্যবস্থায় পাঠ নিতে পারবে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ্ বলেছেন, শিক্ষার্থীরা অনলাইনে তার প্রয়োজনীয় ক্লাস বারবার দেখে তার বিষয়ভিত্তিক পাঠ আয়ত্ত করতে পারবে। শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় হয় এমন একটি নাম দেয়া হবে এই শ্রেণি কার্যক্রমের। ধারাবাহিকভাবে আমাদের এই কাজ চলবে। আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মাধ্যমিক ও সমমানের ফল প্রকাশের কথা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ওএমআর শিট দেখা স্থগিত করেছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। এছাড়া সব কিছু বন্ধ থাকায় লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের পর তা বোর্ডে ফেরত দিতে পারছেন না পরীক্ষকরা। এর ফলে ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশ নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। একইসঙ্গে আটকে গেছে উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা।

জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষাবোর্ডের সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেছেন, উত্তরপত্র মূল্যায়নের কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু স্ক্যানিংয়ের কাজ শেষ হয়নি। এপ্রিলের শেষ ১৫ দিন সময় পেলেও মে মাসের মধ্যেই মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ করতে পারব। আর করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অন্তত ১৫ দিন পর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা শুরু করতে পারব। সেক্ষেত্রে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা রমজানে অথবা ঈদের পরে শুরু হতে পারে বলে তিনি জানান। করোনার প্রাদুর্ভাবে গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে সব বিশ্ববিদ্যালয়। বন্ধ রয়েছে পরীক্ষাও। এমনকি বছরজুড়েই থাকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা পরীক্ষা। কিন্তু করোনার কারণে সব পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। জুলাই মাসে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়। নভেম্বরে ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু এবার যথাসময়ে ভর্তি প্রক্রিয়া ও ক্লাস শুরু করা সম্ভব হবে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালগুলোয় গ্রীষ্মকালীন সেমিস্টারের ভর্তি প্রক্রিয়া আটকে গেছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবীর হোসেন বলেছেন, কিছু বিশ^বিদ্যালয় ক্ষতি পোষাতে অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম শুরু করেছে। কিন্তু নতুন ও ছোট বিশ্ব বিদ্যালয়গুলো কিছুই করতে পারছে না। এতে তাদের বিশাল ক্ষতি হচ্ছে। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বড় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে গ্রীষ্মকালীন সেশনে শিক্ষার্থী ভর্তি করাচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ বিশ^বিদ্যালয় তা করতে পারছে না। এতে তাদের ক্ষতি হচ্ছে বেশি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App