×

আন্তর্জাতিক

করোনায় বেসামাল বিশ্ব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২০, ০৯:২৮ এএম

করোনা ভাইরাস নামে এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে গোটা বিশ্ব। গত বছরের শেষ দিনে চীনের উহান শহর থেকে শুরু হওয়ার পর বিগত আড়াই মাসেই বিশ্বজুড়ে মহামারি রূপ নিয়েছে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস। অদৃশ্য শত্রর বেপরোয়া হামলার মুখে অসহায় বিশ্বজুড়ে লেগেছে আতঙ্ক আর মৃত্যুর মাতম। অণুজীব ঘাতকের হামলা ঠেকাতে দিকে দিকে উঠেছে সতর্কতার আহ্বানে, প্রাণান্ত প্রস্তুতি। কিন্তু এসব তৎপরতায় কাজের অগ্রগতি বা ফল মিলছে সামান্যই। পরিস্থিতি সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে বিশ্ব।

করোনা ভাইরাসের অভূতপূর্ব প্রভাব পড়েছে বিশ্বের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াঙ্গনসহ সব ক্ষেত্রে। শিক্ষা ও জনজীবন স্থবির হয়ে গেছে প্রায় সব দেশে। বিশেষভাবে আক্রান্ত দেশগুলো ছাড়াও পরস্পরের অবরোধের আওতায় পড়ে গেছে পৃথিবীর প্রায় সব দেশ। ভাইরাসের কবল থেকে রেহাই পাচ্ছে না উন্নত-অনুন্নত কোনো দেশই। বিশ^জুড়েই বাতিল করা হয়েছে সব ধরনের আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক ক্রীড়া ও অন্যান্য সমাবেশ। কোথাও কোথাও খেলা চলছে গ্যালারি শূন্য রেখেই। অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে দেয়া হয়েছে শীর্ষ নেতৃত্বের অংশগ্রহণে পূর্বনির্ধারিত সব ধরনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সম্মেলন ও সমাবেশ। এসব অঙ্গনের শীর্ষ তারকাদের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন করোনা ভাইরাসে। জনসমাগমের মাধ্যমে ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা থাকায় বাতিল হয়েছে জনপ্রিয় টুর্নামেন্ট, ম্যাচ ও সব ধরনের কনসার্ট। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখায় মরিয়া দেশের মধ্যেই বিশেষভাবে আক্রান্ত শহরগুলো অবরুদ্ধ করার পাশাপাশি ভিসা ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশ ও মহাদেশের ওপর। সব মিলিয়ে করোনার আঘাতে রাতারাতি থমকে গেছে পরিবহন শিল্প। ইতোমধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রায় সব ধরনের পণ্য আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। পরিণতিতে অপূরণীয় ধস নেমে এসেছে আন্তর্জাতিক শিল্প, বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে। চরম সংকটে পড়েছে বিমান চলাচল ও পর্যটন খাত।

বিশে^র ১২৭টি দেশে এখন পর্যন্ত ছড়িয়েছে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস। এতে আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি লোক, মারা গেছেন ৫ হাজারের অধিক। এর মধ্যে চীনে মারা গেছেন ৩ হাজার ১৭৭ জন, ইতালিতে ১ হাজার ২৬৬ জন, ইরানে ৫১৪ জন এবং দক্ষিণ কোরিয়াতে ৭১ জন। অন্যদিকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন প্রায় ৭০ হাজার মানুষ।

করোনা ভাইরাসের আঘাতে বড় ধরনের ধস নেমেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। এ ধরনের একটি বিপর্যয়ে বৈশ্বিক জিডিপি ৫ শতাংশ বা প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার কমে যেতে পারে বলে ধারণা করছে বিশ্বব্যাংক। এর আগে ২০০২-০৪ সালে চীন থেকে শুরু হওয়া সার্সে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সেবার বৈশি^ক জিডিপি কমে যায় প্রায় দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৪-১৬ সালে ইবোলা ভাইরাসের কারণে ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৫,৩০০ কোটি ডলার। তবে গত বছরের শেষ নাগাদ চীনের উহান থেকে শুরু হওয়া করোনা ভাইরাস সংক্রমণে ক্ষতির পরিমাণ ১৭ বছর আগের সার্সের চেয়ে অনেক বেশি ও ভয়ঙ্কর হবে। অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের প্রথম প্রান্তিকেই ৬ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়ে গেছে বিশে^। বর্তমান বিশে^র অন্যতম শীর্ষ অর্থনীতির দেশ চীন। ২০০৩ সালে ১.৬ ট্রিলিয়ন ডলারের চীনা অর্থনীতির আকার এখন ১৩.৬ ট্রিলিয়ন। এ সময়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা বেড়েছে।

করোনার আঘাতে দেশটির অর্থনীতি ১ শতাংশ কমে গেলেও বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। কেননা ২০০১ সালে বিশ^ বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দেয়ার পর ‘বিশ্ব কারখানা’ বলে পরিচিত চীন এখন বৈশ্বিক কাঁচামাল ও ফিনিশড পণ্যের সবচেয়ে বড় সংযোগস্থাপনকারী দেশ।

২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়ে অবহিত করে। তবে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের আগেও চীনের অর্থনীতি ভালো যাচ্ছিল না। চীনে প্রবৃদ্ধির গতি ২০১০ সালে যেখানে ১০.২ শতাংশ ছিল সেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি ঘটে মাত্র ৬.১ শতাংশ। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ অর্থবছরে চীনের প্রবৃদ্ধি ৪.৫ শতাংশের নিচে নেমে যাবে। ২০২০ সালে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৩.৩ শতাংশ হবে বলে আশা করা হলেও করোনা ভাইরাসের বিপর্যয়ের পর তা ৩ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। বিশ্ব¦জুড়ে ক্ষতির তালিকায় হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান সবার চেয়ে এগিয়ে থাকবে। জার্মান অর্থনীতি ০.২ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ০.১ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। জাপানের ক্ষেত্রে যা ০.৩ শতাংশের বেশি।

করোনা ভাইরাসের আক্রমণে বিশ্বের অর্থনীতি দু’ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রথমত, চীনের অর্থনীতিতে সার্বিক চাহিদা ঘাটতির মাধ্যমে এবং দ্বিতীয়ত, সরবরাহ বাজারের বিপর্যয়ের দ্বারা। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটন, হোটেল, পরিবহন ও যোগাযোগ খাত। ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাপী ভ্রমণবাবদ চীনারা ২৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করে। ২০১৯ সালের তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে তারা গড়ে ১৮ দিনের মতো অবস্থান করে মাথাপিছু ৭০০০ মার্কিন ডলার খরচ করে। উহান থেকে প্রতি সপ্তাহে ৫৫টি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পৃথিবীর ২০টি দেশে যাতায়াত করত। এখন তা নেমে এসেছে প্রায় শূন্যের কোটায়।

আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সমিতির হিসাবে, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে যাত্রীর সংখ্যা ১৩ শতাংশ কমে যাওয়ায় ২০,৯৩০ কোটি ডলারের মতো ক্ষতি হবে। বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন ১৩,০০০ ফ্লাইট বাতিল হয়ে যাচ্ছে। শুধু চীনা পর্যটকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় হংকং, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ডের প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। ইতোমধ্যে চীনা পর্যটক কমে যাওয়ায় থাইল্যান্ডের রাজস্ব আয় ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ১.৬ মিলিয়নে নির্ধারণ করা হয়েছে। চীনা পর্যটকদের অন্য দেশ ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা থাকায় শুধু নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়ার ৫৮০ কোটি ডলার ক্ষতি হবে।

অ্যাপল তাদের সব অফিস এবং ৪২টি সেন্টার বন্ধ ঘোষণা করেছে। ব্রিটিশ ব্র্যান্ড বারবেরি তাদের ৬৪ সেন্টারের মধ্যে ২৪টি, স্টার-বাকসের ২০০০ এর অধিক, ম্যাকডোনাল্ড ও ওয়ালমার্ট অনেক দোকান বন্ধ করে দিয়েছে। সাংহাই ডিজনিল্যান্ড বন্ধ হয়েছে। ক্রুড তেল আমদানিতে চীন বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে। চীনের চাহিদা কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমেছে ২০ শতাংশ। তেলের দাম কমে যাওয়ায় সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোর ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত ক্ষতির মুখে রয়েছে।

দ্বিতীয় যে কারণে বিশ্বের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা হলো সরবরাহ বিপর্যয়। কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, উৎপাদন হ্রাস ও সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য কমে যাবে। উহান মূলত বৃহৎ শিল্পের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে ৫০ শতাংশের বেশি অটোমেটেড শিল্প; যার ২৫ শতাংশের বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। চীন টেলিভিশন প্যানেল, এলইডি, চিপ, রেফ্রিজারেটরের কমপ্রেসার, এয়ারকন্ডিশন ইত্যাদির বৈশ্বিক যোগানদাতা। হুন্দাই চীন থেকে প্রাপ্ত কাঁচামালের অভাবে দক্ষিণ কোরিয়ায় তাদের সব কারখানা বন্ধ রেখেছে।

উৎপাদন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বিশ্বের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ ক্যাপিটাল মার্কেটে সূচকের দরপতন হয়েছে। বাংলাদেশে বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৫০ শতাংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত বস্ত্রশিল্পের আমদানিকৃত কাঁচামালের ৪৬ শতাংশ চীন থেকে আসে। এছাড়া চীন বাংলাদেশের ১২টি প্রকল্পে ৯০,০০০ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে যা বাধাগ্রস্ত হতে পারে করোনা ভাইরাসের কারণে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App