×

সাময়িকী

শিশুদের বন্ধু বঙ্গবন্ধু

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২০, ০৫:৪৯ পিএম

শিশুদের বন্ধু বঙ্গবন্ধু

আগামী ১৭ মার্চ বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মদিন। শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯৯৭ সালে দিবসটি পালন শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতে দেশ গড়ার নেতৃত্ব দিতে হবে আজকের শিশুদেরই। তাই শিশুরা যেন সৃজনশীল মুক্তমনের মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে- তিনি সব সময়ই সেটা চাইতেন। তাই জাতির পিতার জন্মদিনকে শিশু দিবস হিসেবে পালন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই দিনে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই মহান নেতার জীবন ও আদর্শ অনুসরণে এ দেশের শিশুদের যথাযোগ্য সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলাই হোক আজকে আমাদের অঙ্গীকার।

কোনো ভালো মানুষের বর্ণনা দিতে গিয়ে আমরা বলে থাকি, লোকটা শিশুর মতো সরল। শিশু শত্রু-মিত্র সবাইকে ভালোবাসে, সবাইকে বিশ্বাস করে। কখনো সে মানুষের ভালোবাসা পায়, আবার কখনো প্রতারিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সাথে শিশুদের মিল এখানেই যে, তিনিও শত্রু-মিত্র সব মানুষকে ভালোবাসতেন এবং সবাইকে নির্বিচারে বিশ্বাস করেছেন। শিশুদের মতো তিনিও মাঝে মাঝে মানুষের দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন তবু তিনি শিশু মতো মানুষের ওপর বিশ্বাস হারাননি। শিশুরা সাধারণত একটু জেদী হয়, এ জন্য বাবা-মা বিব্রত হন। বঙ্গবন্ধুও জেদী ছিলেন, মানুষের কল্যাণের জন্য তাঁর এই জেদ তাঁকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে গিয়েছিল।

শিশুরা স্বপ্নের জগতে বাস করে, আর স্বপ্ন বাস করে বঙ্গবন্ধুর জীবনে। বঙ্গবন্ধু তাঁর সারা জীবনের অভিজ্ঞতা, মেধা, জ্ঞান, অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও শিক্ষা দিয়ে স্বপ্নকে জয় করেছেন। স্বপ্ন তাঁকে সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। একজন মানুষের জীবন তখনই সফল হয় যখন তিনি তাঁর লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করেন। এই অর্থে বঙ্গবন্ধুর জীবন সফল।

শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, পৃথিবীর প্রায় সব মহাপুরুষের চরিত্র শিশুর মতো সরল। তাঁরা শিশুকে ভালোবাসেন, শিশুরাও তাঁদের ভালোবাসেন। আমাদের মহানবী (স.) শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। একদিন তিনি নামাজ পড়ার সময় সেজদায় যান, এ সময় তাঁর ছোট্ট নাতি তাঁর ঘাড়ে গিয়ে বসে। শিশু মনে কষ্ট পাবে বলে হজরত (স.) সেজদায় উপুড় হয়ে পড়ে রইলেন। শিশু নিজ ইচ্ছায় সরে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি ওই অবস্থায় পড়ে রইলেন। আজ সারা বিশে^ ধর্মের নামে কত মারামারি, হানাহানি, কত রক্তপাত। আর হজরত (স.) ধর্মের ওপর শিশুর ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিলেন।

ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু শিশুদের ভালোবাসতেন। শিশুরা তাঁকে ‘চাচা নেহরু’ বলতো। এ জন্য ভারতে নেহরুর জন্মদিন জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়। যেমন আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালিত হয়। এমনি আরো খোঁজ নিলে জানা যাবে মহামানবেরা সব সময় শিশুবান্ধব ছিলেন, শিশুপ্রিয় ছিলেন।

শিশুর মতো বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে জেদ থাকলেও তিনি কখনো বাবা-মাকে বিব্রত করেননি। এই জেদ তিনি ভালো কাজে ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য আন্দোলন শুরু করে। বঙ্গবন্ধুসহ আরো কয়েকজন ছাত্র এই আন্দোলনকে সমর্থন করেন। এই অপরাধে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুসহ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সব ছাত্র নেতাকে শাস্তিস্বরূপ অর্থ জরিমানা করে। বঙ্গবন্ধু ছাড়া সব ছাত্র জরিমানা দিয়ে শাস্তি থেকে রেহাই পায়। বঙ্গবন্ধু জরিমানা দিলেন না। তাঁর এক কথা, আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে তিনি কোনো অপরাধ করেননি। সুতরাং জরিমানা দিতে দিবেন না। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবেন না। বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে এই জেদের জন্য বিশ^বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে।

এই জেদ আমরা লক্ষ্য করি বিদ্যাসাগরের চরিত্রে, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর চরিত্রে। বিদ্যাসাগরের জেদের ফলে হিন্দু সমাজের বিধবারা হাজার বছরের বঞ্চনা ও অভিশাপ থেকে মুক্তিলাভ করে স্বাভাবিক মানুষের জীবন ফিরে পায়। সুভাষ বসুও তেমনি ভারতকে বিদেশি শাসন, শোষণ থেকে মুক্ত করার জন্য জাপানের সাহায্যে ভারত আক্রমণ করে। কিন্তু দুর্ভগ্যের বিষয় বিশ^যুদ্ধে জাপান মিত্রশক্তির হাতে পরাজিত হবার ফলে সুভাষ আর এগুতে পারেননি। যুদ্ধক্ষেত্রেই তাঁর মৃত্যু হয়। তবু তিনি শত্রুর সঙ্গে আপস করেননি। এই জেদ, এই আপসহীন চরিত্র আমরা দেখতে পাই বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে, বিদ্যাসাগরের চরিত্রে, নেতাজীর চরিত্রে।

ভালো কাজের জন্য জেদ না করলে বড় কিছু অর্জিত হয় না। আমরা হজরত (স.)-এর চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই তিনি সব সময় সত্যের পথে, ন্যায়ের পথে অবিচল ছিলেন। শত অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করেও সত্য পথ ত্যাগ করেননি। তাই আজ সারা বিশ্বে ইসলাম ধর্ম সত্যের ধর্ম হিসেবে সমাদৃত। কবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সত্য যে কঠিন, তাই কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।’

মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং মানুষের দুঃখ কষ্ট দূর করার চেষ্টা বঙ্গবন্ধুর ছোটবেলা থেকেই অভ্যাস ছিল। শৈশবে আমরা দেখতে পাই, বঙ্গবন্ধু তাঁর গরিব সহপাঠীদের প্রতি গভীর সহানু ভূতিশীল ছিলেন। বন্ধুকে ছাতা দিয়ে তিনি বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরেছেন। এমনি উদাহরণ তাঁর জীবনে অসংখ্য। মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। যৌবনের শুরুতে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, পরাধীনতার দৈন্যই আমাদের যত দুঃখ-কষ্টের কারণ। তাই তিনি বড়দের সাথে ইংরেজবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ইংরেজ বিতাড়িত হবার পর আমরা স্বাধীনতা লাভ করি। পাকিস্তান অর্জিত হয়। ঢাকার মাটিতে যেদিন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করেন, সেদিনই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর আসল চেহারা দেখতে পান- বাঙালি জাতি যে দ্বিতীয়বারের মতো পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে এই উপলব্ধি তাঁর হয়। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ধর্মের দোহাই দিয়ে বাঙালিদের শোষণ শুরু করে। এ দেশের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে পশ্চিম পাকিস্তানকে সমৃদ্ধ করে তোলে। চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে দুই অংশের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান গড়ে উঠতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিতাড়নের কঠোর সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু নেমে পড়েন। দীর্ঘ ১৪ বছর তিনি কারাগারে জীবন কাটান। শুরু হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে আটক রেখে হত্যার প্রস্তুতি নেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু তবুও তাঁর দাবিতে অটল ছিলেন। মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করেছিলেন। দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের ফলে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জিত হয়। ত্রিশ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়, তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট হয়। সারা দেশ আগুনে পুড়ে ছারখার হয়।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর দেশে শুরু হয় তাঁর নেতৃত্বে জাতি গঠনের কাজ। বাঙালি জাতি যাতে বিশে^র দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য তাঁকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, জেলে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আর কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। দেশে শুরু হয় স্বৈরশাসকদের দীর্ঘ রাজত্বকাল। দেশ আবার গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়- এভাবে চলে প্রায় পঁচিশ বছর। এ সময়টাকে বলা যেতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্ধকার যুগ। জাতি গঠনে নেমে বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন, শুধু প্রবীণদের দিয়ে নয়, নবীনদেরও কাজে লাগাতে হবে। তিনি বুঝেছিলেন, দেশের আগামী দিনের নাগরিক আজকের শিশুদের স্বার্থ সংরক্ষণের দরকার। আগামী দিনে তারাই জাতিকে নেতৃত্ব দেবে। সুতরাং তাদের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। শিশু মনে দেশপ্রেমের আগুন জ¦ালাতে না পারলে কোনো শিশু সুষ্ঠু নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে না। (তাঁর এ কথার সত্যতা মেলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বৈরশাসনের আমলে যেসব শিশুর জন্ম হয়, তাদের দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করার কোনো চেষ্টা হয়নি। তাদের পাঠ্যপুস্তকে বিকৃত ইতিহাস পড়ানো হয়। তারা যেন বীর বাঙালির উত্তরাধিকার তা ভুলিয়ে দেয়া হয়। যার ফলে পরবর্তীকালে যেসব শিশু বেড়ে ওঠে, তারা হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিহীন পরগাছা। তাদের চিন্তা-চেতনায় দেশ এবং দেশের মানুষের কোনো স্থান থাকে না।) ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে শিশুদের সক্রিয় ভ‚মিকা ছিল। এই শিশুদের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করেন। পরবর্তীকালে তারই আলোকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, শিশু হাসপাতাল ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। এছাড়া শিশুদের জন্য আরো নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ছোটবেলায় বঙ্গবন্ধুর নাম ছিল খোকা। আচরণে তিনি খোকাদের মতোই সরল, নিষ্পাপ ও জেদী ছিলেন। শিশুদের মতোই মানুষকে ভালোবাসতেন, শত্রু-মিত্র সবাইকে বিশ্বাস করতেন। যার ফলে মৃত্যু তাঁর অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এত বড় নেতা হয়েও, এত ব্যস্ততা সত্তে¡ও বঙ্গবন্ধু কখনো তার শিশুপুত্র রাসেলকে আদর করতে ভোলেননি। কোথাও যেতে তিনি রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। শিশু রাসেলও তাঁকে খুব ভালোবাসতো। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর ‘আমাদের ছোট্ট রাসেল সোনা’ গ্রন্থে লিখেছেন, রাসেল আব্বাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতো। আব্বাকে মোটেই ছাড়তে চাইতো না। শেখ হাসিনা আরো লিখেছেন, ‘রাসেলের সব থেকে আনন্দের দিন এলো যেদিন আব্বা ফিরে এলেন। এক মুহূর্ত যেন আব্বাকে কাছ ছাড়া করতে চাইতো না। সব সময় আব্বার পাশে ঘুরে বেড়াতো।’

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App