×

জাতীয়

অগ্রগতি নেই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২০, ০৯:৪৩ এএম

অগ্রগতি নেই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা।

অপারেশন সার্চলাইট। একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর রক্ত নেশায় ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। একরাতেই হত্যা করে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ। ইতিহাসের কলঙ্কিত ওই রাতে একযোগে পাকসেনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানায় তখনকার ইপিআর সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পৈশাচিক হামলা চালায়। গ্রেপ্তার করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। অবশ্য পাকিস্তানি সেনাদের হাতে আটক হওয়ার আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলে বীর বাঙালি।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকবাহিনীর হাতে জীবন দেন ৩০ লাখ মানুষ। বিশ্বের ইতিহাসে নৃশংস গণহত্যা একাত্তরের ২৫ মার্চের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি বাংলাদেশ। গত তিন বছর ধরে দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হলেও জাতিসংঘ ঘোষিত গণহত্যাবিষয়ক একটি দিবস থাকায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এই স্বীকৃতি পাওয়া। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে যেসব উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে অগ্রগতি নেই বললেই মনে করছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকরা। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দাবি, এ নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের আগেই আন্তর্জাতিকভাবে এই স্বীকৃতি আদায়ে জোর পদক্ষেপ নেবে বাংলাদেশ।

এদিকে একাত্তরের গণহত্যার নতুন তথ্য এসেছে ১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের জরিপে। জরিপ অনুযায়ী, মাত্র ২০ জেলায় ৫ হাজার ১২১টি গণহত্যা ঘটেছে। বধ্যভ‚মির সংখ্যা ৪০৪, গণকবর ৫০২ ও নির্যাতন কেন্দ্র ৫৪৭টি। প্রতিটি গণহত্যায় ৫ থেকে ১ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আবার চুকনগরে একটি গণহত্যায় ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ শহীদ হয়েছেন। ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ভোরের কাগজকে বলেন, এই জরিপ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, আমরা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বড় কম জানি। আমাদের মাথায় আধিপত্য বিস্তার করে আছে বিজয়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের বিষয়টিকে যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়েছে; গণহত্যা এবং মানুষের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে ততটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষ যে আত্মত্যাগ করেছিল এই প্রসঙ্গটিও আড়ালে পড়ে যায়।

জানা যায়, গত কয়েক দশকে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন আন্তর্জাতিক ফোরামে দাবি জানিয়ে আসছে। ২০০১ সালে ইউনেস্কোর কাছে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে প্রথম তুলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের গবেষক এবং ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির প্রধান ডা. এম এ হাসান। ২০০৪ সালে ২৫ মার্চকে গণহত্যা প্রতিরোধ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার আবেদন জানান তিনি। জবাবে ইউনেস্কো জানিয়েছিল, স্বীকৃতি পেতে হলে বাংলাদেশকে জাতিসংঘে তা তুলে ধরতে হবে। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মতি নিয়ে তা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পাস করতে হবে। ২০০৯ সালে তিনি সরকারের কাছে তা তুলে ধরলেও সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। একই দাবিতে ২০০৭ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ইউনেস্কো এবং গণহত্যার ভিকটিম বিভিন্ন দেশে চিঠি লিখে, আইন প্রণেতাদের সঙ্গে কথা বলে নিজস্ব প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ওই চিঠির ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের মার্চে আর্মেনিয়া থেকে পাল্টা চিঠি দিয়ে বাংলাদেশে দিবসটি কীভাবে পালন করা হয় এবং এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত পাঠানোর জন্য বলা হয়েছিল।

এ প্রেক্ষাপটে নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে তখন জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়, বাংলাদেশে এখনো দিবসটি ঘোষণা হয়নি। তবে বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ মানুষ গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে। পরে জবাব এলো, যা বাংলাদেশ জাতীয়ভাবে পালন করে না, তা আন্তর্জাতিকভাবে কেন জাতিসংঘকে পালন করতে হবে? পরে ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আর্মেনিয়ার প্রস্তাব অনুযায়ী, ৯ ডিসেম্বর গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। অথচ ওইদিন জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু কোনো ভেটো দেননি, একবারও বলেননি, গণহত্যা দিবস হওয়া উচিত ২৫ মার্চ। ফলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের সুযোগ হাতছাড়া হয় বাংলাদেশের।

অন্যদিকে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে জাসদ নেত্রী শিরিন আখতারের জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হওয়ার পর রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। পরে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নেয়ার জন্য একটি বিল পাস করা হয়। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই অগ্রগতি নেই বললেই চলে। এখনো গণহত্যার সংজ্ঞা মেনে জাতিসংঘে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত ও দলিল পাঠানোর কাজ চলছে। স্বীকৃতি আদায়ের জন্য অন্তত ৮০টি রাষ্ট্রের সম্মতি প্রয়োজন। এ পর্যন্ত ভারত, ভুটান, শ্রীলঙ্কাসহ মাত্র ২০টি রাষ্ট্রের সম্মতি পেয়েছে বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবুল মোমেন ভোরের কাগজকে বলেন, স্বীকৃতি আদায়ের জন্য জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত প্রতিটি দেশের কাছেই আমরা যাবো। ইতোমধ্যেই অনেক রাষ্ট্রের সঙ্গে কথা চলছে। ক‚টনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সফলভাবে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিকে বোঝাতে সক্ষম হব। এটি জোরালো হলে যুক্তিসঙ্গত দাবি আদায় করা যাবে। আমরা যদি তথ্য-উপাত্ত সঠিকভাবে জাতিসংঘে উপস্থাপন করতে পারি তাহলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করা অসম্ভব নয়।

গবেষকদের মতে, ১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের ‘কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন এন্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইডে’ গণহত্যার পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে- কোনো গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিসাধন, জীবনমানের প্রতি আঘাত ও শারীরিক ক্ষতিসাধন, জন্মদান বাধাগ্রস্ত করা এবং শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেয়া। এই পাঁচটি উপাদানের কোনো একটি থাকলেই কোনো ঘটনা গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত হবে। আর ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞে প্রথম চারটি বৈশিষ্ট্যই রয়েছে। তাই এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এ ছাড়া উনিশ শতক থেকে নৃশংস গণহত্যার মধ্যে রয়েছে আর্মেনীয় গণহত্যা, হলোকাস্ট ও ন্যানকিং গণহত্যা, কম্বোডীয় গণহত্যা, একাত্তরের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের নামে বাঙালি গণহত্যা, বসনীয় গণহত্যা, বেলজিয়ামের রাজা লিওপোল্ডের গণহত্যা এবং সর্বশেষ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা। এর মধ্যে বর্বরোচিত গণহত্যা ঘটেছে বাংলাদেশে একাত্তরের ২৫ মার্চ। তবে জাতিসংঘ ঘোষিত গণহত্যাবিষয়ক দিবস থাকায় আরেকটি স্বীকৃতি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আর এই পথ বন্ধ করেছে সরকারই। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সম্ভব কিনা জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ভোরের কাগজকে বলেন, অসম্ভব নয়। আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

এদিকে বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না থাকলেও বিশ্বব্যাপী পাকিস্তানি বর্বরতার বিষয়টি স্বীকৃত। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আর্জেন্টিনা, হংকং, পোল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। একাধিক বিদেশি গবেষকও একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ নামে একটি কোর্স চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরও বছরব্যাপী গণহত্যাবিষয়ক বিভিন্ন ধরনের সংক্ষিপ্ত কোর্স ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে থাকে। এ ব্যাপারে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশে গণহত্যার বিষয়ে বিশ্ব সংস্থার স্বীকৃতি আদায় করতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হবে সরকারকে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস ও মিশনের মাধ্যমেও ক‚টনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। আগে বন্ধু দেশগুলোর স্বীকৃতি আদায় করতে হবে। এরপর বন্ধুদের নিয়েই আমরা জাতিসংঘে যাব।

ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংয়ের আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, যেহেতু জাতিসংঘ ঘোষিত একটি গণহত্য দিবস রয়েছে, সেজন্য সরকারের উচিত হবে ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক ‘গণহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করা এবং ২৫ মার্চ সামনে রেখে ৯ মাসের ‘গণহত্যার স্বীকৃতি’ আদায় করে নেয়া। নতুবা বাংলাদেশের গণহত্যার নির্মমতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আড়ালেই পড়ে থাকবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App