×

মুক্তচিন্তা

সামাল দিতে পারব তো?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০২০, ০৯:০৩ পিএম

বাংলাদেশে এখনো মহামারি আকারে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েনি। চীন, ইতালি-স্পেনসহ ইউরোপের কতক দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, ইরানসহ কতক দেশের ভয়াবহ রূপ আমরা এখনো সরাসরি প্রত্যক্ষ করিনি। কিন্তু এরই মধ্যে এই ভাইরাস সারাদেশকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। অর্থনীতির চাকা স্তব্ধ। খেটে খাওয়া মানুষের রুটি-রুজি নেই। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ক্লিনিক-ডাক্তারের চেম্বার বন্ধ হচ্ছে বা রোগী নিচ্ছে না বলে জানা যাচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এ অবস্থায় যদি সারাদেশে মহামারি আকারে এ ভাইরাস রোগ ছড়িয়ে পড়ে, তবে দুই দিক থেকে প্রথমত করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা প্রাপ্তি, দ্বিতীয়ত সাধারণ চিকিৎসা ও খাদ্য প্রাপ্তির কী হবে, তা সরকারের নানা ব্যবস্থা ও উদ্যোগ গ্রহণ, আশ্বাস এবং সামাজিক নানা উদ্যোগ চলমান সত্ত্বেও শিহরিত হয়ে উঠতে হয়। সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপার হলো, একবার যদি মহামারি আকারে তা দেখা দেয়, তবে তা কখন শেষ হবে তা কেউ হিসাব কষে বলতে পারবে না। বর্তমানের মতো এমন ভয় ও শঙ্কার মধ্যে ইতোপূর্বে দেশবাসী পড়েছে বলে মনে হয় না। অতীতে বাংলার মানুষ মহামারি মোকাবিলা করেছে। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়েছে। ওইসব মহামারি চলার সময়েও মানুষের ভরসা ছিল উপদ্রুত গ্রাম ছেড়ে দিয়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যাওয়া। ভয়াবহ সব দুর্ভিক্ষের গল্পও আমরা শুনেছি। মৃত্যু-লাশ, অনাহার-অর্ধহারের মধ্যেও নতুন ফসল গোলায় উঠবে বিবেচনায় মানুষ আশার আলো দেখতে পেয়েছে। কিন্তু এত উন্নতি ও অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও এখন মানুষ যেন কোনো আশার আলো দেখতে পারছে না। কেননা সারা বিশ্বই যে করোনায় আক্রান্ত। উন্নত দুনিয়াকে আমাদের দেশের মানুষ নিরাপদ আশ্রয় মনে করত। কিন্তু দেশের চেয়ে আমেরিকায় বেশি বাংলাদেশির আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যু সেই মিথকে ভেঙে খান খান করে দিয়েছে। এই অভ‚তপূর্ব অনিশ্চিত অবস্থায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দেশবাসীর এক হয়ে দাঁড়ানো। এ তো আর রাজনৈতিক ইস্যু নয় যে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় বা ফায়দা লোটার লক্ষ্য নিয়ে সব পরিকল্পনার ছক ও কাজ করতে হবে। এটা হচ্ছে মানবিক ইস্যু। প্রসঙ্গত করোনা আতঙ্কের মধ্যে সরকার যখন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে ৬ মাসের জন্য মুক্ত করে দেয়, তখন মনে হয়েছিল মানবিক ইস্যুতে আমাদের এক হয়ে দাঁড়ানোর একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি-রাজনৈতিক-সামাজিক-বেসরকারি সব উদ্যোগ সমন্বিত করে দাঁড়ানো হয়তো সম্ভব। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে তা হচ্ছে না কিংবা পরিস্থিতি সেভাবে অগ্রসর হচ্ছে না। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, ডান-বাম সব দিক থেকেই সরকার বিরোধিতা আর বিরোধিতার মধ্যে অসামঞ্জস্যতা সুস্পষ্ট। এর মধ্যে মন্ত্রী কারো কারো কথাবার্তা, এমপিদের এলাকায় এলাকায় এখনো প্রত্যক্ষভাবে না নামা, করোনা উদ্বেগের মধ্যেই নির্বাচন করা, ব্যবস্থাপনা ও উদ্যোগে কমতি, নিয়ম প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বাড়তি প্রভৃতির ফলে সরকারের প্রতি বিরূপতা বাড়ছে বৈ কমছে না। প্রসঙ্গত বলতেই হয়, আগে অনেক সময়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতা মানুষের মনে আশার সঞ্চার করত। কিন্তু এবারে মনে হচ্ছে তা হয়নি। প্রকৃত বিচারে এ অবস্থা যদি চলতে থাকে এবং তা যদি মহামারি আকারে দেখা দেয়, তবে সরকারের সব ব্যবস্থা ও উদ্যোগই একেবারে অপ্রতুল এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুল বলে বিবেচিত হবে। যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশের সরকার যেখানে অসহায় বোধ করছে; সেখানে আমাদের মতো দেশের কী অবস্থা হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। সারা দুনিয়া আজ যেখানে দিশাহারা, সেখানে আমাদেরও পদে পদে দিশাহারা অবস্থার মধ্যে পড়তেই হবে। এমন অনিশ্চিত-অস্থির ও হিমশিম-দিশাহারা অবস্থার মধ্যে সারা বিশ্বের মানুষ আগে আর কোনোদিন পড়েনি। প্লেগ, কলেরা, গুটিবসন্ত, যক্ষ্মা, স্পনিস ফ্লু প্রভৃতি অতীতের মহামারির কথা আমরা জানি। কিন্তু তখন তো আর বিশ্বগ্রাম ছিল না। একই দেশের বা মহাদেশের ভেতরে পর্যন্ত যাতায়াত, লেনদেন ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তেমন ছিল না। তাই মহামারি এতটা ছড়িয়ে পড়ার ভয় যেমন ছিল না কিংবা মানুষ খবরই রাখত না। মহামারি ছাড়াও ভ‚মিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, সুনামি কিংবা বিশ্বযুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি, দেশজয়, আঞ্চলিক যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও  মুক্তি সংগ্রাম ইতোপূর্বে বিশ্বকে নানাভাবে অনিশ্চিত-অস্থির ও আলোড়িত করেছে। সর্বোপরি পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত থাকায় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে একটা ভয় ও শঙ্কা মানুষের ছিল। তবুও একটা ভরসার জায়গা ছিল, বিশ্ব বহুকেন্দ্রিক হলেও শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রে পারস্পরিক ভারসাম্য আছে বিধায় যুদ্ধ লাগবে না। কিন্তু এবারের বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। চরম অসহায়ত্ব কাকে বলে তা একসময়ে একইভাবে সবাই টের পাচ্ছে। কিন্তু করোনা ভাইরাস নিয়ে এই অসহায়ত্ব কার কাছে, প্রকৃতি না মানুষের কাছে, তা মানুষ জানতে পারছে না। বিশ্ব রাজনীতি তথা আমেরিকা-চীন পারস্পরিক দোষারোপ ও পাল্টাপাল্টি সবটাকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। প্রসঙ্গত ডিসেম্বর ২০১৯-এর  শেষদিকে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহরে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে চীন এ বিষয়ে গুরুত্ব দেয়নি, গোপন করেছে। এমনকি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার লি ওয়েনলিয়াং ভয়াবহতার খবর প্রকাশ করায়, তা গুজব হিসেবে আখ্যায়িত করে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে ছেড়ে দেয়া হলেও ৭ ফেব্রুয়ারি তার এ ভাইরাসেই মৃত্যু হয়। প্রসঙ্গত চীনে যখন করোনা ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল, তখনই পালিত হয় মাসব্যাপী চীনা নববর্ষ এবং এবারে ১০ জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি ১৮ পর্যন্ত তা চলে। ‘বিশে^র বৃহত্তম মানবিক পরিভ্রমণে’ অংশ নিতে এই সময় প্রবাসী চীনারা দেশে যায়। অবস্থাদৃষ্টে ধারণা করা যায়, এতেই আরো বেশি করে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে করোনা ভাইরাস। প্রথম দিকে তথ্য গোপন করে এবং ভুল পদক্ষেপ নিয়ে অজ্ঞানতাবশত ভুল নাকি অপরাধ করেছে চীন, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে চীন সরকার এসব বিষয়ে তাদের ‘দুর্বলতা’ ও ‘ঘাটতি’ স্বীকার করে। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ ভাইরাসের ভয়াবহতা প্রথম দিকে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়নি। জানুয়ারি শেষ সপ্তাহে এ সংস্থার সভায় এ ভাইরাস নিয়ে সতর্ক করলেও ১৬ জন বিশেষজ্ঞের মধ্যে অধিকাংশের মত অনুযায়ী বলে যে, মহামারি আখ্যায়িত বা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার মতো অবস্থা এখনো হয়নি। এদিকে আমাদের মতো দেশগুলো তো নয়ই, ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত দেশগুলোও তেমন গুরুত্ব দেয়নি। সবশেষে এক মাসেরও বেশি সময় পর ৩১ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে এই সংস্থার প্রধান ‘আমরা এ বিপদকে খাটো করে দেখতে রাজি নই’ মন্তব্য করে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করে। প্রথম দিকে গুরুত্ব না দেয়াটা যে ভুল ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রকৃত বিচারে রোগের বিস্তৃতি ও ভয়াবহতার বিষয়টি গুরুত্ব না পেলেও প্রথম থেকেই পশ্চিমা প্রচার মাধ্যম করোনা ভাইরাসকে ‘চীনা ভাইরাস’ বলে আখ্যায়িত করে। এমনটাও প্রচার করা হয়, এ ভাইরাস প্রকৃতি সৃষ্ট নয়, উহান শহরের পরীক্ষাগারে গোপন জীবাণু মারণাস্ত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে এই ভাইরাস বাইরে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এ প্রচারের বিরুদ্ধে চীন অবস্থান নিয়ে বলে যে, মার্কিন সেনারা উহান প্রদেশে এ ভাইরাস আমেরিকা থেকে নিয়ে আসতে পারে। প্রথম আমেরিকায় এ ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়। আমেরিকাকে ‘স্বচ্ছ হও, তথ্য জানাও’ বলে উপদেশ দেয়। এই পাল্টাপাল্টির মধ্যে নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ও ওয়ার্ল্ড স্টিট জার্নালের ১৭ সাংবাদিককে চীন বহিষ্কার করে। আমেরিকা চীনা রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এর প্রতিবাদ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘জাতিবিদ্বেষ, ঘৃণা’ ছড়িয়ে পরিস্থিতি আরো জটিল না করার পরামর্শ দিলেও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনের প্রতি সাম্প্রতিক দিনগুলোতেও অভিযোগ উত্থাপন করে চলেছেন। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে সাধারণ বিবেচনায়ই ধারণা করা যায়, সময় যতই লাগুক, ক্ষতি যতই হোক, বৈজ্ঞানিকরা অচিরেই এই প্রাণঘাতী রোগের ওষুধও আবিষ্কার করবেন। কিন্তু এই ভাইরাস রাসায়নিক যুদ্ধের জন্য ল্যাবরেটরিতে সৃষ্ট নাকি প্রকৃতি সৃষ্ট, নাকি প্রকৃতিকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করায় প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে প্রভৃতি অভিযোগ এখন বন্ধ করা প্রয়োজন। মানব জাতির অভিন্ন শত্রু কে পরাজিত বা কোণঠাসা করতে বিশ^সমাজের সম্মিলিত প্রয়াসের জন্য এটা আজ একান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজন রাসায়নিক ও পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর পরীক্ষা বন্ধ করা, প্রকৃতিকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার বন্ধ করা। কেউ রক্ষা পাবে না বিবেচনায় সামরিক খাতে ব্যয় সংকুচিত করে স্বাস্থ্য গবেষণা ও চিকিৎসা খাতে বাজেট বাড়ানো ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ আজ সময়ের দাবি। প্রসঙ্গত বলতেই হয়, চীন প্রথম দিকে বিষয়টি গোপন রাখতে চাইলেও এই মহামারি প্রতিরোধে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। চীনের উদাহরণ কাজে লাগানো আজ জরুরি প্রয়োজন। কিন্তু এটাও দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, ভাইরাস চিকিৎসার জন্য চীনের টেস্টিং কিট ত্রু টিপূর্ণ হওয়ায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অভিযোগ করেছে এবং তা ফেরত পাঠাচ্ছে। এই দুর্যোগের সময় ব্যবসা ক্ষেত্রে দুই নম্বরি কাজ একেবারেই বন্ধ করা প্রয়োজন। এদিকে খবরে দেখা যাচ্ছে, এ অবস্থায় মধ্যেও যুদ্ধ জাহাজের উদ্দেশ্যমূলক চলাচল নাকি হচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবিলার সময়ও দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রশ্ন যখন আসে, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আধিপত্য তথা ভ‚-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-ব্যবসায়ের স্বার্থের বিষয়টা সামনে আসে; তখন কেন যেন ব্যবস্থা নির্বিশেষে সব দেশের নীতি কথা পাল্টে যায়। তখন চলতে থাকে পাল্টাপাল্টি। তাতে মানুষ পড়ে শাঁখের করাতের মধ্যে। বিশ্বের অগণিত মানুষকে নিরন্ন, বাসস্থানহীন, চিকিৎসা বিপজ্জনক অবস্থায় রেখে সামরিক প্রস্তুতি এবং এমনকি পারমাণবিক বোমা, রাসায়নিক বা জীবাণু অস্ত্র বানানোর প্রতিযোগিতাও চলে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দেশ নির্বিশেষে বিশ্ব যে কতটা অসহায় ও পিছিয়ে আছে, তা  করোনা ভাইরাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। এখন সামাল দেয়া যাবে কীভাবে, এটাই আজকের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন? শেখর দত্ত : রাজনীতিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App