×

জাতীয়

করোনা সংকটে সংবাদপত্র

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২০, ১০:৪৩ এএম

করোনা সংকটে সংবাদপত্র

বাংলাদেশ সংবাদপত্রসমুহ।

করোনা সংকটে সংবাদপত্র

শ্যামল দত্ত, সম্পাদক, দৈনিক ভোরের কাগজ।

সিঙ্গাপুর সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে যারা জীবনযাপন করেন তাদের বাড়িতে প্রতি মাসে ১ হাজার ৮শ ডলার পৌঁছে দেয়া হবে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ঘোষণা দিয়েছেন মানুষের বাড়ি বাড়ি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও অন্যান্য সামগ্রী পৌঁছে দেবে সরকার। এমনকি পাশের দেশ ভারতে দরিদ্রদের জন্য আর্থিক সহযোগিতায় ১শ মিলিয়ন ডলার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেয়ার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এছাড়াও দরিদ্রদের জন্য ১০ টাকা কেজিতে চাল বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

এক নজিরবিহীন ভাইরাসের মুখোমুখি হয়ে বিশ্ব অর্থনীতি যখন তছনছ, তখন একেক দেশ একেকভাবে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে এই পরিস্থিতিকে। ৩৩ কোটি নাগরিকের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি নাগরিকের সম্পদের পরিমাণ ৩ লাখ ডলারেরও বেশি। তারপরও সে দেশের প্রতিটি মানুষের খাদ্য ও দৈনন্দিন জীবনযাপন নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতালিতে প্রতি নাগরিকের অ্যাকাউন্টে জমা হচ্ছে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে মানুষকে ও শিল্পকে বাঁচাতে এই নানা উদ্যোগের মাঝে গণমাধ্যম, বিশেষ করে সংবাদপত্রের কী হবে- তা নিয়ে কেউ ভেবেছেন বলে মনে হচ্ছে না।

সংবাদপত্রও একটি শিল্প এবং করোনার প্রভাবে এক নজিরবিহীন সংকটের মুখোমুখি এ শিল্প। অন্যান্য দেশে সংবাদপত্রের কী অবস্থা, তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে বাংলাদেশের টানা ১০ দিনের ছুটি বা অঘোষিত লকডাউনে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এই শিল্প। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। ঘরবন্দি দেশের মানুষ। বাসায় বাসায় যেখানে মানুষ ঢুকতে পারছে না, সেখানে হকার ঢুকে পত্রিকা বিলি করবে এমন বাস্তবতা বোধ হয় এখন আর নাই। সারাদেশে ২৫টি জেলার হকাররা পত্রিকা বিলি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এ অবস্থায় ভেঙে পড়েছে সংবাদপত্রের বিলি-বিতরণ ব্যবস্থা। সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ। তাই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রায় শূন্যের কোটায়। এই অবস্থায় সংবাদপত্র ছাপানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্যাবলয়েড দৈনিক মানবজমিন কর্তৃপক্ষ তাদের পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যান্য পত্রিকা পৃষ্ঠা সংখ্যা কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে। কেউ কেউ বন্ধের কথাও ভাবছে।

শত বছরের মুদ্রণ গণমাধ্যমের ইতিহাসে এই সংকট সম্ভবত নজিরবিহীন। রাষ্ট্রযন্ত্র অতীতে বহু দেশে নানা পরিস্থিতিতে সংবাদপত্র বন্ধ করেছে অথবা সংবাদপত্র কখনো কখনো বন্ধ হয়েছে কর্তৃপক্ষ অথবা সাংবাদিকদের প্রতিবাদ হিসেবে। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারির প্রভাবে বিপর্যস্ত অর্থনীতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে সংবাদপত্রের সংকটের ঘটনা সম্ভবত এই প্রথম। এই অবস্থায় কিভাবে সংবাদপত্র প্রকাশনা শিল্প অব্যাহত থাকবে তা একটা বড় প্রশ্ন।

প্রশ্নটা হচ্ছে, নানা সংকটে, দুর্যোগে, এমনকি যুদ্ধ পরিস্থিতি তো সংবাদপত্রের প্রকাশনা অব্যাহত ছিল। বর্তমান মহামারির সংকটে সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ রাখা কতখানি যৌক্তিক হবে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রচলিত গণমাধ্যম যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে অপ্রচলিত গণমাধ্যম যা সোশ্যাল মিডিয়া নামে পরিচিত, তা নতুন ঝুঁকি তৈরি করবে কিনা বিবেচনা করতে হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ কয়েকবারই এ ধরনের খারাপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে। দুর্যোগ পরিস্থিতিতে অন্যান্য শিল্পের সংকটে যদি সরকার এগিয়ে আসে তাহলে সংবাদপত্র শিল্পের সংকটেও সরকারের কাছে সহযোগিতা প্রত্যাশা মনে হয় অযৌক্তিক নয়। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে সংবাদপত্রগুলোর পাওনা অনেক। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে যদি সংবাদপত্র কর্মীদের বেতন দিতে হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা ছাড়া সেটা একেবারেই অসম্ভব। যেখানে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি সব অফিস বন্ধ থাকবে, সেখানে বিশেষ উদ্যোগে সংবাদপত্রগুলোর বিল আদায়ের ব্যবস্থা যদি সরকার না করে- তাহলে বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়বে সংবাদকর্মীরা।

সংবাদপত্রের এই নজিরবিহীন সংকটেও ভোরের কাগজ মুদ্রণ বন্ধ করার পক্ষে নয়। প্রয়োজনে আকারে ছোট করে হলেও আমরা আমাদের প্রকাশনা অব্যাহত রাখার পক্ষে। কারণ সংকটে টিকে থাকার সাহস তো আমাদের থাকাটা জরুরি। আমাদের মনে রাখতে হবে সংবাদপত্রবিহীন সমাজ এখন আমরা কল্পনাও করতে পারি না। টেলিভিশন এবং অন্যান্য গণমাধ্যমের আগ্রাসী অগ্রগতির মাঝেও সংবাদপত্রের জন্য ভালোবাসার মানুষের কমতি নেই। তাই আজ থেকে ভোরের কাগজ ৮ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়ে অব্যাহত রাখছে তার প্রকাশনা। আশা করি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসলে ভোরের কাগজ আবার ফিরে আসবে পুরনো চেহারায়। সেই পর্যন্ত পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের শুভকামনা প্রয়োজন। সংকট মোকাবিলায় আমরা যেন একে অপরের পাশাপাশি থাকি, সকলের কাছে প্রত্যাশা সেটাই। এ কথা মনে রাখতে হবে, মহামারির সংকটে প্রকৃত স্বাস্থ্যসেবা যেমন জরুরি, তেমনি সত্যনিষ্ঠ তথ্যসেবাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। শেষ করতে চাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের সেই ঐতিহাসিক উক্তি দিয়ে। তার কাছে প্রশ্ন ছিল, একটি সংবাদপত্রবিহীন সরকার অথবা সরকারবিহীন সংবাদপত্রের মধ্যে আপনি কোনটি বেছে নিতে চান? জেফারসনের উত্তর ছিল, আমার পছন্দ থাকবে সরকারবিহীন সংবাদপত্রের দিকে।

আরো পড়ুন- অবরুদ্ধ দেশে নজিরবিহীন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন এক ক্ষণজন্মা মানুষের মহাজীবন বদলে যাবে গণমাধ্যম? ভোরের কাগজের ২৬ বছর : সম্ভাবনার পথে অগ্রযাত্রা

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App