×

মুক্তচিন্তা

কলেরা, কালাজ্বর ও করোনা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২০, ০৮:০১ পিএম

বিস্তার ও সংক্রমণ ঠেকাতে ‘বিচ্ছিন্নতা’ ও ‘সঙ্গনিরোধ’। পাশাপাশি প্রতিষেধক ও চিকিৎসার জন্য গবেষণা তৎপরতা। এত খোদ আমাদের জল-মাটির অভিজ্ঞতা। তাহলে আমরা কেন পারব না? কলেরা ও কালাজ্বর আমরাই সামাল দিয়েছি। ডেঙ্গু কী চিকুনগুনিয়াতে আমরাই তো লড়ছি। করোনাকেও আমরা সামাল দেব।

কলেরা, কালাজ্বর, করোনা (কোভিড-১৯)। তিনের ভেতর কেমন যেন এক মিল! বাংলায় বললে প্রতিটি ‘ক’ বর্ণ দিয়ে শুরু। মানুষের রোগ হিসেবে তিনটিই বৈশ্বিক মহামারির কারণ। চলমান করোনা চীন থেকে ছড়ালেও কলেরা আর কালাজ্বরের উৎস বাংলা অঞ্চলেই। যদিও মহামারি তিনটির কারণ তিন ধরনের অদৃশ্য অণুজীব। কলেরা ব্যাক্টেরিয়া, কালাজ্বর প্রোটোজোয়া আর কোভিড-১৯ হচ্ছে ভাইরাসের সংক্রমণে। দুনিয়া এখন দুর্বিষহ করোনার ক্রান্তিকাল পাড়ি দিচ্ছে। একইসঙ্গে এখনো টিকে আছে কলেরা কী কালাজ্বর। কোনো মানুষ যখন আক্রান্ত হয় তখন রোগটি তার কাছে এক নির্মম স্মৃতি হয়ে ওঠে, কিন্তু ‘অসুস্থ ব্যক্তির’ সঙ্গে তার পরিবার, কখনো প্রতিবেশী কী সমাজ সবাই এক যন্ত্রণাময় স্মৃতিতে জড়িয়ে পড়ে। এভাবে ইতিহাস থেকে ইতিহাসে ‘রোগ’ আর কোনো একক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হিসেবে থাকে না, এর নানামুখী যন্ত্রণা ও আশঙ্কা ছড়িয়ে যায় সমষ্টির ভেতর। কোনো রোগ যখন মানুষের সমাজে মহামারি তৈরি করে তখন আক্রান্ত ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতাগুলো ভিন্ন হলেও পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কী বৃহৎ জনপরিসরে তা এক সামষ্টিক বয়ান হাজির করে। কাল থেকে কালে মহামারির স্মৃতি বড় নির্মম, এর ছাপ বড়ই নির্দয়। সজনার হাওরে একবার এক প্রবীণ নারীর গল্প শুনেছিলাম, গুটিবসন্তের দাগের কারণে তার বিয়ে হচ্ছিল না, দাগ ঢাকতে গলায় বিষও ঢেলেছিলেন। কীভাবে যেন বেঁচে যান আর সংসারে জড়িয়ে পড়েন। তার কুঁচকানো চামড়ার ভাঁজে জমে থাকা অশ্রুদানায় টগবগ করে ওঠে মহামারির কত বলা না বলা যন্ত্রণাময় সামাজিক স্মৃতি। গাছ যেমন তার বর্ষবলয়ে বয়ে চলে প্রতি বছরের আপদ-বিপদের খতিয়ান, মানুষের সমাজেও মহামারির স্মৃতি টগবগ থাকে নানা গুঞ্জরণে। আর তাই কোনো রোগ বা অসুখ কেবল ‘চিকিৎসাশাস্ত্রী রোগতত্তে¡র’ বিষয় হিসেবে বন্দি থাকে না। রোগের নানামুখী বিস্তার একে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক করে তোলে। এই নির্দয় করোনারকালেও আমরা নানামুখী অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই লড়ছি। জানি লিঙ্গ, জাতি, ভাষা, বর্ণ, শ্রেণি কী বর্গ ভেদে এই অভিজ্ঞতা অভিন্ন নয়। দুই. প্রকৃতির অসুস্থতাই মানুষের সমাজে ‘রোগ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই রোগ ক্রমান্বয়ে ‘অসুখ’ ও ‘মহামারি’ তৈরি করে। রোগের সঙ্গে উপনিবেশ আর উন্নয়নের এক গভীর যোগসূত্র আছে। কলম্বাস যেমন লাল আদিবাসীদের আমেরিকায় নানা রোগ-ব্যাধি নিয়ে গেয়েছিলেন, এই বাংলাতেও উপনিবেশকালে বহিরাগতদের মাধ্যমে ঘটেছে নানা রোগের বিস্তার। মানুষের লাগামহীন চলাচলই রোগের সংক্রমণকে মহামারি করে তোলে। চলতি করোনারকালেও বাংলাদেশ আক্রান্ত হয়েছে দেশের বাইরে থেকে আসা মানুষের মাধ্যমেই। যখন দেশে প্রথম রেললাইন হলো, বাড়ল ম্যালেরিয়া। একইভাবে দেশে কয়েক বছরে মেট্রোরেলসহ দশাসই সব উন্নয়ন প্রকল্প ডেঙ্গু কী চিকুনগুনিয়ার বিস্তার বাড়িয়েছে। আবার এই রোগের বিস্তার ও সংক্রমণ রোধে তৈরি হয় রাষ্ট্র কী বহুজাতিক কোম্পানির নানা কর্তৃত্ব। দরিদ্র মানুষের শরীর হয়ে ওঠে নতুন প্রতিষেধ বাণিজ্যের বায়োমেডিকেল গবেষণার মাঠ। কোনো মহামারি কেবল মৃত, সুস্থ কী আক্রান্ত মানুষ, কী ভ‚গোলের পরিসংখ্যান মাত্র নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নানামুখী শঙ্কা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, অনাস্থা, আহাজারি, গুজব, আতঙ্ক কী আশার হাতছানি। মহামারি অনেক কিছু বদলে দেয়, তছনছ করে ফেলে।

পারিবারিক গল্পের আঙিনা থেকে হাটবাজার, কারখানা থেকে উৎপাদন, ব্যক্তিগত অভ্যাস থেকে রাষ্ট্রনীতি, স্থাপত্য পরিকল্পনা থেকে বৈশ্বিক কর্তৃত্ব। কিন্তু শেষমেশ এই ‘রোগের বিশ্বায়ন’ আমাদের কী শিক্ষা দেয়? আমরা কি কিছু শিখি না শিখতে চাই? কলেরা, প্লেগ, কালাজ্বর, বসন্ত, হাম, ম্যালেরিয়া, ইবোলা, চিকুনগুনিয়া, স্প্যানিশ ফ্লু, অ্যানথ্রাক্স ইতিহাসে একের পর এক মহামারি। কিন্তু প্রজাতি আমরা কী শিখলাম? আমরাই তো করোনার বিস্তার ও সংক্রমণ ঘটিয়ে চলেছি। আমরা ‘সঙ্গনিরোধ (কোয়ারেন্টাইন)’ মানছি না। একটি এলাকাকে বিশেষ সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন (লকডাউন) করে রাখতে পারছি না। কিন্তু কেন? রোগের বিস্তার ও মহামারি ঠেকাতে সঙ্গনিরোধ কী বিচ্ছিন্নতা তো আমাদের কাছে কোনোভাবেই নতুন নয়। কলেরা কী কালাজ্বর, বসন্ত কী ম্যালেরিয়ারকালে আমাদের গ্রাম-জনপদে এমনতর বহু নিম্নবর্গীয় সুরক্ষার চল ঘটেছিল। আমরা তখন মহামারিকে সমষ্টির অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই দেখেছি। আমরা একক ব্যক্তির রোগ নয়, মহামারি থেকে গ্রামের সুরক্ষা দিতে লড়েছি। আমরা কেন করোনারকালে আমাদের মহামারি সামাল দেয়ার সেসব সমষ্টিগত অভিজ্ঞতাকে স্মরণে আনতে পারছি না? এমন স্মৃতিবিমুখ প্রজন্ম কেন হয়ে উঠছি আমরা? তাতে কার লাভ, কার ক্ষতি? চরম ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য আমাদের সমষ্টি থেকে ক্রমান্বয়ে বিচ্ছিন্ন করে বাজারমুখী করছে। আমরা মুখিয়ে আছি কোন কোম্পানি কবে একটা প্রতিষেধক বাজারে ছাড়বে আর আমাদের যাদের সামর্থ্য আছে তারাই বাঁচব। কিন্তু আমরা কোনো নির্দেশনা মানব না। তিন. মহামারিকালে ‘রোগ’ এমন সব সামাজিক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে বাহিত হয়, যখন তার স্থানীয় পরিচয় ও পরিধি নির্মিত হতে থাকে। ওলাওঠা নামের এক রোগে ভুগত গ্রামবাংলার মানুষ। ১৮ শতকে এই ওলাওঠা রোগটিই বিশ্বব্যাপী কলেরা নামে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। কলেরার বিস্তার ঠেকাতে অনেক গ্রামে ওলাদেবীর থান গড়ে ওঠেছিল। ওলাদেবীর পূজা, মাগন ও মানত হতো সেখানে। এমনকি গুটিবসন্ত ঠেকাতেও গ্রামীণ নিম্নবর্গ শীতলাদেবীর থান তৈরি করেছে। শীতলাদেবীর সারা গায়ে গুটিবসন্তের দাগ। কোনো গ্রামে ওলাওঠা কী গুটিবসন্ত ছড়িয়ে গেলে মানুষ ‘গ্রামবন্ধ’ করে দিত কিছুদিনের জন্য। বাইরের কেউ গ্রামে ঢুকতে পারত না, গ্রামের কেউ বেরুতে পারত না। টানা কয়েক বছর এমন অভিজ্ঞতার ফলে মৌসুমভিত্তিক রোগ সামাল দেয়ার জন্য গ্রামবাংলার মানুষের মনস্তাত্তি¡ক প্রস্তুতিও গড়ে ওঠেছিল। টাঙ্গাইল শালবন এলাকায় আঠার শতকের শেষ থেকে উনিশ শতকের শুরুতে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে কালাজ্বর। মান্দি বা গারো ভাষায় বলে বারেংগিসিম। কেবল মৃত্যু নয়, কালাজ্বরের প্রভাব মাতৃসূত্রীয় মান্দি সমাজের বিয়ে ও সম্পত্তি বণ্টনের অনেক ঐতিহ্যগত প্রথাকেও বদলে দিয়েছিল। পরিবারের কনিষ্ঠ কন্যা যাকে ‘নকনা’ নামে ডাকা হয় সচরাচর তিনিই বংশগত সম্পত্তির মূল উত্তরাধিকার হয়ে থাকেন। চলমান করোনা সংকটে আমরা কেন সঙ্গনিরোধ আর লকডাউন সফল করে তুলব না? চার. কোনো রোগ তখনি মানুষের সমাজে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে যখন তার চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা সবার জন্য মামুলি হয়ে ওঠে। কলেরা, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, হামের চিকিৎসা সহজ হয়েছে এমনকি এসব সামালের নানা স্থানিক পদ্ধতিও গড়ে উঠেছে। গ্রামবাংলায় এসব রোগ নিয়ে সেই শঙ্কা আর নেই। ওলাওঠা দেবীও তাই একেবারেই হারিয়ে গেছেন। তবে নিকট অতীতের গুটিবসন্তের স্মৃতি এখনো গ্রামীণ নি¤œবর্গকে শঙ্কিত করে তোলে। রোগটি নির্মূল হলেও এখনো গ্রামে গ্রামে রয়ে গেছে শীতলা পূজার থান, এখনো সেখানে পূজা হয়, মানত করে মানুষ। কারণ গুটিবসন্তের লোকায়ত চিকিৎসাও তেমন একটা নেই। গ্রামবাংলার মানুষের মহামারি সামাল দেয়ার বহুমুখী ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাগুলো থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি। প্রথমত, তারা মহামারিকে একটা সামাজিক বিপদ হিসেবে দেখেছেন। ব্যক্তি নয়, সামষ্টিক সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ‘সাময়িক বিচ্ছিন্নতা’ ও ‘সঙ্গনিরোধের’ কঠোর নিয়ম পালন করেছেন। এই বিচ্ছিন্নতা ও সঙ্গনিরোধ যেন মানসিক শক্তি জোগাতে পারে তাই এসব নিয়ম কৃত্য ও পার্বণেও রূপ নিয়েছে কখনো। পরবর্তীতে রোগের চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিয়েছেন। নানান লোকায়ত চিকিৎসা, ওষুধ ও পথ্যকে গ্রামীণ কবিরাজির ভেতর দিয়ে সামাজিকভাবে সুলভ করে তোলার চেষ্টা করেছেন। পাঁচ. করোনা মহামারি সামাল দিতে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্ব যে ‘উহান কাঠামো’ গ্রহণ করেছে তার সঙ্গে বাংলার মহামারি সামাল দেয়ার নি¤œবর্গীয় অভিজ্ঞতার কোনো অমিল নেই। বিস্তার ও সংক্রমণ ঠেকাতে ‘বিচ্ছিন্নতা’ ও ‘সঙ্গনিরোধ’। পাশাপাশি প্রতিষেধক ও চিকিৎসার জন্য গবেষণা তৎপরতা। এত খোদ আমাদের জল-মাটির অভিজ্ঞতা। তাহলে আমরা কেন পারব না? কলেরা ও কালাজ্বর আমরাই সামাল দিয়েছি। ডেঙ্গু কী চিকুনগুনিয়াতে আমরাই তো লড়ছি। করোনাকেও আমরা সামাল দেব।

পাভেল পার্থ : গবেষক ও লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App