×

পুরনো খবর

দাও ফিরে সেই অরণ্য, লও এ নগর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২০, ০৭:৪৭ পিএম

ভাইরাসের জেনিটিক রেভোল্যুশনের মূলে রয়েছে দূষিত পরিবেশের প্রভাব। পৃথিবীর ওপর অতি দ্রুত বেড়ে চলা জনসংখ্যার চাপ। পরিবর্তিত জলবায়ু। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি। অরণ্য ধ্বংস করে অতিমাত্রায় নগরায়ন এবং মেগাসিটি সৃষ্টি। এরপর জৈব এবং প্রযুক্তিবিজ্ঞানের যদৃচ্ছা ব্যবহার। বিজ্ঞানসভ্যতার বিকেন্দ্রীকরণ। এদের কারণেই বিশ্বব্যাপী আজ করোনা ভাইরাসের নব নব শক্তিতে শক্তিশালী আবির্ভাব। প্রবল প্রতাপে দাপিয়ে চলা।

আধুনিক বিজ্ঞানে নিত্যনতুন আবিষ্কারের বিস্ময়কর তালিকা যত দীর্ঘ হচ্ছে, মানবজীবনের জটিলতা চারদিক থেকে ততই ঘনিয়ে উঠছে জট পাকিয়ে। তার লাইফ স্টাইলে যেমন নতুন নতুন রূপান্তর, তেমনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাখ্যাতেও নতুনরূপে জটিল রোগের প্রাদুর্ভাব। আপাতত করোনা ভাইরাস বিশ্বজীবনে আলোচনার মধ্যমণি। বহু বছর পর্যন্ত পশু আর পাখিদের মধ্যে এটি সীমাবদ্ধ ছিল। প্রথমবার মানবদেহ (শিশুরা) আক্রান্ত হয় ১৯৬৫ সালে। এই ভাইরাসের কারণে শ্বাসযন্ত্রে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, মাথাধরা, বমি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। তবে বর্তমানে করোনার যে নতুন প্রজন্ম তাদের চিত্রচরিত্র বদলে যাচ্ছে ঘন ঘন। ২০০২ এবং ২০০৩ সালে কারোনার ৫ ধরনের ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়েছিল। ২০১৫ সালে সেই সংখ্যা ছিল ৭। ২০১৯-এর শেষ প্রান্তে ৩১ ডিসেম্বর যখন প্রবল প্রতাপে সে সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়ে ওঠে, তখন এই সংখ্যা পৌঁছে যায় ৯ নম্বরে। স্বভাব চরিত্রের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কারণে এদের নামও বিভিন্ন। বর্তমানে করোনার যে প্রজন্মটি জগৎ কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা তার অফিসিয়াল নাম দিয়েছে ‘COVID-19’ ev Novel Coronavirus| আপাতত সেন্ট্রাল চায়না সিটি উহান ছাড়িয়ে কোভিড-১৯ বিষম দাপটে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তামাম দুনিয়ার ভৌগোলিক সীমানায়। আফ্রিকা, ইউরোপ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা মহাদেশের ১০৪টিরও বেশি দেশে সংহার মূর্তিতে তার জমজমাট রাজ্যপাটের ছড়াছড়ি এখন ক্ষণে ক্ষণে সংবাদ হচ্ছে। প্রতিদিনই সংবাদপত্রের গুরুত্বপূর্ণ শিরোনাম হয়ে বিশ্বমনে ঝড়ের তুফান তুলছে সে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে তার বিরুদ্ধে দ্রুত প্রতিরোধ গড়ার ব্যাপারে বিভিন্ন প্রিকশন নিয়ে আলোচনা চলছে বিস্তর। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এমন অবস্থাকে আন্তর্জাতিক পাবলিক হেলথের পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা দিয়েছে। তার ওয়েবসাইট থেকে মুহূর্তে মুহূর্তে করোনা আক্রান্ত রিপোর্টগুলো আপডেট করা হচ্ছে। ভাইরাসের উপস্থিতি আপাতত এতটাই উদ্বেগ আর ভীতির জন্ম দিয়েছে যে, সেটা কোনো কোনো দেশের জন্য জাতীয় সংকটে পরিণত। ফলে অন্যান্য দেশের মতো মার্কিন রাজ্যের শেয়ার মার্কেটেও পরপর কয়েকটি বিরাট ধস। অনেক দেশে ডোমেস্টিক এবং আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। ট্যুরিজম বন্ধ থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরাট ক্ষতি। লাখ লাখ মানুষ মাস্ক ছাড়া ঘরের বাইরে বেরোয় না। আক্রান্ত ব্যক্তিদের যথাসাধ্য আইসোলেট করা সত্তে¡ও সংক্রমণ ছড়াচ্ছে যথারীতি। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশ হচ্ছে চীন, ইতালি আর ইরান। ইতালিয়ান সরকার সাধারণ মানুষের অবাধ যাতায়াত বন্ধ করে ছকে ছকে সীমারেখা টেনেছে। ইরান দীর্ঘদিনের নিউক্লিয়ার তেজ সংহত করে ক’দিন ধরে শান্তির রাজ্যে নিমগ্ন। সৌদি সরকার আক্রান্ত দেশের ওপর ওমরাহ পালন আর মসজিদ দর্শনে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ওদিকে চীনের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন স্বয়ং ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশনের প্রধান ডক্টর গৌডেন। কারণ প্রথমদিকে ভাইরাস সম্পর্কিত সব তথ্য গোপন রাখার জন্য সরকার দেশের ডাক্তারদের মুখ বন্ধ করেছিল। সাধারণ মানুষকেও অন্ধকারে রেখেছিল। যাই হোক, করোনার স্পর্শ এড়াতে সব ধরনের সম্ভাব্য ব্যবস্থাই সুচারুভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে দেশে দেশে। কিন্তু অদৃশ্য ভাইরাস তো আর দৃশ্যমান মানুষের মতো সিকিউরিটির বলয় মানে না। অতএব পৃথিবীর নানা প্রান্তে রোজই নতুন নতুন আক্রান্ত হওয়া দেশের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যদিও আরোগ্য লাভের আশীর্বাদ সিংহভাগ মানুষ পাচ্ছে, তবে মৃত্যু সম্পূর্ণ থেমে নেই। তাই ক্ষণে ক্ষণে সেসব খবর প্রচার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই ভীতি-উদ্বিগ্নতার ব্যারোমিটার মানবমনে বাড়ছে। ভীতি আপাতত এতটাই চরমে যে, ইন্ডিয়ানা স্টেটের হেলথ ডিপার্টমেন্টের এক কর্মকর্তা বললেন- ২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বর জঙ্গি আক্রমণের কারণে এখানকার অর্থনীতিতে যেভাবে ধস নেমেছিল, কিংবা সমাজজীবনে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল, বর্তমান পরিস্থিতি তার চেয়েও মারাত্মক। কারণ তখন তো কেবল প্লেনের যাতায়াতই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু এখন ট্রেন বলুন, আর বাই রোডই বলুন, সবখানেই বিপদ যেন ওঁৎ পেতে আছে! করোনা ভাইরাস ‘কোভিড-১৯’ সত্যিই কি এতটাই মৃত্যুময় মূর্তিতে আবিভর্‚ত বিশ্বজুড়ে? সিজনাল ফ্লুতে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। নতুন ভাইরাস কি তার চেয়ে ভয়াবহ আর শক্তিশালী? ২০০২, ২০১২ সালে করোনার দুই ভিন্ন প্রজন্ম ঝঅজঝ (Severe acute Respiratory Syndrome, চীনে) এবং MERS (Middle East Respiratory Syndrome, সৌদি আরবে) অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটিয়েছিল। ২০০২ সালে চীনে ৮ হাজার ৯৮ জন আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে মৃতের সংখ্যা ৭৭৪। এই অনুপাত ১০০ জনে প্রায় ১০ জন। সৌদি আরবে ২০১২ সালে ২ হাজার ৪৯৪ জন আক্রান্ত হলে প্রাণবিয়োগ হয়েছিল ৮৫৮ জনের। এই অনুপাতও ৩৫ শতাংশ। অথচ কয়েক সপ্তাহে কোভিড-১৯ ভাইরাসে মৃত্যুর হার এখনো অবধি দুই শতাংশ। সোয়াইন ফ্লু, বার্ড ফ্লু, জিকা, ইবোলা সংক্রমণে পৃথিবীর নানা প্রান্তে এর আগে আরো বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। তাহলে করোনা নিয়ে এতটা উদ্বেগ আর ভীতির ধোঁয়াশায় জগৎ কেন আচ্ছন্ন হচ্ছে? মহামারি আকারে রোগের প্রাদুর্ভাব এর আগে বহুবার দুরন্তভাবে জটিল করে দিয়েছে সামাজিক, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে। ‘প্লেগ’ লাখ লাখ প্রাণ কেড়ে ইউরোপকে নড়বড়ে করে দিয়েছিল। যা নিয়ে ফরাসি লেখক ও সাংবাদিক আলবার্ট কামু তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য প্লেগ’ রচনা করে খ্যাতি কুড়িয়েছেন। ২০২০-এর করোনা ভাইরাসের ঘটনাগুলো এখনো ইতিহাসের খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠেনি। তারপরও ভাইরাসে কতসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হবে এবং সেই অনুপাতে কতসংখ্যক প্রাণ হারাবে, তার একখানা ভবিষ্যৎ হিসাব অতি উৎসাহীরা এরই মধ্যে সাধারণ মানুষের অবগতির জন্য ছেড়ে দিয়েছেন প্রচারমাধ্যমে। তাই করোনা নিয়ে এতটা বিশ্ব কাঁপানো পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে আদৌ কোনো অভিপ্রায় রয়েছে কিনা, প্রচার-প্রচারণা বিশ্বরাজনীতিতে পটপরিবর্তনের উদ্দেশ্যে কিনা, সে প্রশ্ন কারো কারো মন্তব্যে প্রচ্ছন্নভাবে উঠে আসছে। কারণ এ বছর নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ইরানের সাধারণ মানুষ সুখে নেই কট্টর ইসলামপন্থি সরকারের রাজত্বকালে। চীনে কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের অসন্তোষ অতি পরিচিত বাস্তবতা। আরব দুনিয়ায় ইরানকে নিয়ে যেমন, তেমনি আন্তর্জাতিক পৃথিবীতে চীনের শক্তিশালী হাত দুর্বল করার আকাক্সক্ষা অনেকেরই রয়েছে। ইতালির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক জটিলতাও প্রচ্ছন্ন নেই। তাই মৃতের সংখ্যা যত বাড়ছে, সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক মন্তব্যের ছড়াছড়িও হররোজ ততই মনোযোগ কাড়ছে উদ্বিগ্ন মানুষের। অবশ্য এটা ঠিক, কোভিড-১৯ কমন কোল্ড ভাইরাস হলেও এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গুরুত্বের সঙ্গেই গ্রহণ করা দরকার। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছোবল হেনে জনজীবনে সে জটিল সমস্যা ঘনিয়ে তুলেছে। তবে বাস্তবতা এটাই, আধুনিক জীবনে নতুন নতুন জটিলতা নিয়মিতই জন্ম নিচ্ছে। কারণ জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে দুস্তর জটিলতা মানুষের লাইফস্টাইলের অংশ হয়ে গেছে। সেটা মানুষের চিন্তা-চেতনায় কিংবা বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে যেমন, তেমনি রাজনীতি, সমাজভাবনাসহ মানবিক অধিকারের নানা প্রশ্নেও। তাই কোভিড-১৯ নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অপপ্রচারের জোয়ার বন্ধ করাই যে কেবল প্রয়োজন, তাই নয়। একইভাবে প্রয়োজন ভাইরাসের জন্ম এবং বৃদ্ধির অনুক‚ল পরিস্থিতি সৃষ্টি যাতে না হয় সেদিকে নজর দেয়া। এমনিতেই এই শতাব্দী মহামারির যুগ। আধুনিক মানুষ এই মহামারির জন্মদাতা। প্রতি বছর নতুন ভাইরাস উজ্জীবিত শক্তি নিয়ে জন্মলাভ করছে। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যাকে বলা হচ্ছে, ভাইরাসের জেনিটিক রেভোল্যুশন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যৎ থেকে ভবিষ্যতে এরা নতুন শক্তির উদ্দীপনায় বারবার ফিরে আসবে। অর্থনীতির সুস্থিরতা, জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়গুলো তখন ব্যাহত হবে বারবার। কারণ ভাইরাসের জেনিটিক রেভোল্যুশনের মূলে রয়েছে দূষিত পরিবেশের প্রভাব। পৃথিবীর ওপর অতি দ্রুত বেড়ে চলা জনসংখ্যার চাপ। পরিবর্তিত জলবায়ু। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি। অরণ্য ধ্বংস করে অতিমাত্রায় নগরায়ন এবং মেগাসিটি সৃষ্টি। এরপর জৈব এবং প্রযুক্তিবিজ্ঞানের যদৃচ্ছা ব্যবহার। বিজ্ঞানসভ্যতার বিকেন্দ্রীকরণ। এদের কারণেই বিশ্বব্যাপী আজ করোনা ভাইরাসের নব নব শক্তিতে শক্তিশালী আবির্ভাব। প্রবল প্রতাপে দাপিয়ে চলা। এর থেকে মুক্ত হতে চাইলে অদূর ভবিষ্যতে মানুষকে বলতেই হবে- ‘দাও ফিরে সেই অরণ্য, লও এ নগর’।

দীপিকা ঘোষ : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App