×

মুক্তচিন্তা

মাহেন্দ্রক্ষণের প্রতিজ্ঞা দৃঢ় হোক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২০, ০৯:২৯ পিএম

মার্চ মাসটির নামের সঙ্গে অগ্নিঝরা, সংগ্রামী, দুরন্ত, উত্তাল কত বিচিত্র বিশেষণ আমরা প্রয়োগ করি তার শেষ নেই! এসব বিশেষণ প্রয়োগ করি মার্চকে আরো গভীরভাবে অনুভবের জন্য। মার্চে বাঙালির স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন যে ক্ষণজন্মা মহামানব তাঁর শুভ জন্মদিন আগামীকাল ১৭ মার্চ। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মধ্য-মার্চের দুরন্ত সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আগামীকাল এই মহামানবের, এই মহানায়কের শততম জন্মদিন। আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর জন্মের সময়কাল ও বেড়ে ওঠা দেখতে পাইনি তারা তাঁর শততম জন্মদিনের সূর্য করোজ্জ্বল এই ভোর দেখতে পেয়েও ধন্য হব, গর্বিত বোধ করব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কেন আমাদের এই গর্ব আর অহংকার! কেমন নেতা ছিলেন তিনি, এই ভ‚গোল-বাংলাকে নিয়ে কেমন স্বপ্ন ছিল তাঁর? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাসমান নানা বক্তৃতার অংশবিশেষ থেকেও ওপরে বর্ণিত প্রশ্নগুলোর সহজ উত্তর অনুসন্ধান করা যায়। আমরা স্পষ্ট করে বললে আমাদের পূর্বপুরুষরা তাঁর স্বপ্নকে স্পর্শ করতে পারেনি না বাস্তবে, না কল্পনায়। স্পর্শ করতে পারেনি বলে, বিশ্বাস করতে পারেনি বলে মধ্যিখানে একটি গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। এই গোষ্ঠীর লোকরা ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হলে তাদের অস্তিত্ব মারাত্মকভাবে বিপন্ন হবে। তাই বিপন্ন অস্তিত্বের কল্পিত ভয় ও জিঘাংসা থেকে নরপিশাচের এই গোষ্ঠী নির্মমভাবে হত্যা করেছিল জাতির পিতাকে। হত্যা করেছিল সাত বছরের শিশু রাসেলসহ পরিবারের আঠারোজন সদস্যকে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যাই শুধু নয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে এ দেশের হাজার বছরের ইতিহাসকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে বাঙালির সংগ্রাম ও অগ্রগামিতার রাজনীতিকে পেছনের দিকে নিক্ষেপ করা হয়। ইতিহাসকে করা হয় কলঙ্কিত। এ দেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নাম। সেইসব চেষ্টার এক জঘন্য অপপ্রয়াস আমরা দেখতে পাই বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালনকে ঘিরে। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে করুণতম ১৫ আগস্টের দিনটিকে মিথ্যা আনন্দ আর হৈহুল্লোড়ে কাটানোর মাধ্যমে বেগম জিয়ার একটি জন্মদিন বানিয়ে তোলা হয়! রাজনীতির কী বিচিত্র অপকৌশল আমরা বেগম জিয়ার জন্মদিন পালনের মিথ্যা আড়ম্বরে দেখেছি! দেখেছি, কিন্তু প্রতিবাদ করার মেরুদণ্ড আমাদের ছিল না। আমাদের কেউ কোনোদিন সোচ্চার কণ্ঠে বলেনি যে, বেগম জিয়ার স্কুল সার্টিফিকেটের জন্মদিন বা জন্মতারিখ কীভাবে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের সময় পাল্টে যায়? আবার দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কী করে তার নতুন আরেকটি জন্মদিনের জন্ম ঘটে? আমাদের সে সাহস হয়নি। কারণ আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, বাংলাদেশের একমাত্র ভাগ্যবিধাতা বিএনপি-জামায়াত জোট! রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আসন থেকে কেউ কোনোদিন তাদের টলাতে পারবে না। কিন্তু সত্য ইতিহাসের প্রবল ধাক্কায় মিথ্যা অহমিকার সে আসন টলেছে। মিথ্যা আড়ম্বরের ওপর কোনো রাজনৈতিক দল টিকে থাকতে পারে না। বর্তমান বিএনপির দিকে তাকাল সে সত্যই স্পষ্ট হয়। আজ বাংলাদেশ ও বাঙালির ইতিহাস অমিত তেজে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে। সত্যনিষ্ট ইতিহাসের গায়ের ওপর থেকে সরে গেছে জামায়াত-বিএনপির চাপিয়ে দেয়া অন্ধকার ও মিথ্যার ভারী চাদর। তাই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ যে মানুষটিকে ইতিহাসের পাতা থেকে বিলীন করে দেয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা করা হয়েছিল অবশেষে, তাঁর নামটিই দেশ-ভ‚গোলের সীমানা পেরিয়ে সমগ্র বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু বঙ্গবন্ধুর নামটিই নয় বঙ্গবন্ধুর ভাষণও আজ পৃথিবীর নিপীড়িত, ভাগ্যাহত, বঞ্চিত ও শোষিত মানুষের আশ্রয়রূপ পাঠক্রমে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশও জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ। বিশ্ববাসী স্বীকার করে নিয়েছে বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কিন্তু এখনো দেশকে সার্বিকভাবে পশ্চাতের দিকে টেনে নেয়া অপশক্তির সেই দলভুক্তরা ক্ষমা চেয়ে, নিজেদের ভুল স্বীকার করে, মেনে নিতে পারেনি বঙ্গবন্ধুর অসীম অবদান। এই কৃতঘ্নতার শাস্তি অনেকটাই যেন ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ হিসেবে বর্তমান বিএনপির ওপর আছড় করছে! জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সবারই মেনে নিতে হবে। আওয়ামী লীগকেও বঙ্গবন্ধুকে দলের নিজস্ব সম্পদ ভাবার মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে হবে। বঙ্গবন্ধু সবার। জাতির পিতা সবার। বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকারের মাধ্যমে আপন অস্তিত্ব বিসর্জন দেয়ার মতো কোনো কাজ বাঙালির কেউ করবেন না বলেই আমাদের বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস থেকেই এই মহামানবের, এই মহানায়কের শততম জন্মদিনকে স্মরণীয় করে নিয়ে সবাই নিজেদেরও বরণীয় করার সুযোগলাভ করতে পারি। এই সুযোগ হাতছাড়া করার মধ্যে কোনো সাফল্য নেই, বীরত্বসূচক কোনো পৌরুষও নেই। পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার কোনো অবকাশও নেই রাজনৈতিক কোনো গোষ্ঠীর। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে এই দেশ, এই দেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। না হলে কোনো রাজনীতিই এ দেশে আর আত্মপ্রতিষ্ঠায় সাফল্য লাভে সক্ষম হবে না। কেননা তরুণ প্রজন্মের চোখ, বিবেক ও মনন এখন অনেক স্বচ্ছ। মিথ্যার আবরণ-আভরণ আর রাজনৈতিক ছল-চাতুরির অপকৗশল তাদের কাছে পরাস্ত। তাই ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’ রবীন্দ্রনাথের এমন আপ্তবাক্য মেনে নিয়ে দল-মত নির্বিশেষে জাতির পিতাকে গ্রহণে আর কোনো দ্বিধা বা বাধা কারোর মধ্যেই থাকা উচিত নয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘যত দ্বিধা বা বাধা ততই পিছিয়ে পড়া’ এ কথা সবারই মনে রাখতে হবে। অবশ্য বঙ্গবন্ধুকে সবার পক্ষে সর্বান্তকরণে মেনে নেয়া কঠিন। কারণ মেনে নিলেই অনেক আত্মত্যাগ প্রশ্নচিহ্ন হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় যা সবার পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। তাই অনেকেই ওপরে ওপরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দর্শন মেনে নিলেও ভেতরে ভেতরে রয়ে গেছেন দুর্নীতিগ্রস্ত, ঘুষখোর, মুনাফাখোর, লুটেরা-স্বভাবী, চোরাকারবারি, যারা দেশের মানুষকে ঠকিয়ে এ দেশের সম্পদ বিদেশে পাচারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষতি করছে। স্বার্থান্বেষী মহলের এরূপ অপকর্মের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর কঠোর হুঁশিয়ারি ছিল বলেই হয়তো তাঁর জীবনে ১৫ আগস্ট দ্রুততম সময়ে সৃষ্টি হয়েছিল! চট্টগ্রামে সেনা কর্মকর্তাদের এক অনুষ্ঠানে আমরা বঙ্গবন্ধুর এরূপ একটি সতর্কবাণীসমৃদ্ধ ভাষণ শুনি। সেখানে তিনি স্পষ্ট করেই অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক প্রকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সে যুদ্ধ শুরুর সময় তাঁকে দেয়া হয়নি। রাষ্ট্রের দুর্নীতিগ্রস্ত, ঘুষখোর, মুনাফাখোর, লুটেরা-স্বভাবী ও চোরাকারবারিদের যোগসাজশে ক্ষমতালোভীরা সৃষ্টি করেছিল কলঙ্কিত ১৫ আগস্ট। কারণ সে ভাষণে তিনি সোচ্চার কণ্ঠে উল্লেখ করেছিলেন : “তোমরা আদর্শবান হও, সৎপথে থেকো। মনে রেখ, ‘মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন/ মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন।’ মাঝেমাঝে আমরা অমানুষ হয়ে যাই! এত রক্ত দেয়ার পরে যে স্বাধীনতা আমরা এনেছি, চরিত্রের পরিবর্তন অনেকেরই হয় নাই এখনো ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, মুনাফাখুরি, বাংলার দুঃখী মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। দীর্ঘ তিন বৎসর পর্যন্ত এদের আমি অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, হুমকি দিয়েছি। চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী। কিন্তু আর না। [...] কিন্তু যেই দুঃখী মানুষ দিনভরে পরিশ্রম করে, তাদের গায়ে কাপড় নাই, যাদের পেটে খাবার নাই, যাদের বাসস্থানের বন্দোবস্ত নাই, লক্ষ লক্ষ বেকার, পাকিস্তানিরা সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেছে, কাগজ ছাড়া আমার জন্য কিছু রেখে যায় নাই, বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে আমাকে আনতে হয়, আর এই চোরের দল আমার দুঃখী মানুষের সর্বনাশ করে, এরা লুটতরাজ করে খায়। [...] এই বাংলার মাটি থেকে দুর্নীতিবাজ, এই ঘুষখোর, এই মুনাফাখুরি এই চোরাকারবারিদের নির্মূল করতে হবে। আমরাও প্রতিজ্ঞা নিয়েছি, তোমরাও প্রতিজ্ঞা নাও, বাংলার জনগণ প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করুক। আর না, অসহ্য (সহ্যের) সীমা হারিয়ে ফেলেছি! এই জন্য জীবনের যৌবন নষ্ট করি নাই, এই জন্য শহীদরা রক্ত দিয়ে যায় নাই যে, কয়েকটা চোরাকারবারি, মুনাফাখোর, ঘুষখোর দেশের সম্পদ বাইরে বার করে দিয়ে আসে, জিনিসের দাম, গুদাম করে মানুষকে না খাওয়াইয়া মারে! উৎখাত করতে হবে বাংলার বুকে থেকে এদের। দেখি কতদূর এরা টিকতে পারে, চোরের শক্তি বেশি না ইমামদারের শক্তি বেশি সেইডাই এহন প্রমাণ হয়ে যাবে। অন্যায়ের কাছে কোনোদিন মাথা নত করি নাই, বারবার পাকিস্তানিরা আমাকে ফাঁসি দিতে চেয়েছে, বারবার বুক টান করে আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি, কারণ আল্লাহ আমার সহায় ছিল, বাংলার জনগণের আমার দোয়া ছিল, এখনো সেই দোয়া আছে, ইনশাল্লাহ তোমাদের সাহায্য, তোমাদের সহানুভূতি, তোমাদের কাজ দেশের জনগণের ভালোবাসা আর ইমানদার মানুষের সহযোগিতায় এই দুষ্কৃতিকারীদের নির্মূল করতে হবে।” বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ সাম্প্রতিককালেও কি ব্যাপক প্রাসঙ্গিক। আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করছি আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণের নামে এখনো লুটেরাগোষ্ঠী দেশের সম্পদ বাইরে পাচার করছে, দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে আছে। আওয়ামী লীগের বর্ম ধারণ করে সাধারণের জীবনকে নানাভাবে সংকটাপন্ন ও বিপন্ন করে তুলছে! বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মদিন উদযাপনের এই মাহেন্দ্রক্ষণে আওয়ামী লীগ কর্মীদের তাঁর ভাষণের অনুরূপ এই প্রতিজ্ঞা দৃঢ়তার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে যে, ‘চোরাকারবারি, মুনাফাখোর, ঘুষখোর দেশের সম্পদ বাইরে বার করে দিয়ে আসে, জিনিসের দাম, গুদাম করে মানুষকে না খাওয়াইয়া মারে! উৎখাত করতে হবে বাংলার বুকে থেকে এদের।’ তবেই তাদের শততম জন্মদিন উদযাপনের আয়োজন সার্থক হবে। অর্থবহ হবে জাতির পিতার শততম জন্মদিন, ঘোষিত মুজিববর্ষ। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App