×

সম্পাদকের কলাম

অবরুদ্ধ দেশে নজিরবিহীন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন

Icon

osman sorkar

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২০, ০৬:৪৫ পিএম

এক নজিরবিহীন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করলো বাঙালি জাতি। ঘরে অবরুদ্ধ থেকে, নিস্তব্ধ ভয়ার্ত এক পরিবেশে, এক অভূতপূর্ব স্বাধীনতা উদযাপন। ঘরবন্দি মানুষ, রাস্তাঘাট সুনসান। ভয়ে সন্ত্রস্ত আর পরাধীন-পরাধীন অনুভূতি। অথচ দিনটি ছিল আমাদের স্বাধীনতা দিবস। বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র পাওয়ার রক্তভেজা সংগ্রামের শুরুর দিন। দীর্ঘ শোষণ থেকে বাঙালির মুক্তি পাওয়ার দিন। এমন কোনো আবেগহীন স্বাধীনতা দিবস কি বাঙালি গত ৪৯ বছরে কখনো পালন করেছে? সকালে গণমাধ্যমকর্মীরা যখন সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে গেছে, দেখেছে জনমানবশূন্য খাঁখাঁ করছে পরিবেশ। বড় নিঃসঙ্গ একাকি দাঁড়িয়ে লাখো শহীদের স্মৃতির মিনার জাতীয় স্মৃতিসৌধ। বাঙালি জাতির সঙ্গে জাতীয় স্মৃতিসৌধও যেন লকডাউন। কাউকে যেন কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। নিরন্তর চেতনায় আলো জ্বালানো স্মৃতিসৌধ তাই আজ ম্লান, বিষণ্ণ, বাঙালির চিন্তায়, বাংলার চিন্তায়। কেমন করে মোকাবিলা করবে এই নজিরবিহীন সংকটকে, বৈশ্বিক মহামারিকে। করোনা ভাইরাসের কারণে পুরো বাংলাদেশ যে আজ বহুমাত্রিক সংকটের মুখোমুখি, তাকে সামলাবে কীভাবে? ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চেও একই ধরনের পরিস্থিতি ছিলো। দেশ জুড়ে কারফিউ। পাকিস্তানী বাহিনী আর কসাই টিক্কা খানের বর্বরতায় ভয়ে আতঙ্কে ঘরবন্দি মানুষ আর রাস্তায় রাস্তায় মানুষের স্তূপ করা লাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলসহ বিভিন্ন স্থানে মাটিতে ছুইয়ে ছুইয়ে তখনো মিশছে বাঙালির রক্ত। পিলখানা আক্রান্ত, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে সারি সারি বাঙালি পুলিশের মৃতদেহ। যদিও “বুচার অব বেলুচিন্তান” বা বেলুচিস্তানের কসাই হিসেবে খ্যাতিপ্রাপ্ত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক পরে ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক খুশবন্ত সিংকে মিথ্যাচার করে বলেছিলেন, মাত্র ৯৭ জন বাঙালি মারা গেছে ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটে। শ্বাসরুদ্ধকর এই পরিবেশে ঢাকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলেন ৩৫ জন বিদেশি সাংবাদিক, যারা পরবর্তী সময়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন পাকিস্তানি নির্মম বর্বরতার নৃশংস চিত্র। ব্রিটিশ টেলিগ্রাফের সাইমন ড্রিং, নিউইয়র্ক টাইমস-এর সিডনি সনবার্গ, বিবিসি-এর মার্ক টালি, দ্যা টাইমস-এর এম রোজেনথাল, এমনকি পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটেন প্রবাসী এ্যান্তনী মাসকারেনহাস-এর অবরুদ্ধ ঢাকার রিপোর্ট আলোড়ন তুলেছিলো বিশ্বে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের অবরুদ্ধ ঢাকা আর আজ ২০২০ সালের অবরুদ্ধ ঢাকা যদিও ভিন্ন, কিন্তু বোধে, চেতনায়, আতঙ্কে ঘরবন্দি মানুষ যেন অসহায়ত্বের বেদনায় কাতরাচ্ছে একই ভাবে। একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ টগবগ করে এগুচ্ছিল। পাল্টাতে শুরু করেছে মানুষের জীবনযাত্রা। ধনী-গরিবের পার্থক্য বাড়লেও গরিবের সংজ্ঞা পাল্টাচ্ছিল দ্রুত। বড় বড় প্রকল্প, মানুষের স্বপ্নের চাইতেও উঁচু হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। পুরো জাতি যখন প্রবল আনন্দ-উদ্দীপনায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে উন্মুখ, তখন বিশ্বজুড়ে আঘাত হানা এক অজানা ভাইরাস তছনছ করে দিল সবকিছু। পুরো দেশের ওপর ছেয়ে গেল যেন এক বিষণ্ণতার চাদর। উদ্বিগ্ন-উদভ্রান্ত মানুষ এখন ঘরবন্দি। বুঝতে পারছে না কবে মুক্তি, কীভাবে মুক্তি। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ চিন্তায় ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। চাকরিজীবীরা অসহায়। দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষ চরম সংকটে। কারো কাছেই কোনো স্পষ্ট জবাবও নেই কোনো কিছুর। সংকটটা সবার। তাই জবাব নেই কোথাও। মিলান থেকে মিরপুর। সর্বত্র পরিস্থিতি একই। রোগ আছে, রোগী আছে। চিকিৎসা নেই, ওষুধ নেই, মানুষ মরছে অকাতরে। যুক্তরাষ্ট্রে, যুক্তরাজ্যে, ইতালিতে, চীনে, ফ্রান্সে, স্পেনে, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। সব দেশকে গেঁথে ফেলেছে এক ভাইরাস। ফার্সি কবি শেখ সাদি বলেছিলেন, পৃথিবীর সব মানুষের জাত কিন্তু একটাই। করোনা মনে হয় আমাদের সেই বোধটাই তৈরি করছে। পুরো বিশ্ব থমকে গেছে এক ছোট ভাইরাসের মুখোমুখি হয়ে। কয়েকদিন আগেও যারা হুমকি-ধমকি দিতে ব্যস্ত ছিলেন, সামান্য ভাইরাসের সামনে তারা ভয়ে ভীত। নানা রকম মারণাস্ত্র তৈরি করে যারা মানুষ মারার আয়োজন করেছিলেন, ভাইরাস মোকাবিলার জন্য তারা কোনো অর্থ বরাদ্দ রাখেননি। তাই মানুষের প্রাণ যাচ্ছে অকাতরে। স্বামীর সামনে মারা যাচ্ছে স্ত্রী, স্ত্রীর সামনে স্বামী, সন্তানের সামনে পিতা-মাতা। মানুষের অন্তিম যাত্রায়-স্নেহ-মায়া-মমতায় ছুঁয়ে দেখার সুযোগটুকুও নেই। কেমন সমাজ আমরা তৈরি করলাম আমরা, যেখানে মৃত্যুর সময় পাশে থাকার সুযোগটাও নেই। এটাই কি সভ্যতা! কেউ কেউ বলছেন, ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’। সভ্যতার নামে ধ্বংস করেছি প্রকৃতিকে। প্রকৃতি তাই নিজেই বদলে নিচ্ছে নিজেকে। সারা পৃথিবীতে এখন বায়ুদূষণ সর্বনিম্ন। কার্বন নিঃসরণ কমে গেছে বহুলাংশে। যারা বহু দিন নির্মল আকাশ দেখেননি, তারা এখন স্নিগ্ধ চাঁদ দেখছেন পুরো পরিবার নিয়ে ছাদে গিয়ে। এক টিভি রিপোর্টে দেখা গেল, ইতালির উপকূলে আবার ফিরে এসেছে ডলফিন। প্রাকৃতিক বনে আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে বন্যপ্রাণীরা। আজ মানুষ যখন ঘরের ভেতরে, মানুষের অবৈধ দখলে থাকা বাইরেরটা তখন তাদের দখলে, যাদের দখলে এটা একসময় ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা এ থেকে কোনো শিক্ষা নেব? নাকি অপেক্ষায় থাকব অন্য কোন সময় নতুন করে আসা অন্য একটি অজানা ভাইরাসের কাছে আবার অসহায় আত্মসমর্পণের জন্য। আরো পড়ুন-

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App