×

মুক্তচিন্তা

হৃদয়ে যাঁর বাংলার সংস্কৃতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২০, ০৯:৩২ এএম

হৃদয়ে যাঁর বাংলার সংস্কৃতি

বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান।

১৯৪৮ সালের কথা। তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে গেছেন এক হাইস্কুলের দ্বারোদঘাটন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য। ফেরার পথে নৌকায় রওয়ানা হয়েছেন আশুগঞ্জ স্টেশনে ট্রেন ধরতে। সঙ্গে ছিলেন খ্যাতকীর্তি গায়ক আব্বাসউদ্দিন আহমদ, সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন আহম্মদ। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু সে অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : পথে পথে গান চলল। নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তার নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলোও যেন তার গান শুনছে। তারই শিষ্য সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন তার নাম কিছুটা রেখেছিলেন। আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালোবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’ আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম। বিভিন্ন সময়েই তার জীবন ও কর্মে সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ আমরা লক্ষ করেছি। প্রায়ই তিনি ঘরোয়া আলাপ-আলোচনা বা জনসভায় বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিতেন। তার পড়ার ঘরে হাতের কাছেই থাকত ‘সঞ্চয়িতা’। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির ভাষা আন্দোলন স্মরণ সপ্তাহের উদ্বোধনীতে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘বাঙালির স্বাজাত্যবোধকে টুঁটি চেপে হত্যার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বারবার এই অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ভাষার ওপর আঘাত হেনেছে, আর তাকে প্রাণ দিয়ে প্রতিহত করেছে এদেশের তরুণরা। কিন্তু তাদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ক’জন আছেন? বিবেকের কাছেই তাঁদের জবাবদিহি করতে হবে। আপনাদের লেখনী দিয়ে বের হয়ে আসা উচিত ছিল এদেশের গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা। স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর সন্তান সূর্যসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের প্রচেষ্টাই করা হয়নি। তার কথা বলতে আপনারা ভয় পান। কারণ তিনি ছিলেন হিন্দু। এদের ইতিহাস লেখা এবং পাঠ করার জন্য দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানাই। একদিন বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলা যেত না। কিন্তু আজ এই জাতীয়তাবাদ সত্য। একে রোধ করতে পারে এমন কোনো ক্ষমতা নেই। এই প্রথমবারের মতো বাঙালি জাতি একতাবদ্ধ হয়েছে। নিজেদের দাবিতে বাঙালিরা আজ ঐক্যবদ্ধ। এর আগে ১৯৭১-এর ২৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান সঙ্গীত শিল্পী সমাজের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের গণমুখী সংস্কৃতিকে বিকশিত করার উদ্দেশ্যে সাহিত্য-সঙ্গীতে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা, সুখ-দুঃখকে প্রতিফলিত করতে হবে। সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে গণমানুষের সুপ্ত শক্তি ও স্বপ্ন এবং আশা-আকাক্সক্ষাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি। আপনারা ভালোবাসা এবং শান্তির অনেক গান গেয়েছেন। আজ বস্তির নিঃস্ব সর্বহারা মানুষের জন্য গান রচনার দিন এসেছে। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের মতো বিপ্লবী গান গাইতে হবে। মানুষের মনে প্রেরণা জোগাতে হবে। যদি এতে বাধা আসে, সেই বাধা মুক্তির জন্য সাত কোটি বাঙালি এগিয়ে আসবে।’ সংস্কৃতিকর্মীদের জন্য তার সহমর্মিতার দুটো উদাহরণ এখানে উল্লেখ করতে চাই। ১৯৭৪ সালে বন্যার সময় আমরা থিয়েটার থেকে ‘এখন দুঃসময়’ অভিনয় করে যতদূর মনে পড়ে দুই বা তিন হাজার টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দিতে গেছি। বঙ্গবন্ধু খুব খুশি হয়ে আমাদের এ সামান্য দান গ্রহণ করে আমাদের অফিস প্রয়োজন কিনা জানতে চাইলেন। আমরা ভাবলাম এখন নতুন দেশে সরকারের কত কিছুর প্রয়োজন, এ সময়ে আমাদের অফিসের জন্য বাড়ি না হলেও চলবে। তাই তাকে আপাতত প্রয়োজন নেই বললাম। তার কত দূরদৃষ্টি ছিল আর আমাদের তার অভাবের কথা ভেবে এখন আফসোস করি। এখন দলের জন্য বা থিয়েটার স্কুলের জন্য একটা স্থায়ী ঠিকানার সন্ধানে দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। দ্বিতীয় ঘটনাটি আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু গেছেন রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের নতুন ভবন পরিদর্শনে। অভ্যর্থনাকারীদের সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন তরুণ প্রযোজক আবদুল্লাহ আল-মামুন। তাকে দেখে বঙ্গবন্ধু দুহাত মামুনের গালে ধরে আদর করে জিজ্ঞেস করলেন, কি তোমাদের নাটক কেমন চলছে? সে সময়ে কিন্তু প্রমোদ কর ও সেন্সরশিপের আইন কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করার ফলে ঢাকায় নিয়মিত নাট্যচর্চা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মামুন জবাব দিল, আপনি তো নাটক বন্ধ করে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু কারণ জানতে চাইলে মামুন এ দুটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করল। পাশে দাঁড়ানো ছিলেন অর্থমন্ত্রী ড. এ আর মল্লিক। তাকে বঙ্গবন্ধু বললেন, কি মল্লিক সাহেব, নাটকের লোকেদের কাছ থেকে টাকা না নিলে কি আমার সরকার চলবে না? বঙ্গবন্ধু পরদিনই মামুনকে তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। আমি আর মামুন সে অনুযায়ী গণভবনে গিয়ে হাজির হলাম। আমাদের বন্ধু ড. ফরাসউদ্দীন ছিলেন তখন রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত সচিব। ফরাসভাইকে ডেকে বঙ্গবন্ধু বললেন, আজই রাষ্ট্রপতির আদেশ জারি করে দাও যে এখন থেকে শৌখিন নাট্য দলগুলোকে কোনো প্রমোদ কর দিতে হবে না আর সেন্সর পুলিশের বদলে শিল্পকলা একাডেমিতে একটি নাটক সেন্সর কমিটির মাধ্যমে হবে। মন্ত্রণালয়ে পাঠালে জটিলতা হতে পারে উল্লেখ করে সরাসরি রাষ্ট্রপতির আদেশ জারির কথা বললেন। তারপরই নাট্যচর্চার ওপর থেকে প্রমোদ কর উঠে গেল এবং নাটকের সেন্সর পদ্ধতি সহজতর হলো। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে ২০০০ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নাটকের সেন্সর আইন পুরোপুরি বাতিল করেন। যারা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সাহচর্য পেয়েছেন তারা নিশ্চয়ই বাংলা ভাষার জন্য, বাঙালি সংস্কৃতির জন্য বঙ্গবন্ধুর গভীর অনুরাগের অনেক কথা বলতে পারবেন। আজ বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে দেশের তো বটেই, আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির যে প্রভূত অগ্রগতি হতো, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্য বিশ্ব স্বীকৃতি অর্জন করেছিল আর জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় প্রদত্ত ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সুখের কথা, বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরাধিকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ভাষা-সংস্কৃতির বিকাশে সমভাবে আগ্রহী। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে অনেকেই অভিহিত করেছেন রাজনৈতিক কবিতা বলে। আজ সেই অনন্য ভাষণ বিশ^ ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি অর্জন করেছে। দেশে বিদেশে আজ মর্যাদার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি সংস্কৃতিজনদের বিন¤্র শ্রদ্ধা।

রামেন্দু মজুমদার : লেখক ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App