×

বিশেষ সংখ্যা

বঙ্গবন্ধু, নেতাজি ও মুক্তিযুদ্ধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২০, ০৭:৪৪ পিএম

বঙ্গবন্ধু, নেতাজি ও মুক্তিযুদ্ধ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান /ফাইল ছবি

১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমি যখন ‘ছোটদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থটি লিখতে শুরু করি তখন আমি বঙ্গবন্ধুর জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানতাম না। একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক ড. মযহারুল ইসলামের বিশালাকৃতির ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু’ এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখাই ছিল আমার একমাত্র সম্বল।

বঙ্গবন্ধুকে সত্যিকার অর্থে জানতে ও বুঝতে পারি অনেক অনেক পরে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থ দুটি পাঠ করার পর। রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্ন ব্যক্তির জীবনী ও আত্মজীবনী পড়তে আমার সব সময় ভালো লাগে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর গ্রন্থ দুটিতে ঘটনার বিন্যাস, অলংকার বিবর্জিত বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সহজ-সরল ভাষায় একজন মহান নেতার জীবনের খুঁটিনাটি যে আন্তরিকতার সাথে ফুটে উঠেছে এমনটি আর কোথাও পাইনি। এতে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বের ইতিহাস বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু যে কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। তাঁকে নেতা না বলে আমি শুধু ‘মানুষ’ বলছি। কারণ নেতার চেয়ে ‘মানুষ’ শব্দটি অনেক বড় এবং ব্যাপক। আমাদের কবিরা বলে গেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’

অনেকে বঙ্গবন্ধুকে বাংলার আর এক কিংবদন্তি মহামানব নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে তুলনা করেতে দ্বিধাবোধ করেন। নেতাজি অনেক বড় রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও মেধা ছিল আকাশ ছোঁয়া। তিনি অসীম সাহসী বীর পুরুষ ছিলেন। তাঁর ঈর্ষণীয় দেশপ্রেম ছিল প্রশ্নাতীত। তাঁর চরিত্রে হঠকারিতা ছিল। তাঁর মধ্যে দূরদর্শিতার অভাব ছিল। তিনি কৌশলী ছিলেন না। সংগ্রামে জয়ী হওয়ার জন্য তিনি গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেননি।

নিজ দেশের জনগণের শক্তির চেয়ে বিদেশি শক্তির ওপর তিনি নির্ভরশীল ছিলেন। এক শত্রুকে তাড়ানোর জন্য তিনি আরেক শত্রুর শক্তির ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। অর্থাৎ কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চেয়েছেন। সাহায্যকারী কাঁটা দূষিত কিনা তা ভালোভাবে পরখ করে দেখেননি। জাপানিরা যে কত হিংস্র এবং ভয়ংকর হতে পারে তা তাঁর ধারণার অতীত ছিল। চীন, কোরিয়া ও ইন্দোচীনসহ যেসব দেশ জাপান দখল করেছিল, সেসব দেশকে তারা ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত করেছিল। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে মিত্র শক্তির হাতে অক্ষশক্তি পরাজিত না হলে ভারতবাসীর ভাগ্যেও একই পরিণতি ঘটতো। বিজয়ী দেশ কখনো বিজিত জাতিকে সহজে মুক্তি দেয় না। ব্রিটিশের পরিবর্তে ভারতবাসীকে অন্য জাতির হাতে আরো কয়েক শত বছর পরাধীনতার গ্লানি বয়ে বেড়াতে হতো।

সুভাষ বসুর ব্যর্থতা থেকে বঙ্গবন্ধু শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুও যুদ্ধ জয়ের জন্য বিদেশি শক্তির সাহায্য নিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা অনেক পরে। বঙ্গবন্ধু বাইরের শক্তির চেয়ে নিজের শক্তির ওপর বেশি জোর দিয়েছিলেন। গোটা জাতিকে যুদ্ধ জয়ের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন, ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। বাইরের শক্তিকে সহায়ক শক্তি হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন, মুখ্য শক্তি হিসেবে নয়। বঙ্গবন্ধু সুভাষ বসুর চেয়ে অনেক বেশি কৌশলী ও দূরদর্শী ছিলেন। তাঁর চরিত্রে হঠকারিতার কোনো স্থান ছিল না। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ জয়ের জন্য সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরকে কৌশল হতে হয়েছিল। ‘অশ^ত্থামা হত ইতি গজঃ’ অসত্য বাক্য উচ্চারণ করতে হয়েছিল। এটা মিথ্যাচার নয়, যুদ্ধ জয়ের কৌশলী। যুদ্ধের ধর্মই হচ্ছে, ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’।

বঙ্গবন্ধু অভীষ্ট লক্ষ্যে সব সময় অটল ছিলেন। মৃত্যু আসন্ন জেনেও তিনি অন্যায়ের সঙ্গে, শত্রুর সঙ্গে আপস করেননি। সুভাষ বসুর মতো নির্ভিক ছিলেন। সুভাষ বসু অতি উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু সে শিক্ষার ঘাটতি পূরণ করেছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, শিক্ষা ও ধীশক্তি বলে।

জনগণের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল গভীর আস্থা ও মমত্ববোধ। তাঁর শক্তির উৎস ছিল তাঁর দেশবাসী। শৈশবে দরিদ্র সহপাঠীদের প্রতি তাঁর সহৃদয় আচরণ ও দুর্ভিক্ষের সময় বাড়ির গোলঘর থেকে নিরন্ন মানুষের মধ্যে ধান বিতরণ, কলকাতায় দাঙ্গার সময় মুসলিম এলাকা থেকে আটকে পড়া হিন্দুদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া, কারাগারে কয়েদিদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ, স্বাধীনতার পর জেলে আটক স্বাধীনতা বিরোধী সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরীসহ অন্যদের সঙ্গে তাঁর সহৃদয় আচরণ স্মরণ করিয়ে দেয় মহানবী হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর কথা। এক বৃদ্ধা হজরত (স.)কে কষ্ট দেয়ার জন্য তাঁর যাত্রাপথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতো, নামাজ পড়ার সময় এক ব্যক্তি তাঁর ওপর উটের ভুঁড়ি চাপিয়ে দিয়েছিল। তাদের সঙ্গে হজরত (স.) সহৃদয় আচরণ করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে রাজনৈতিক নেতা না বলে মানবিক নেতা বলাই শ্রেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশি পত্রিকা তাঁকে ‘চড়বঃ ড়ভ চড়ষরঃরপং’ বলে অভিহিত করেছিল। আমি সেই সঙ্গে যুক্ত করবো-He was a also a poet of humanity.

মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও আস্থা তাঁর বিবাদের কারণ হয়েছিল। দেশের মানুষ তাঁর ক্ষতি করতে পারে বা তাঁকে হত্যা করতে পারে এটা তাঁর ধারণার অতীত ছিল। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’। বঙ্গবন্ধু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানোর মতো পাপ করেননি। কবি গুরু তাঁর আদর্শ ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর প্রতি সাধারণ মানুষের দরদ আমি দেখেছি। অজপাড়াগাঁয়ে এক অশীতিপর বৃদ্ধকে নামাজ শেষে জায়নামাজে বসে বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চেয়ে হু হু করে কাঁদতে দেখেছি। অশিক্ষিত আমার বৃদ্ধা এক আত্মীয়কে তাঁর মৃত্যুর পর শিশুর মতো কাঁদতে দেখেছি। বঙ্গবন্ধু যেমন সাধারণ মানুষকে ভালোবাসতেন, সাধারণ মানুষেরও তেমনি তাঁর প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। এতদসত্তে¡ও কিছু মানুষকে যখন দেখি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নিন্দা করছে, তখন রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়, ‘প্যাঁচা রাষ্ট করে দেয় পেলে কোন ছুতা, জানো না আমার সঙ্গে সূর্যের শত্রুতা।’ আমাদের দুর্ভাগ্য দেশ আজ প্যাঁচায় ভরে গেছে।

শোষণমুক্ত সমাজ তথা ‘সোনার বাংলা’ গড়ার লক্ষ্যে ‘বাকশাল’ গঠন করে বঙ্গবন্ধু যে বুদ্ধিমত্তা, আন্তরিকতা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন তার সঠিক মূল্যায়ন আজো হয়নি। ‘বাকশাল’ কার্যকর হলে এতদিনে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতো এবং দেশ উন্নতির উচ্চতম শিখরে পৌঁছে যেত। সম্প্রতি বাংলা একাডেমি থেকে বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় গ্রন্থ ‘আমার দেখা নয়া চীন’ প্রকাশিত হয়েছে। বইটি আমি এখনো সংগ্রহ করার সুযোগ পাইনি। তবে দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকায় বইটি সম্পর্কে ড. মুনতাসীর মামুনের পর্যালোচনা পড়েছি। তা পড়ার পর আমার ধারণা হয়েছে, এটি একটি অসাধারণ বই। ‘বাকশাল’ ধারণাটি বঙ্গবন্ধু নয়া চীনের সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও রাষ্ট্রচিন্তা থেকে গ্রহণ করেছেন। সারা জীবন তিনি সাধারণ মানুষের সার্বিক কল্যাণের যে চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা পোষণ করেছিলেন তার বাস্তবায়নে তিনি চীন দেশে দেখেছিলেন। সাধারণ মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর মমত্ববোধ ও মঙ্গল চিন্তার বিস্তারিত ধারণা তিনি এই বইটিতে লিপিবদ্ধ করেছেন। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে তাঁর যে কী গভীর জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি ছিল তা ভাবতে অবাক লাগে। আমার মনে হয়েছে বঙ্গবন্ধু শুধু জাতির পিতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাঙালি জাতির বাতিঘর। এই বাতিঘর থেকে বাঙালি তার ভবিষ্যৎ পথ চলার পথনির্দেশ পাবে। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের কাছে আমার অনুরোধ ‘আমার দেখা নয়া চীন’ গ্রন্থের সাথে মুনতাসীর মামুনের পর্যালোচনাটি যুক্ত করলে আমার মতো স্বল্প শিক্ষিত অসংখ্য মানুষের বুঝতে সুবিধা হবে।

এ প্রসঙ্গে একটা কথা না বলে পারছি না। আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর পূর্বে বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে পরিচালক পদে কর্মরত থাকার সময় আমি শিশুদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ মুখস্থ করে আবৃত্তি করার প্রতিযোগিতা আহ্বান করেছিলাম। বিচারক হিসেবে উপস্থিত থাকার জন্য দেশের একজন প্রখ্যাত অভিনয় শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তিনি আমার আমন্ত্রণ তো গ্রহণ করলেনই না, উপরন্তু আমার বিরুদ্ধে ‘শিশুদের চেতনায় রাজনীতির অনুপ্রবেশ’ ঘটানোর চেষ্টার অভিযোগ এনে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছিলেন। আমি বিবৃতির প্রতিবাদপত্র (রিজয়েন্ডার) নিয়ে উক্ত পত্রিকা অফিসে গেলে এক সাংবাদিক তা ছাপানোর অক্ষমতা প্রকাশ করেন। আমি তাঁকে বলেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ‘গেটেস বার্গ’-এর ভাষণের চেয়ে অনেক উন্নতমানের। সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে অনেক কথা বললেন। আমার প্রতিবাদলিপি ছাপা হলো না।

উক্ত সাংবাদিকের রাজনৈতিক পরিচয় আমার জানা ছিল না। কিন্তু অভিনয় শিল্পী বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ঘোর সমর্থক ছিলেন এবং এখনো আছেন। শুধু তিনি একা নন, তাঁর গোটা পরিবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী। প্রতিভাবান এই শিল্পী নিজ যোগ্যতা বলে একুশে পদক পুরস্কারও পেয়েছেন। আমি সব সময় তাঁকে একজন বড় মাপের শিল্পী হিসেবে শ্রদ্ধা করি।

শিশুদের জন্য ৭ মার্চের ভাষণ প্রতিযোগিতা আহ্বানের বিরোধিতা করার ব্যাপারে তাঁর কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের তাৎপর্য উপলব্ধি করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না- যা শুধু তাঁর নয়, আরো অনেকের মধ্যে ছিল না। এখনো নেই। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আজ বিশ^ সভায় নন্দিত ও সমাদৃত। বিশ্বের হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠা ভাষণ হিসেবে স্বীকৃত এই ভাষণ বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বের কোটি কোটি বাঙালিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

পরিশেষে এ কথা বলতে চাই, যাঁরা বাংলাদেশকে ভালোবাসেন, বাংলার মানুষের মঙ্গল কামনা করেন, তাঁদের অবশ্যই বঙ্গবন্ধুকে জানতে হবে, তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীসহ সকল বই পড়তে হবে এবং তা আত্মস্থ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথে এগুতে পারলেই কেবল দেশে সুশাসনসহ সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App