×

জাতীয়

অব্যবস্থাপনায় বাড়ছে হতাশা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২০, ০৯:২৯ এএম

অব্যবস্থাপনায় বাড়ছে হতাশা

করোনা ভাইরাস

দেশে এ পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৩ জন। মারা গেছেন তিনজন। এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের সামাজিক পর্যায়ে সংক্রমণ (কমিউনিটি ট্রান্সমিশন) শুরু হয়নি। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতি রয়েছে। সংকট নেই এই ভাইরাস শনাক্তের কিট ও পারসোনাল প্রোটেকশন ইক্যুইপমেন্টের (পিপিই)। সরকারের পক্ষ থেকে এমন হরেক রকম আশ্বাসেও আস্থা রাখতে পারছেন না দেশের মানুষ। আস্থা না রাখার যথেষ্ট কারণও রয়েছে।

সরকারের নির্দেশ অমান্য করে হচ্ছে গণজমায়েত। সরকারের পক্ষ থেকেই বলা হচ্ছে বল প্রয়োগ করেও বিদেশফেরতদের হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েও তারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সামান্য উপসর্গ দেখে রোগী রেখে পালাচ্ছেন চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাদের দেয়া হয়নি কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ। এখানেই শেষ নয়। সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য জনগণকে আরো বেশি বিভ্রান্ত করছে। শুরু থেকেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় দেশে প্রস্তুতি আছে, কিট ও পিপিই পর্যাপ্ত আছে- এমনটাই বলে আসছেন। কিন্তু গতকাল সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, করোনা মোকাবিলায় সরঞ্জামের ঘাটতি আছে। তবে সংগ্রহ করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই যখন অবস্থা তখন বিভ্রান্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সরকার এখন যা বলছে তা মানুষ বিশ্বাস করছে না। সেই আস্থার জায়গাটা আমরা অর্জন করতে পারিনি।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোস্তাক হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তাই কোনো তথ্যই তারা সহজভাবে নিতে পারছে না।

কেন মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছে এ প্রসঙ্গে মনোবিজ্ঞানী মো. আমীর হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে আমি আপনি সবাই আতঙ্কিত হব। বাস্তবতাকেও মেনে নিতে হবে। সবাই প্যানিক ডিজঅর্ডারে ভুগছে তা বলা যাবে না। তবে এটি ঠিক যে আতঙ্কজনিত সমস্যা মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে গেছে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায়, প্যানিক ডিসঅর্ডার স্ট্রেসের সময় সাধারণ ভয় ও অ্যাংজাইটি রিয়াকশনের চেয়ে ভিন্ন। প্যানিক ডিজঅর্ডার একটি সিরিয়াস কন্ডিশন, যা কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা বা সংকেত ছাড়াই হয়। হঠাৎ ভয় বা নার্ভাসনেস, ঘাম, হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি প্যানিক ডিজঅর্ডারের স্বাভাবিক লক্ষণ।

করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের আতঙ্ক দূর করতে সরকারের কী উদ্যোগ এবং মানসিক স্বাস্থ্য কতটা গুরুত্ব পাচ্ছে এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আতঙ্ক ও উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে এখন পর্যন্ত এই পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের কাছে কোনো গুরুত্ব পায়নি। অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে আমরাই এ বিষয়ে কাজ করছি। কেননা বেশি দিন হতাশার মধ্যে থাকলে মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাসহ অসহিষ্ণু আচরণ বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় শিশু-কিশোর এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দুটি গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে। এখন মানুষের মধ্যে এক ধরনের কুসংস্কার তৈরি হয়েছে- বিদেশফেরত মানেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। তারা অচ্ছুত। এই অবস্থা থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যায় সে জন্য আরেকটি গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা যে কথা বলি তা অনেকেই বিশ্বাস করছে না। যে চিকিৎসকটি করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন তিনিও প্যানিক ডিজঅর্ডারে ভুগছেন। বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে মানুষের মানসিক সমস্যা যে বাড়বে সেই বিষয়ে আমাদের গুরুত্ব দেয়া দরকার।

মোট আক্রান্ত ৩৩, মৃত্যু তিন, বেশি আক্রান্ত ঢাকায়- আইইডিসিআর: গতকাল প্রথমবারের মতো অনলাইন লাইভে সংবাদ সম্মেলন করেছে আইইডিসিআর। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, দেশে এখন পর্যন্ত ৬২০ জনের নমুনা সংগ্রহ করে ৩৩ জনের নমুনায় কোভিড-১৯-এর উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছেন ৬ জন। এই ভাইরাসে আরো একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিনজনে। আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শনাক্ত হয়েছেন ঢাকায়। এরপরই আছ মাদারীপুরে। জেলাভিত্তিক বিশ্লেষণ করে তিনি জানান, ঢাকা (ঢাকা শহর)-১৫ জন, মাদারীপুর- ১০, নারায়ণগঞ্জ-৩, গাইবান্ধায়-২, কুমিল্লা, গাজীপুর ও চুয়াডাঙ্গায় একজন করে করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। শনাক্ত হওয়া ৩৩ জনের মধ্যে অন্য দেশ ভ্রমণের ইতিহাস আছে ১৩ জনের। এদের মধ্যে ইতালি থেকে ৬ জন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুজন, ইতালির বাইরে ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে ২ জন, বাহরাইন থেকে এক, ভারত থেকে এক এবং কুয়েত থেকে এসেছেন একজন। বাকি ২০ জনই এদের মধ্যমে কোনো না কোনোভাবে সংক্রমিত হয়েছে। ইতোমধ্যে একজন চিকিৎসক ও দুজন নার্স এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন।

বল প্রয়োগ করেও হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা যাচ্ছে না- স্বাস্থ্যমন্ত্রী : গতকাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে এক সংক্ষিপ্ত সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিদেশফেরত ব্যক্তিদের সেলফ কোয়ারেন্টাইন না মানার বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। মন্ত্রী বলেন, যারা বিদেশ থেকে এসেছেন, তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। জোর করে তাদের ধরে আনা হচ্ছে। কিন্তু তারা যদি নিজেরাই কোয়ারেন্টাইনে থাকেন তাহলে আমরা তাদের সেবা দিতে পারব, তাদের পরিবারকেও রক্ষা করতে পারব। কিন্তু পালিয়ে বেড়ালে কোনোটাই সম্ভব নয়।

মন্ত্রী বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হাসপাতালে আগামী সাত থেকে আট দিনের মধ্যে করোনার পরীক্ষাগার স্থাপন করা হবে। দুই ধরনের টেস্টিং কিট দিয়ে বিভিন্ন ল্যাবে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সরকারের হাতে পর্যাপ্ত কিট রয়েছে। করোনা শনাক্তকরণে আরো ৫০ হাজার কিট অর্ডার দেয়া হয়েছে। সবার পিপিইর দরকার নেই।

সংক্রামক ব্যাধির তালিকাভুক্ত কোভিড-১৯ : সরকার করোনা ভাইরাসকে সংক্রামক ব্যাধির তালিকাভুক্ত করেছে। গতকাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এ প্রজ্ঞাপন জারি করে। তবে এ গেজেটটি গত ৮ মার্চ থেকে কার্যকর বলে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়। মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবদুল ওহাব খান স্বাক্ষরিত এ প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কোভিড-১৯-কে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২১০৮-এর ধারা ৪(ভ)-তে বর্ণিত ক্ষমতাবলে সংক্রামক ব্যাধির তালিকাভুক্ত করা হলো।

স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ভীত না হয়ে সেবা দেয়ার আহ্বান বিএমএ ও স্বাচিপের : স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ভীত না হয়ে মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত হয়ে সেবা দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতারা। তারা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে চিকিৎসক ও রোগীদের মধ্যে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা আমরা লক্ষ্য করছি। গণমাধ্যমের মাধ্যমে আমরা চিকিৎসকদের আশ্বাস দিতে চাই তাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার সরঞ্জামাদি পর্যাপ্ত রয়েছে। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে পিপিই দেয়ার দাবিতে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই পিপিই সবার প্রয়োজন নেই।

যারা আক্রান্ত ব্যক্তির সেবা দেবেন কেবল তাদেরই এই বিশেষ পোশাকের প্রয়োজন। গতকাল বিএমএ ভবনের শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলন লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বিএমএর সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। বক্তব্য রাখেন বিএমএ মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী, স্বাচিপের সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান ও মহাসচিব ডা. এম এ আজিজ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App