×

জাতীয়

করোনায় স্থানীয় সংক্রমণ ঠেকানোই চ্যালেঞ্জ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২০, ০৯:২৪ এএম

দেশে ইতোমধ্যে করোনা ভাইরাসে স্থানীয়ভাবে সংক্রমণ (লোকাল ট্রান্সমিশন) শুরু হয়েছে। বিদেশ ফেরত আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন কয়েক জন। সরকারি তথ্য মতে, দেশে এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ১০ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিনজন। আক্রান্ত ৭ জনের মধ্যে বিদেশ ফেরত তিন জন। তাদের একজনের কাছ থেকে সংক্রমিত হয়েছে ওই পরিবারের তিনজন। আরেকজনও আক্রান্ত হয়েছেন বিদেশ ফেরত এক আত্মীয়ের মাধ্যমে। আক্রান্তের মধ্যে চারজন পুরুষ, দুইজন শিশু ও একজন নারী। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের সংক্রমণের ঘটনা এটাই নতুন নয়। দেশে প্রথমবার শনাক্ত তিন আক্রান্তের মধ্যে একজন সংক্রমিত হন তার বিদেশ ফেরত পরিবারের এক সদস্যের মাধ্যমে। দেশের ভেতরে সংক্রমণ ঠেকানো করোনা মোকাবিলায় একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রোগের চারটি স্তর রয়েছে। প্রথম পর্যায় বিদেশ থেকে রোগের সংক্রমণ। দ্বিতীয় পর্যায় স্থানীয় সংক্রমণ। তৃতীয় পর্যায় কমিউনিটি সংক্রমণ। চতুর্থ পর্যায় যখন মহামারি। কমিউনিটি সংক্রমণ বলতে তারা বলছেন, যখন কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে আসেননি বা এমন কোনো দেশে সফর করেননি যেখানে করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে, অথচ তার শরীরে ওই ভাইরাস পাওয়া গিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে বাংলাদেশে স্থানীয় সংক্রমণ আছে। তবে এখনো কমিউনিটি সংক্রমণ হয়নি।

এদিকে সরকার ও বিশেষজ্ঞরা, বিদেশ ফেরত নাগরিকদের স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টাইনের ওপর বারবারই গুরুত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু তাদের নির্দেশ যে মানা হচ্ছে না সেটিও তারা বলছেন। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ছে। সোমবারও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন মাত্র চারজন। গতকাল মঙ্গলবার এর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩ জনে। তারা বলছেন, দেশে এখনো কমিউনিটি সংক্রমণ হয়নি। তাই তারা স্থানীয় সংক্রমণ রোধ করার ওপরই জোর দিচ্ছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, দেশে এ পর্যন্ত বিদেশ থেকে এসেছেন কয়েক লাখ যাত্রী। যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন তাদের অনেকেই সঠিকভাবে এর শর্ত মানছেন না। এটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব স্বাস্থ্য বিভাগের একার কাজ নয়। আমরা সবসময়ই বলছি স্বাস্থ্য সেবার দায়িত্ব আমাদের। বাকি দায়িত্ব অন্যদের নিতে হবে। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ইতালি ফেরত যেসব যাত্রী গাজীপুরে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন তাদের দায়িত্ব নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এক্ষেত্রে সহায়তা করছে পুলিশ প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা।

তিনি আরো বলেন, কোনো জায়গায় যদি স্থনীয়ভাবে সংক্রমণ হয়; তা ঠেকানোর জন্য ওই জায়গা ‘বøক’ করতে হবে। আমাদের দেশের গ্রামগুলোকে ‘লক ডাউন’ করা খুবই কঠিন। রাস্তা কীভাবে ‘লক ডাউন’ করা হবে? মানুষ তো বাড়ি থেকে বেরুবে। তাদের কীভাবে ঠেকানো যাবে? তবে যেভাবেই হোক গ্রাম ও ইউনিয়ন পরিষদের সহযোগিতায় আমাদের এই কঠিন কাজটি করতে হবে। সবাইকে বলতে হবে যাতে তারা বাড়ির বাইরে না যায়। কোনো বাড়িতে কেউ আক্রান্ত হলে সেই বাড়ির কেউ যাতে বাইরে না বের হয়। আত্মীয়স্বজনরা তার খাবার বাড়িতে না ঢুকে বাইরে দিয়ে যাবে। সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সহযোগিতা দরকার।

এ প্রসঙ্গে রোগতত্ত¡, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, স্থানীয় সংক্রমণ আমাদের প্রথম থেকেই ছিল। তবে এতে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। করোনা সংক্রমণ দ্রুত ছড়ালেও তা খুব মারাত্মক নয়। আমাদের দেশে যারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত তারা মৃদু সংক্রমণে ভুগছেন।

তিনি বলেন, আক্রান্তরা যে এলাকার বাসিন্দা, সেখান থেকে যেন এই ভাইরাস না ছড়িয়ে পড়ে সেজন্য সেখানে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে যেতে হলে তাদের স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসন থেকে অনুমতি নিতে হবে। যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার বিষয়টি না মেনে ইচ্ছামাফিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে সংক্রামক ব্যাধি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা কঠোর হতে বাধ্য হচ্ছি।

ইতোমধ্যে হোম কোয়ারেন্টাইনে’ না থেকে প্রকাশ্যে চলাফেরার দায়ে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলায় ইরাক ফেরত এক প্রবাসী বাংলাদেশিকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সোমবার রাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুল আলম এ সাজা দেন। এর আগে রবিবার সন্ধ্যায় সাটুরিয়া উপজেলায় সৌদি আরব থেকে আসা এক ব্যক্তিকেও ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

গতকাল দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন ভবনে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষের উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে সারাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হবে। হোম ও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন ঠিকঠাক মানা হচ্ছে কি না, সারাদেশে আইসোলেশনে থাকা ব্যক্তিদের সর্বশেষ অবস্থা কেমন- সব কিছু সেখান থেকে পর্যবেক্ষণ করা হবে।

এসময় মন্ত্রী বলেন, যারা সংক্রামক ব্যাধি আইন মানবে না, দেশের মানুষকে বিপদে ফেলবে, তাদের জরিমানা করা হবে। তা আদায়ও করা হচ্ছে। যদি তারা বেশি অপরাধ করে, তাদের প্রয়োজনে জেলে দেয়া হবে। আইনে সে ধরনের কথা বলা হয়েছে। পরীক্ষার জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় কিটের মজুত রয়েছে। প্রয়োজনে আমদানি করব। কিটের সংকট হবে না বলে আশা করি।

এদিকে দুপুরে প্রতিষ্ঠানের মিলনায়তনে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে আইইডিসিআর পরিচালক বলেন হাঁচি, কাশি, সর্দি হলেই করোনা ভাইরাস ধরে নিয়ে আতঙ্কিত হবেন না। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কমিউনিটি সংক্রমণ নেই। অর্থাৎ রোগটি সামাজিকভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। কোনো কারণে গার্মেন্টস কর্মীদের মধ্যে করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হলে তা ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই গার্মেন্টস কর্মীদের জ্বর, কাশি, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট থাকলে তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে। যতদিন তারা সুস্থ না হবেন ততদিন তাদের সবেতনে ছুটি দেয়ার জন্য গার্মেন্টস মালিকদের অনুরোধ করছি। এ পরামর্শ শুধু গার্মেন্টসের জন্যই নয়, অন্য যেসব প্রতিষ্ঠানে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন, তাদেরও একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে গার্মেন্টসের বিদেশি বায়াররা না এলেই ভালো। তবে যারা এসেছেন তারা যেন যেসব স্থানে জনসমাগম রয়েছে সেখানে ভ্রমণ না করেন।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, দেশে এখন মোট ১৬ জন আইসোলেশনে আছেন। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আছেন ৪৩ জন। এ পর্যন্ত সর্বমোট ২৭৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৬ জনের নমুনা সংগ্রহের মাধ্যমে পরীক্ষা করার পর এ দুজনের শরীরে করোনার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় প্রতিষ্ঠানের হট লাইনে ৪ হাজার ২০৫টি কল এসেছে। তারমধ্যে ৪ হাজার ১৬৪টি করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত। নতুন করে আক্রান্ত দুজনই পুরুষ। একজন ইতালি থেকে এসেছেন। আরেকজন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা এক অতিথির মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App