×

মুক্তচিন্তা

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ কবে হবে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২০, ০৭:৩৮ পিএম

প্রয়োজনের চেয়ে আমরা শুধু আমাদের লোভের কারণে যা করছি সে সম্পর্কে যদি কিছু সময়ের জন্য চিন্তা করি, তাহলে আমরা হয়তো উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো যে, আমরা কোথায় ভুল করেছি। আমাদের মন পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে। এটি আমাদের সুনাগরিক হতে এবং ভালো মানুষে পরিণত হতে সাহায্য করবে। একই সঙ্গে এই দেশটি শান্তির দেশে পরিণত হবে। হবে সত্যিকারের ‘সোনার বাংলা’। যে বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং লাখো শহীদ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিবস পালন করাও ছিল এদেশে কঠিন। এখন তার জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হচ্ছে নানা দুর্বোধ্য অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে, যা আমরা টেলিভিশনের পর্দায় ও আমাদের সংবাদপত্রের পাতায় প্রত্যক্ষ করি। টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর সমাধিতে নেতারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করছেন। সেখানে অনেকেই চোখের পানি ফেলছেন। ধর্মীয় আচারাদি করছেন, এরপর বাড়ি ফিরে আসছেন। এই রীতি তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতেও পালন করা হয়ে থাকে। খুব কমসংখ্যক লোক একটি প্রশ্ন নিয়ে কখনো ভেবেছেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে পথ আমাদের দেখিয়ে গেছেন, আমরা কখনো তা অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি কিনা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের মূল মন্ত্রের পর ভিত্তি করে। কিন্তু স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে একটি মতলববাজ গোষ্ঠী এদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার অপচেষ্টা করে। তাতে তারা যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে তার যথেষ্ট খেসারত এখনো আমাদের দিতে হচ্ছে। উগ্র হিন্দুবাদী জঙ্গিরা মহাত্মা গান্ধীর ভারতে অতিসম্প্রতি রক্তের যে হোলি খেলা খেলল তা সত্যিই ভয়ঙ্কর। মহাত্মা গান্ধীকেও হত্যা করেছিল এক হিন্দু। যার নাম নাথুরাম গড্সে।

আমাদের দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পরাজিত শক্তি দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের সঙ্গে মিলে ১৯৭১ সালে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছিল ১৯৭৫ সালে বঙ্গন্ধুকে হত্যা করে। যেভাবে ভারতকে যারা হিন্দু রাষ্ট্র্র করার জন্য ১৯৪৭ সালে চেষ্টা করে বিফল হয় তারাই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল। গান্ধীকে ব্রিটিশরা হত্যা করার সাহস করেনি। আবার বঙ্গবন্ধুকেও পাকিস্তানিরা হত্যা করতে পারেনি। দেশীয় শয়তানদের হাতে দুই মহান নেতাকে জীবন দিতে হয়েছে।

সদ্য সমাপ্ত দিল্লির বিধান সভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টির কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হয়ে হিন্দুবাদীরা চটেছে। তারই জেরে মুসলিমদের ওপর আক্রমণ! উগ্র হিন্দুরা উত্তর প্রদেশের ফৈয়াজাবাদ জেলার অযোধ্যার বাবরি মসজিদ যখন ভাঙে, তখন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। কেন্দ্রীয় সরকার বাবরি মসজিদ রক্ষা করতে পারত পর্যাপ্ত সেনাবাহিনী নিয়োগ করে প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে। কিন্তু কংগ্রেস সরকার তা করেনি। কংগ্রেস সরকারও হিন্দুদের চটাতে চায়নি। সেটি ছিল ভোটের রাজনীতির সমীকরণ। বাবরি মসজিদ রক্ষা না করায় এবং কংগ্রেসের ভ্রান্ত রাজনীতির কারণে ক্ষুব্ধ ভারতীয় মুসলিম ভোটাররা কংগ্রেস থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এরপর আঞ্চলিক দলগুলোর উত্থান ঘটে। বিজিপি (ভারতীয় জনতা পার্টি) শক্তি সঞ্চয় করে ফুলে ফেঁপে বড় হতে থাকে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক সরকার বাংলাদেশে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের আস্কারা দিতে থাকে। স্বাধীনতা বিরোধীরা ধর্মের কথায় আবারো মানুষকে ধোঁকা দিতে থাকে। ১৯৮১, ১৯৮৬ এবং ২০০১ সালে সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে বাংলাদেশ অস্থির হয়ে ওঠে। ধর্মান্ধ উগ্র জঙ্গিদের উত্থান ঘটে। উত্থান ঘটে স্বাধীনতা বিরোধীদের। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের ক্ষমতার অংশীদার করা হয়। একদিনে ৬৩ জেলায় বোমা ফাটিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করা হয়। বাংলাভাই নামের উগ্র জঙ্গির আবির্ভাব হয়। সামরিক সরকার আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতার পরে করা সংবিধান কাটা-ছেঁড়া করে রাষ্ট্রের ধর্ম নির্ধারণ করে দেয়। ভোটের রাজনীতির সমীকরণের কারণে হয়তো রাষ্ট্রধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারে না মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের সরকার!

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দণ্ড নিশ্চিত করেন। তারপর থেকেই চলছে ষড়যন্ত্র। দুর্নীতি এবং অপশাসন জনগণকে বিষিয়ে তুলেছে। তার সুযোগ নিচ্ছে মতলববাজ ধর্ম ব্যবসায়ীরা। নানা প্রক্রিয়ায় ধর্মের কথায় (অপব্যাখ্যায়) মানুষকে চটিয়ে দিয়ে ফায়দা লোটার পথ করে নিচ্ছে তারা। এর জন্য দায়ী অসৎ রাজনীতি, অপশাসন, দুর্বৃত্তায়ন, গণতন্ত্রহীনতা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করায় মতলববাজদের সুবিধা হতে চলেছে। যারা অন্যায় অনিয়ম দুর্নীতিকে আসকারা দিচ্ছে তারা এক সময় অবৈধ উপার্জিত অর্থের জোরে বিদেশের বাড়িতে পাড়ি দিবে। কষ্ট এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে পুড়ে মরবে সাধারণ মানুষ।

স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন তখনো কিছু অসাধু দলীয় লোক এবং দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও আমলারা অবৈধ অর্থ বিত্ত অর্জন করে। বঙ্গবন্ধু তখন কষ্টের সঙ্গেই বলেছিলেন দুর্নীতিবাজদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে। তিনি দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। তখনই তাঁকে হত্যা করা হয়।

কিন্তু বর্তমানে ক্ষমতার দাপটে সরকারি দলের কিছু ইতর দুর্নীতি করে জনমনে তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়ে চলেছে। শেয়ারবাজার, ব্যাংকের অর্থ লুটে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। দুর্নীতিবাজ অসৎ জনপ্রতিনিধি ও আমলা-কামলারা দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাচার করছে। রাষ্ট্রের টাকা লুটে নিয়ে বিদেশে বিলাসী জীবনযাপনের জন্য বাড়ি করেছে। ক্ষমতার বলয়ে থেকে কিছু জনপ্রতিনিধি এবং দলীয় নেতা দুর্নীতিবাজ অসৎ জনপ্রতিনিধি ও আমলা-কামলারা দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাচার করছে। ক্ষমতার দাপটে থেকে কিছু জনপ্রতিনিধি এবং দলীয় নেতা সরকারি (নদী, বিল, বাঁওড় ও খাস জমি) ও ব্যক্তিমালিকানার জমি জবরদখর করেছে এবং করছে। জুয়া মাদক ও নারীরা বারবণিতার মতো ঘৃণ্য কারবারে জড়িয়ে আমাদের সহজ সরল জীবনযাপন ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধকে কলুষিত করছে।

সুষ্ঠু গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন পুঁজিবাদী ও রক্ষণশীল এবং সমাজতন্ত্রী নেতারা, যারা যথাযথভাবে কাজ করতে পারেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনেক ভাবনাচিন্তা করে আমাদের সংবিধানে (১৯৭২ সালে) ধর্মের নামে কোনো রাজনীতি যাতে কেউ না করতে পারে তার জন্য ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করে আইন পাস করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে হত্যা করে সেই সংবিধান কাটা-ছেঁড়া করা হয়। যা এখনো সংশোধন করা হয়নি বা করা যায়নি। আদালত নিষিদ্ধ করার পক্ষে রায় দিলেও স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী দলকে সরকার নিষিদ্ধ করেনি।

রাষ্ট্রের আর একটি অপরিহার্য কর্তব্য হলো অপরাধীদের শাস্তি প্রদানের একচেটিয়া অধিকার কখনো প্রত্যাহার না করা। অপরাধের শাস্তি বিধান না করা হলে অপরাধীর সংখ্যা বেড়ে চলে। রাষ্ট্র যদি তার কর্তব্য পালন না করে এড়িয়ে চলে অথবা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সীমার বাইরে বিলম্ব ঘটায়, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ আইনকে তাদের হাতে তুলে নিতে উৎসাহিত হয় এবং তাদের সঙ্গে যারা অন্যায় করেছে তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে। আমরা যদি এখনো এই শিক্ষা গ্রহণ না করি, তাহলে আগামী বছরগুলোতে দেশে ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটবে।

একজন মানুষ যার হাজার কোটি টাকা আছে যে সবচেয়ে উপাদেয় খাদ্য গ্রহণ করে, সবচেয়ে দামি পোশাক পরিধান করে, বহুসংখ্যক ভৃত্য পরিবৃত হয়ে প্রাসাদোপম বিশাল বাড়িতে বসবাস করে, যার বিলাসবহুল গাড়ি আছে এবং অধিক চাহিদা আছে- তার আরো চাই। আরো বাড়িঘর ও সম্পত্তি এবং বিভিন্ন ব্যাংকে আরো অধিক পরিমাণে অর্থ। তার জানা উচিত যে, তিনি যখন মারা যাবেন তিনি এসবের কোনো কিছুই সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবেন না। সম্ভবত তিনি তার পুত্র-কন্যা নাতি-নাতনি এবং তার অনাগত অধঃস্তন প্রজন্মের জন্য এই সম্পদ রেখে যেতে চান। তার জানা উচিত যে, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ প্রকৃত অর্থে অনুপার্জিত সম্পদ এবং শিগগিরই তা পারিবারিক কলহ-বিবাদজনিত মামলায় টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। তিনি একজন সুখী মানুষ হিসেবে মৃত্যুবরণ করতে পারেন যদি তিনি যে অর্থ কাজে লাগাতে পারেননি তা দরিদ্রদের জন্য স্কুল, কলেজ এবং হাসপাতাল নির্মাণে ব্যয় করতেন।

প্রয়োজনের চেয়ে আমরা শুধু আমাদের লোভের কারণে যা করছি সে সম্পর্কে যদি কিছু সময়ের জন্য চিন্তা করি, তাহলে আমরা হয়তো উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো যে, আমরা কোথায় ভুল করেছি। আমাদের মন পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে। এটি আমাদের সুনাগরিক হতে এবং ভালো মানুষে পরিণত হতে সাহায্য করবে। একই সঙ্গে এই দেশটি শান্তির দেশে পরিণত হবে। হবে সত্যিকারের ‘সোনার বাংলা’। যে বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং লাখো শহীদ।

হাবিবুর রহমান স্বপন : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App