×

অর্থনীতি

করোনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২০, ১০:২৮ এএম

করোনা ভাইরাসের প্রভাব ইতোমধ্যে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। সংকট মোকাবিলায় পথ খুঁজছে বৈশ্বিক কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। ফেডারেল রিজার্ভ বলছে, ১০ দিন আগেও বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার দিকে মোড় নিচ্ছে কিনা তা নিয়ে বাস্তব অনিশ্চয়তা ছিল কিন্তু এখন এটি নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও ইতোমধ্যে করোনা ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আমদানি-রপ্তানি, প্রবাসী আয়ে তার প্রভাব স্পষ্ট হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় কমায় ব্যাংকগুলোর হাতে উদ্বৃত্ত ডলার জমা হচ্ছে, যা কিনে নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন ব্যাংকের উদ্বৃত্ত ডলার কেনার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি বাজারে এসেছে। এদিকে পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক ধসের কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসার কথা বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে কতটা উদ্যোগ নিতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক- সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালনে সক্ষম হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ভ‚মিকা অনেক সীমিত। এক্ষেত্রে সরকারকেই বেশি দায়িত্ব নিতে হবে।

জানা গেছে, এ বছরের প্রথম দুই মাসের কর্মকাণ্ডে স্থবিরতার কারণে চীনা অর্থনীতির প্রতিটি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে চীনের খুচরা বিক্রি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। এ দুই মাসে দেশটির শিল্প উৎপাদন সাড়ে ১৩ শতাংশ এবং স্থায়ী সম্পদ বিনিয়োগ প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে। শিল্প উৎপাদন কমার এই হার চীনের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

গোল্ডম্যান স্যাকস ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জান হাটজিয়াস ক্লায়েন্টদের বলেছেন, এ অচলাবস্থা ও ভাইরাসটি নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের প্রভাবে মার্চের বাকিটা ও এপ্রিলজুড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক হারে কমার সম্ভাবনা রয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন অর্থনীতিকে মন্দার হাত থেকে রক্ষার পাশাপাশি বিনিয়োগে আস্থা ফিরিয়ে আনতে জরুরিভিত্তিতে সুদের হার কমায় দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ (ফেড), যা অন্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর জন্য সতর্ক বার্তা হিসেবে কাজ করেছে।

এদিকে ফেডের সুদহার কমানোর পদক্ষেপে অর্থনৈতিক আত্মবিশ্বাস খুব একটা ফেরেনি। এ অবস্থায় ভাইরাস সংক্রমণের কারণে বাধাগ্রস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি ফিরিয়ে আনতে আরো কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে ভাবতে হচ্ছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের পক্ষ থেকে জি২০ জোটের সদস্য দেশ ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গেও আলোচনা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে আইএমএফ ও বিশ^ ব্যাংক উন্নয়শীল দেশের জন্য ১ হাজার ২০০ কোটি ডলারের সুদমুক্ত ঋণের ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য উপকরণ কিনতে আরো ৪ হাজার কোটি ডলারের জরুরি তহবিল ঘোষণা করা হয়েছে অর্থ সংকটে পড়া দেশগুলোর জন্য। একইভাবে নভেল করোনা ভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলায় গ্রহণীয় নীতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

দেশের অর্থনীতিতে করোনা ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। চীনে শুরু হওয়া করোনায় আমদানি খাতে খানিকটা আঘাত হানলেও বিশ্বব্যাপী তা ছড়িয়ে পড়ায় এখন আঘাত আসছে রপ্তানি খাতেও। একইভাবে প্রবাসী আয়ও  কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে চীন, যুক্তরাষ্ট্র বা ইতালির মতো বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে পণ্যের সাপ্লাই চেইন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিও ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে অর্থনীতি সচল রাখতে সরকারকে আগাম প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। পাশাপাশি সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত খাত চিহ্নিত করে আগামী ৩-৪ মাসের, অথবা আগামী ৬ মাসের জন্য একটি অর্থনৈতিক ঝুঁকির বাজেট করারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিশে^র অন্যান্য দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সরকার করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত মহাদুর্যোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে। সেদিক থেকে বাংলাদেশে পরিস্থিতি যেহেতু কিছুটা পরে শুরু হয়েছে এবং বলা হচ্ছে প্রকোপের দিক থেকে বাংলাদেশের মাত্রা অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। তবে এটা ঠিক যে, এটি আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সুতরাং আগামীতে সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরো বেশি একটিভ রোল নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। তবে অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যদি অন্যান্য ব্যাংকের মাধ্যমে উদ্যোগ নেয়ার ঘটনা আমরা শুনেও থাকি, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভ‚মিকা অনেক বেশি সীমিত। যদিও পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক ধসের জন্য করোনা ভাইরাস দায়ী- এমন কথা বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে রোল প্লে করার কথা বলছে। তবে সিপিডি জোরালোভাবে এর প্রতিবাদ করেছে।

তিনি বলেন, সিপিডির মতে, পুঁজিবাজারের এ ধসের পেছনে করোনা ভাইরাসের কোনো সম্পর্কই নেই। এর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভ‚মিকা যুক্ত করে সেখানে ব্যাংকগুলোকে ইনফ্লুয়েন্স করার উদ্যোগ সঠিক হবে না। করোনা ভাইরাসের অন্যান্য উদ্যোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে যেহেতু সরকার আরো বেশি রোল প্লে করে সুতরাং সরকারের দিক থেকেই আমরা উদ্যোগগুলো প্রত্যাশা করতে পারি। গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, দেশের ভিতরে সরকার এই মুহূর্তে ৩-৪ মাসের জন্য দুর্যোগকালীন কী কী ধরনের আক্রান্ত হতে পারে তার একটি এসেসমেন্ট দরকার। এর ভেতরে স্বাস্থ্যগত, কর্মসংস্থান, বাণিজ্য, ব্যবসা- এ ধরনের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে কী ধরনের মাত্রাগত জায়গা কতটুকু ক্ষতি হতে পারে বা কী কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। তার জন্য কী ধরনের সম্পদের প্রয়োজন হতে পারে- তার একটি মূল্যায়ন করা দরকার। এ মূল্যায়নের ভিত্তিতে সরকার অভ্যন্তরীণ কী কী রাজস্ব ব্যবহার করতে পারেন তা যেমন দেখতে পারেন। এর সঙ্গে বাড়তি অর্থের কী প্রয়োজন হতে পারে সেটির জন্য দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলাপ করতে পারেন।

তিনি বলেন, আমরা সম্প্রতি জানি যে, বিশ্বব্যাংক ১২ বিলিয়ন ডলারের একটি ফান্ড করেছে বৈশি^ক পর্যায়ে দেশগুলোকে সহায়তা করার জন্য। সরকার চাইলে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গেও তার প্রারম্ভিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে সহযোগিতার জন্য তাদের সঙ্গে আলাপ করতে পারে। পাশাপাশি অন্য যে সমস্ত দাতা সংস্থা রয়েছে তাদের সঙ্গেও খাতভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগের বিষয়ে চিন্তা করতে পারে।

এদিকে রপ্তানিকারকরা বলছেন, চীনের করোনা ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে গার্মেন্টসহ দেশের অন্তত ১৩-১৪টি খাতে। বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কার পাশাপাশি কিছু পণ্যের সরবরাহে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিতে পারে। বাণিজ্য সংগঠনগুলো থেকে গত মাসের শুরুতে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইকে দেয়া মতামতে এমন আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়েছে।

জানা গেছে, করোনার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে তৈরি পোশাক খাতে। এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, রপ্তানি বাজার ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে। কারণ রপ্তানির বড় বাজার ইউরোপের দেশগুলোতে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রও বিপদে আছে। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, এককথায় আমরা বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছি। কারণ ইতোমধ্যে  সুতা ও সেলাইয়ের সুতাসহ সব ধরনের আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম ও পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। রপ্তানিতেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আরো বড় ধরনের আঘাত আসতে পারে।

এদিকে বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় কমায় ব্যাংকগুলোর হাতে উদ্বৃত্ত ডলার জমা হচ্ছে, যা কিনে নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন ব্যাংকের উদ্বৃত্ত ডলার কেনার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি বাজারে এসেছে। গত সোমবার পর্যন্ত এক সপ্তাহে ২৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার কিনে এ পরিমাণ টাকা বাজারে দেয়া হয়েছে। এতে করে ডলারের দর স্থিতিশীল থাকার পাশাপাশি বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়েছে। জানা গেছে, গত ৯ মার্চ থেকে এ দফায় বাজার থেকে ডলার কেনা শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সর্বশেষ গত সোমবার কিনেছে ৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এক সপ্তাহে কিনেছে ২৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর আগে ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি বাজার থেকে ডলার কেনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর প্রায় প্রতি মাসেই বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করে। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার কিনেছে ৮৪ টাকা ৯৫ পয়সা দরে। এতে করে এ কয়েক দিনে শুধু ডলার কিনে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে ছেড়েছে ২ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। বাজার থেকে ডলার কেনায় সোমবার দিন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গিয়ে ঠেকেছে ৩২ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে। গত ৯ মার্চ রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। চলতি মাসের শুরুতে ৩২ বিলিয়নের নিচে ছিল।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App