×

জাতীয়

রহস্যজনক কারণে ঝুলে আছে ত্বকী হত্যা তদন্ত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২০, ০৯:৫৫ এএম

রহস্যজনক কারণে ঝুলে আছে ত্বকী হত্যা তদন্ত

মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী/ ফাইল ছবি

নারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার ৭ বছর পার হলেও এখনো আলোচিত এ মামলার তদন্তই শেষ হয়নি। বিচারের আশায় দিন গুনছেন স্বজনরা। তাদের অভিযোগ, নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে চিহ্নিত প্রভাবশালীদের সম্পৃক্ততা থাকায় থমকে আছে তদন্ত। প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে অভিযুক্তরা।

ত্বকী হত্যার এক বছর পূর্ণ হওয়ার একদিন আগে ২০১৪ সালের ৫ মার্চ র‌্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ত্বকী হত্যায় আজমেরী ওসমানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। যে কোনো দিন এই মামলার চার্জশিট দেয়া হবে। এরপর কেটে গেছে আরো ৬ বছর। কিন্তু অভিযোগপত্র দেয়ার সেই ‘যে কোনো দিন’ এখনো শেষ হয়নি; রহস্যজনক কারণে ঝুলে আছে মামলাটির তদন্ত।

কিন্তু কী সেই রহস্য? তা জানা না গেলেও ত্বকীর বাবা নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ও নাগরিক আন্দোলনের নেতা রফিউর রাব্বি বলেছেন, ত্বকীর ঘাতকরা সরকারি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ও প্রভাবশালী হওয়ায় তদন্ত কার্যত থেমে আছে। তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ধরছে না। আর তাই প্রিয় সন্তানের খুনিদের বিচারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি। গত রবিবার নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় নিজ বাসায় তিনি ভোরের কাগজকে এসব কথা বলেন।

তদন্ত শেষ না হওয়ায় প্রতিবেদন জমা দিতে দেরি হচ্ছে- বিষয়টি এমন নয় উল্লেখ করে রফিউর রাব্বী দাবি করেন, র‌্যাব তদন্ত কাজ শেষ করেছে হত্যাকাণ্ডের এক বছর না যেতেই। ২০১৩ সালের ২৯ জুলাই আসামি ইউসুফ হোসেন লিটন ও ১২ নভেম্বর আসামি সুলতান শওকত ভ্রমর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। জবানবন্দিতে ত্বকীকে কখন, কীভাবে, কোথায়, কারা কারা এবং কেন হত্যা করেছে তার বিশদ বর্ণনা দেয় সে। তার বর্ণনা অনুযায়ী, ত্বকী হত্যাকাণ্ডের প্রধান পরিকল্পনাকারী ছিলেন আজমেরী ওসমান। কীভাবে তাকে খুন করা হবে, তা নিয়ে তিনি সুলতান শওকত, কালাম সিকদার, ইউসুফ, মামুন ও রাজীবের সঙ্গে পরামর্শ করেন। হত্যার স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল ওসমান পরিবারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান উইনার ফ্যাশনকে। অপহরণের রাতেই (৬ মার্চ) আজমেরী ওসমানের নির্দেশে ও উপস্থিতিতে তার টর্চারসেলে ত্বকীকে প্রথমে গজারির লাঠি দিয়ে পিটিয়ে অজ্ঞান করা হয়। পরে কালাম সিকদার নামে এক ঘাতক তার বুকের ওপর উঠে গলা চেপে শ্বাসরোধে হত্যা করে। রাত ১১টার মধ্যেই তারা ত্বকীকে হত্যার পর লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয়। পরে ওই টর্চারসেলে অভিযান চালায় র‌্যাব। সেখানে তারা দেয়ালে ও আসবাবপত্রে গুলির চিহ্ন দেখতে পান। আলামত হিসেবে সংগ্রহ করেন রক্তমাখা প্যান্ট, দড়ি, রক্তমাখা গজারির লাঠি, ইয়াবা সেবনের সরঞ্জামাদি, পিস্তলের অংশসহ বিভিন্ন বস্তু ।

এরপর ২০১৪ সালের ৫ মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে র‌্যাব জানায়, ত্বকী হত্যার সব রহস্য তারা উদঘাটন করেছে। সাংসদ শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানের ভাতিজা এবং প্রয়াত নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ১১ জন ত্বকীকে হত্যা করেছে। কী কারণে কখন, কোথায়, কীভাবে হত্যা করেছে এর সবই তারা সংবাদ কর্মীদের জানিয়ে একটি খসড়া অভিযোগপত্র সরবরাহ করে। যা আদালতে জমা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই সংবাদ সম্মেলনের পর ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই অভিযোগপত্র তারা আদালতে দাখিল করেনি।

রফিউর রাব্বির অভিযোগ, ইউসুফ হোসেন লিটন, সুলতান শওকত ভ্রমরসহ ৫ জনকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করলেও তারা সবাই এখন জামিনে আছেন এবং এলাকায় দাবিয়ে বেড়াচ্ছেন। এদের মধ্যে সুলতান শওকত ভ্রমরকে জামিনে বের করে গোপনে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

৭ বছরেরও চার্জশিট না হওয়ার কারণ : রফিউর রাব্বি মনে করেন, ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল শামীম ওসমানের ভাই সংসদ সদস্য নাসিম ওসমান মারা যাওয়ার পর জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী ওসমান পরিবারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতির কথা জানিয়েছিলেন। এরপর থেকেই ত্বকী হত্যার তদন্ত কার্যত থেমে যায়। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ত্বকীর খুনিদের ধরতে দ্বিধা করবে না। তার মতে, যেখানে পাপিয়ার মতো একজন চতুর্থ শ্রেণির মহিলা যুবলীগ নেত্রীকে গ্রেপ্তার করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা লাগে, সেখানে ত্বকী হত্যায় জড়িত প্রভাবশালী খুনিদের গ্রেপ্তার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ছাড়া সম্ভব বলে তিনি মনে করেন না। আর তাই ত্বকী হত্যার বিচার পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন রফিউর রাব্বি।

হত্যার তিন কারণ : রফিউর রাব্বি দাবি করেন, ২০১৪ সালের ৫ মার্চ র‌্যাব সংবাদ সম্মেলন করে ত্বকী হত্যার তিনটি কারণ উল্লেখ করেছিল। সেগুলো হচ্ছে : ১. ২০১১ সালের নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে তার (রফিউর রাব্বি) শক্ত অবস্থান নেয়া; ২. গণপরিবহনে শামীম ওসমান ও তার অনুগত লোকদের ব্যাপক চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে পরিবহনের ভাড়া কমানোর আন্দালনে তার নেতৃত্ব দেয়া; ৩. চিহ্নিত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ভ‚মি দখলের প্রতিবাদে জনগণের আন্দোলনে তার নেতৃত্ব দেয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে তারা ত্বকীকে হত্যা করেছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা ও সাংসদ শামীম ওসমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। এরপর এসএমএস পাঠালেও কোনো রিপ্লাই আসেনি।

শিগগিরই চার্জশিট : আলোচিত এ মামলার তদন্তের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে র‌্যাব-১১ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিন ভোরের কাগজকে বলেন, তদন্ত চলছে, তদন্তে বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে। শিগগিরই আমরা আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করব। তিনি বলেন, মামলায় আরো বেশ কিছু বিষয় আছে, যেগুলো উন্মোচিত হয়নি। এ কারণেই তদন্তে দেরি হচ্ছে।

পরবর্তী শুনানি ১৭ মে : ত্বকী হত্যা মামলায় বাদীপক্ষের আইনজীবী প্রদীপ ঘোষ গতকাল মঙ্গলবার ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা গত ২০ জানুয়ারি আদালতে একটি আবেদন করেছিলাম, ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে যাদের নাম এসেছে তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও অভিযোগপত্র দাখিলে তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাবকে নির্দেশ দেয়ার জন্য। তখন আদালত তাগিদ দিয়েছিলেন। গত ৯ মার্চ আগের আবেদনটি আবারো করেছি। তখন ম্যাজিস্ট্রেট বলেছেন, যেহেতু আগের দেয়া তাগিদের উত্তর আসেনি; সেহেতু আগামী ১৭ মে শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে এবং সেদিন আদেশ দেয়া হবে।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকেলে সুধীজন পাঠাগারে যাওয়ার পথে বঙ্গবন্ধু সড়ক থেকে ত্বকীকে অপহরণ করা হয়। ওই রাতেই ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি এবং র‌্যাব-১১ এর কার্যালয়ে চিঠি দেন। এর দুই দিন পর ৮ মার্চ সকালে শীতলক্ষ্যা নদীর খালের পাড় থেকে পুলিশ ত্বকীর মরদেহ উদ্ধার করে। সেদিন রাতেই রফিউর রাব্বি বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় অজ্ঞাতদের আসামি উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন এবং ১৮ মার্চ জেলা পুলিশ সুপারের কাছে ত্বকী হত্যায় শামীম ওসমান ও তার ছেলে অয়ন ওসমানসহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে একটি অবগতিপত্র দেন। পুলিশের তদন্তে মামলাটির আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় ২০১৩ সালের ২৮ মে উচ্চ আদালতের নির্দেশে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ত্বকী হত্যা মামলার তদন্তভার গ্রহণ করে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App