×

জাতীয়

স্বাস্থ্য খাতের কর্মীরা আতঙ্কে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২০, ০৯:৩৯ এএম

স্বাস্থ্য খাতের কর্মীরা আতঙ্কে

ফাইল ছবি

স্বাস্থ্য খাতের কর্মীরা আতঙ্কে

বিদেশফেরত যাত্রীকে সেবা না দিয়ে চিকিৎসকের পলায়ন। করোনা আতঙ্কে জ¦র-সর্দি-কাশির রোগী দেখছেন না চিকিৎসক। কিংবা রাজশাহী মেডিকেলে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের করোনা-সংক্রান্ত চিকিৎসাসেবা থেকে বিরত থাকার ঘোষণার খবর-ই জানিয়ে দেয় এই ভাইরাস নিয়ে চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। অভিযোগ আছে আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকরাই আছেন অনেকটা অরক্ষিত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনা নিয়ে সবার মনেই আতঙ্ক বিরাজ করছে। চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরাও এই সমাজের অংশ। তাই তাদের মধ্যেও এই আতঙ্ক আছে। তবে এমনটা যে সবখানেই হচ্ছে তা কিন্তু নয়। দেশে করোনা আক্রান্ত ১৭ জনের চিকিৎসাসেবা কিন্তু চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরাই দিচ্ছেন। তবে আরো বেশি সচেতনতা দরকার বলে মনে করেন তারা।

এ অবস্থায় স্বাস্থ্য খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করেছে সরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার করোনা প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, করোনা ভাইরাসের কারণে স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে যুক্ত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। করোনা প্রাদুর্ভাব চলাকালীন সময়ে ও পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে যুক্ত সব কর্মকর্তা, নার্স, চিকিৎসকরা ছুটি পাবেন না। মন্ত্রী বলেন, মাদারীপুর জেলায়ই করোনা আক্রান্ত দেশ থেকে বেশি মানুষ এসেছে। সেখানেই বেশি নজরদারি করা হচ্ছে। প্রয়োজনে এই জেলা লকডাউন করা হবে।

জাতীয় প্রেস ক্লাবে গতকাল ‘করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ডাক্তারসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীদের ঝুঁকি নিরসনে করণীয়’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলন করে ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি এন্ড রাইটস (এফডিএসআর) নামের একটি সংগঠন। এফডিএসআরের চেয়ারম্যান ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন বলেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে চিকিৎসকসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। দেশে যদি এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে তাহলে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা সবচেয়ে বেশি হুমকিতে পড়বে। চীনের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী মারা গেছেন। করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা চিকিৎসকসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য ‘প্রাইভেট প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) এখনো সব জায়গায় পৌঁছায়নি। এই জিনিসগুলো (বিশেষ পোশাকসহ গ্লাভস, চোখ ঢাকার জন্য গগলস) সরবরাহ করতে হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক দুলাল বলেন, সবার জন্য এবং সব রোগী দেখার জন্য পিপিই কোনো প্রয়োজন নেই। যারা করোনা আক্রান্তের সেবা দেবেন এবং ওই কাজে নিয়োজিত থাকবেন কেবলমাত্র তাদেরই পিপিই দরকার হবে।

চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষায় অধিদপ্তরের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, সব চিকিৎসক-নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর পিপিইর সব ব্যবস্থা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে। কেউ আতঙ্কিত হবেন না, ঘাবড়াবেন না। কিটের অভাব হবে না, পিপিইরও অভাব হবে না। চিকিৎসক-নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য প্রয়োজনীয় যে নিরাপত্তা বিধান, পোশাক বা অন্যান্য যে সব জিনিস- তা আমরা সরবরাহ করছি। আমরা এ কথা বলতে পারব না, তিন মাসের পিপি মজুত আমাদের কাছে আছে।

কিন্তু প্রতি সপ্তাহের কিংবা দৈনিকভিত্তিতে তাদের নিরাপত্তা সব ধরনের ব্যবস্থা আমাদের রয়েছে। যেগুলো আছে সেগুলো আমরা সরবরাহ করছি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বুধবার ৫শ পিপিই দেয়া হয়েছে। একদিনে তো এত পিপি শেষ হওয়ার কথা নয়। বৃহস্পতিবার সকালেও সিএমএইচে (সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল) খবর নিয়েছি, সকালে তারা ১০ হাজার পিপিই সংগ্রহ করেছে। সিএমএইচ দুই হাজার কিট সংগ্রহ করেছে। আমরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে এক লাখ কিট সংগ্রহ করব। ১০ লাখ পিপিই সংগ্রহের প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। চিকিৎসা কেন্দ্রে এ ধরনের পিপিইর অভাব হবে না।

চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ভয় পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনেকে হয়তো ভয় পাচ্ছেন, অনেকের মধ্যে এই প্রবণতা থাকতে পারে। আমরা চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনুরোধ করব, বৃহত্তর মানবতার স্বার্থে সবাই কাজে নিয়োজিত থাকবেন, কেউ বিরত থাকবেন না। আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সব চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করব। নিরাপত্তা ছাড়া কাউকে আমরা রোগী চিকিৎসা দেয়ার কথা বলছি না।

রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ গতকাল দুপুরে বলেন, দেশে করোনায় নতুন করে আরো তিনজন আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন নারী (২২) ও দুই জন পুরুষ (৩২ ও ৬৫)। তারা স্থানীয়ভাবে সংক্রমিত হয়েছেন এবং একই পরিবারের সদস্য। তারা ইতালি ফেরত একজনের সংস্পর্শে এসেছেন। এ পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ জন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিনজন। এখনো ১৯ জন আইসোলেশনে এবং ৪৩ জন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আছেন। এ পর্যন্ত ৩৬৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের ১৭ জনের নমুনায় করোনার উপস্থিত মিলেছে।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন তৌহিদ-উল আহসান গতকাল সংবাদ সম্মেলনে জানান, শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকায় সাত প্রবাসী বাংলাদেশিকে বিমানবন্দর থেকে সরাসরি কুয়েতমৈত্রী হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এই সাতজন কাতার, দুবাই, ওমান, কুয়েত, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে দেশে এসেছেন।

এদিকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে শর্ত সাপেক্ষে করোনা পরীক্ষার কিট তৈরির রি-এজেন্ট আনার অনুমতি দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, কিট তৈরির পর তা পরীক্ষা করে দেখা হবে সেগুলো বাজারে সরবরাহ করা যায় কিনা। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই সেই কিট বাজারজাত করার অনুমোদন দেয়া হবে। এ প্রসঙ্গে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জানান, এই কিট তৈরির কাঁচামাল আসবে ইংল্যান্ড থেকে। কাঁচামাল এলে এক সপ্তাহের মধ্যে তারা উৎপাদনে যেতে পারবে। প্রথম দফায় এক লাখ কিট উৎপাদন করা হবে। ১০ লাখ টাকার কাঁচামাল লাগবে। প্রতিটি কিটের দাম হতে পারে ২শ টাকার মতো। তবে এই কিট সরকারের কাছে বিক্রি করা হবে, জনসাধারণের কাছে নয়।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে জানানো হয়, গণস্বাস্থ্য-আরএনএ বায়োটেক লিমিটেডের গবেষক দল ফেব্রুয়ারি থেকে এই কিটের ডিজাইন এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছেন। এ প্রযুক্তির ব্যাপারে পুরো গবেষক দলের সরাসরি কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। এর আগে ২০০৩ সালে র‌্যাপিড ডট ব্লট সার্স পিওসি কিট তৈরি দলের সদস্য ছিলেন ড. বিজন কুমার শীল। ওই কিটটি সিঙ্গাপুরে পেটেন্ট করা হয়েছিল। এবারো করোনার কিট তৈরির জন্য গঠিত গবেষক দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ড. বিজন কুমার।

দেশের সব চক্ষু চিকিৎসককে পিপিই ব্যবহার করে চিকিৎসাসেবা দেয়াসহ ছয় দফা নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ চক্ষু চিকিৎসক সমিতি। সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ ও মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মো. আবদুল কাদের স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এই নির্দেশনা দেয়া হয়। বিবৃতিতে বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে চক্ষু রোগীর জরুরিসেবা ব্যতীত সব রুটিন চিকিৎসা সাময়িকভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়। এতে বলা হয়, চক্ষু পরীক্ষায় ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র ঘন ঘন জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করা গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা জোরদার করাসহ প্রয়োজনে টেলি মেডিসিন সেবা দেয়ার বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App