×

মুক্তচিন্তা

একটু থামুন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২০, ০৯:৫৮ পিএম

একটু থামুন
মাঝে মাঝে একটু থামতে হয়। প্রয়োজন হয় একটি কমার। করোনা ভাইরাস মানুষের জীবনে সেই কমার কাজটি করে দিয়েছে। বাক্যের মাঝে ছোট্ট একটি কমা যেমন বাক্যটিকে সুন্দর গঠন দেয়; তেমনি ব্যস্ত মানুষের জীবনে এই থামাটা জীবনকে দেয় আরো গতি। আরো সৌন্দর্য। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন করোনাকালে গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষা জুটে গেছে মানুষের জীবনে। কিছু সময়ের জন্য নয়; করোনাকালের এই শিক্ষা চিরস্থায়ী হোক মানুষের জীবনে। চলুন একটা কমা দিই, গতির জন্য। হাত ধোয়ার অভ্যাস : হাত ধোয়া সব সময়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় প্রমাণিত, ২৫ ভাগ মানুষ ঠিকমতো হাত ধোয় না। আর এই করোনাকালে ছোট-বড় সবাই উৎসাহের সঙ্গে হাত ধোয়া শুরু করেছে। নিয়ম মেনে ২০ সেকেন্ড হাত ধোয়ার এই শিক্ষাটা স্থায়ী হোক সবার বেলায়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা : বাধ্য হয়ে বাসায় থাকা এবং করোনাভয়ে বাসাবাড়ি পরিষ্কার করছেন অনেকেই। এতে শুধু বাসা-বাড়ি পরিষ্কারই নয়; মশা-মাছির উপদ্রবও কমছে। পরিচ্ছন্ন এই পরিবেশ দেখে সিটি করপোরেশনের মুখেও যেন একসঙ্গে ছয় মাসের হাসি লেগে আছে। অভ্যাসটা নিয়মিত হোক। এতে করপোরেশনের কর্মীরা গাছ লাগানো বা সৌন্দর্যবর্ধনের কাজে মনোযোগ দিতে পারবে। শুদ্ধাচার : হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার গুটিকয়েক মানুষের মধ্যে চর্চা থাকলেও করোনাকালে তা ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের মাঝে। বেড়েছে রুমাল বা টিস্যুর ব্যবহার। যেখানে-সেখানে থুতু ফেলা, নোংরা করাসহ দৈনন্দিন জীবনে শুদ্ধাচারের যে বাতাস বইছে, সে বাতাস থাকুক সারা বছর, সব সময়। অল্পতেই সন্তুষ্টি : লকডাউনে একজন মানুষের জীবনে আসলে কত অল্প প্রয়োজন তা অনুভব করেছেন অনেকেই। কেউ কেউ তো কেবল চাল-ডাল-নুনেই সন্তুষ্ট। এমন দিনগুলো থেকে এ শিক্ষাটা গ্রহণ করেছেন অনেকেই। আবার করোনায় খাদ্য সংকট হবে এমন গুজবে খাদ্য মজুতকারী কেউ কেউ পরবর্তী সময় অনুতপ্তও হয়েছেন। অল্প খাওয়া, অল্প পরা, একটু শান্তিতে ঘুমানো অর্থাৎ চাহিদার জায়গায় নতুন করে বোঝাপড়ার সুযোগটা গ্রহণ করেছেন মানুষ। অতি ভোগকে বাতিল করার এই তো সুযোগ! অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা বর্জন : যদি করোনা না থাকত তবে এই সময়ের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটার তালিকায় কত কী যে থাকত; তার ইয়ত্তা নেই। অসময়ে শুধু শুধু চা খাওয়া, ক্ষুধা না থাকলেও স্ন্যাকস, এটা-ওটা কেনা, হোটেল-রেস্তোরাঁর বিল বাড়ানো ছাড়াও আরো কত কী! ঘরবন্দি মানুষ এ সময়ে নিজের অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটার ব্যাপারে সচেতন হতে পারছেন। ইচ্ছা-অনিচ্ছার ফাঁদে পড়ে অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা থেকে বিরত থাকার এই উপলব্ধি স্থায়ী হতেই পারে। সময়ের অপচয় রোধ : কাজ ছাড়া কতটা সময় অপচয় হতো তা খেয়াল করার সুযোগ এনে দিয়েছে করোনাকাল। সময়ের কতটা অপচয় করতাম তার হিসাব-নিকাশ চোখের সামনে আনলেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে সময়কে আমরা কতখানি ব্যবহার করছি। মানুষের ২৪ ঘণ্টা সময় যে কত বড় তাও টের পাচ্ছেন অনেকেই। করোনাকালে সময় সম্পর্কে এই সচেতনতা ধরে রাখার প্রতিজ্ঞাটা করে ফেলা যায় নিজের সঙ্গে। পরিবারকে সময় : অর্থ উপার্জন, সামাজিক যোগাযোগসহ বিবিধ ব্যস্ততায় পরিবারকে ঠিক সেভাবে সময় দেয়া হতো না দিনের পর দিন। পরিবারের মানুষগুলোকে লম্বা সময়ের জন্য পাওয়া গেল এ সময়ে। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার জায়গাটা আরো গভীর হলো। কাছের মানুষটার হাসি, সন্তানকে আরো একটু আদর করার এই উপলব্ধি সত্যিই বিরল সুযোগ করে দিয়েছে করোনাকাল। আত্মীয় বন্ধুদের খোঁজ নেয়া : কতদিন পর অবসর মিলল আত্মীয় বন্ধুর খবর নেয়ার। দীর্ঘদিন পর পুরনো মানুষগুলোর খোঁজ নিতে পেরে আবারো সেই বন্ধন ফিরে এসেছে অনেকের মাঝে। শারীরিক দূরত্ব থাকলেও সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধিতে মানুষে মানুষে এই সম্পর্কোন্নয়ন আবার শেকড়ে ফিরিয়ে নিয়েছে অনেককেই। জোড়া লেগেছে পুরনো অনেক সম্পর্ক। অটুট থাকুক সরাসরি এই সামাজিক যোগাযোগ। আড্ডা-গিবত বর্জন : অপ্রয়োজনীয় আড্ডায় কতটা না সময় যায় আমাদের। খরচের পাশাপাশি চলতে থাকে গিবত পরচর্চা-পরনিন্দা। নিজের দিকে তাকানো গেল এই সময়ে। গিবত, আড্ডা বা পরনিন্দা বন্ধ রাখার এই সময়টা চিরস্থায়ী হোক আমাদের জীবনে। মুক্তির জন্য চেষ্টা : দুর্যোগ এলে তা থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা চালায় মানুষ। করোনার এই সময়ে হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, পরিচ্ছন্ন থাকা, গুজবে পড়ে থানকুনি পাতা থেকে শুরু করে মানুষের কত না চেষ্টা। অর্থাৎ দুর্যোগ এলে তারপর সচেতন হই আমরা। বাঁচাতে চাই নিজেদের। প্রস্তুতিটা প্রয়োজন আগেই। শুধু দুর্যোগকালেই নয়, এই চেষ্টাগুলোকে যদি বছরভরে ভাগ করে নিয়মিত চর্চার শিক্ষাটা গ্রহণ করি, তবে কেমন হয়! প্রতিকূল পরিবেশেও স্থিরতা : প্রতিকূল পরিবেশে মানুষ অস্থির হয়ে পড়ে। আতঙ্কিত হয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। অস্থিরতার প্রভাব পড়ে কাজে-কর্মে, জীবনে। দুর্যোগকালে তাই স্থির থাকাটা খুবই জরুরি। অনেকে এ সময়ে ধ্যানচর্চা শুরু করেছেন। কেননা, যারা নিয়মিত ধ্যান করেন, প্রতিক‚ল পরিবেশে তারা তুলনামূলক বেশি শান্ত থাকতে পারেন। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সঙ্গী হতে পারে ধ্যানচর্চার এই শিক্ষা। ইবাদতে মনোযোগ : ভয়ে বা আতঙ্কে পড়ে মানুষের মধ্যে ইবাদত বা প্রার্থনায় মনোযোগ বেড়েছে সারা বিশ্বেই। নিয়মিত ধর্মচর্চা বা ধর্মের প্রকৃত শিক্ষার গুরুত্ব সব সময়ই মানুষের কল্যাণ বয়ে আনে। এ সময়ে শুধু নিজের জন্যই নয়, অন্যের জন্যও গভীর মমতায় প্রার্থনা করছে মানুষ। মানুষের জন্য মানুষের এই কল্যাণ চিন্তা সব সময়ই থাকুক, আন্তরিকতার সঙ্গে। সামাজিক চিত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন : একটু এদিক-সেদিক হলেই যে পুলিশ-প্রশাসনের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠত মানুষ; সেই পুলিশই আজ জীবন বাজি রেখে রাস্তার মোড়ে মোড়ে দায়িত্ব পালন করছে। মিলছে না ঘুষ বা অনিয়মের কোনো খবর। অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে নিচ্ছে ওসির গাড়ি। নিশিরাতে খাদ্যসামগ্রী বিলি হচ্ছে বস্তিতে। খাদ্যের পোটলা রিকশাওয়ালার হাতে গুঁজে দিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে প্রাইভেটকার। তরুণরা নিচ্ছে নানা উদ্যোগ। ক্রিকেটার, মিডিয়া ব্যক্তিত্বরাও সচেতন করছেন সাধারণ মানুষকে। মাঠে নেমেও কাজ করছেন কেউ কেউ। ধনাঢ্য ব্যক্তি থেকে শুরু করে অনেকের মধ্যে দানের মানসিকতা বেড়েছে। বেড়েছে স্বেচ্ছাসেবক। আতঙ্ক কাটিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে মানুষ। প্রকৃতিকে বিশ্রাম দেয়া : করোনাকালে কক্সবাজার সৈকতে কচ্ছপের ছড়াছড়ি। লাল কাঁকড়া দৌড়াচ্ছে মনের আনন্দে। সৈকতে জাগছে সাগরলতা। সমুদ্রের পানিতে নিজের জায়গা ফিরে পেয়ে ডলফিনের সে কী আনন্দ! রাজধানী ঢাকার বাতাসে ধুলাবালির মাত্রা নেই বললেই চলে। ফ্ল্যাটবাড়ির পাশের একটি গাছে কোত্থেকে এক কোকিল এসে বসেছে। ডাকছে কুহু কুহু। মানুষের তাণ্ডবে কতদিন এমন বিশ্রাম পায় না প্রকৃতি! প্রকৃতিকে ছুটি দেয়ারও কিছু সময় নির্ধারণ করা যেতে পারে। বিশ্বব্যাপী ঐক্যের ডাক : মানুষের প্রয়োজনেই একসময় এক হতে হয় বিশ্বের মানুষকে। করোনাকাল তেমনই এক সময়। বিশ্বব্যাপী চলছে তেমনই প্রস্তুতি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ঐক্য ও সংহতির গুরুত্ব অনুভব করছে সারাবিশ্বের মানুষ। মানুষের পাশে দাঁড়াবে মানুষ। সম্মিলিতভাবে পৃথিবীটাকে সুন্দরভাবে বাসযোগ্য করতে কাজ করবে একসঙ্গে এমন আশাই দানা বাঁধছে মানুষের মনে। চলুন একটা কমা দিই, একটু থামি। তারপর না হয় আবার ছুটে চলা, নতুন গতি নিয়ে! মোস্তাক আহমেদ : সাংবাদিক ও লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App