আসামের ভাষিক-জাতি সংকটের সেকাল-একাল
nakib
প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২০, ০৮:২৯ পিএম
বাঙালি রাজকর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরামর্শেই ব্রিটিশরা অসমিয়া ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষাকে সরকারি একমাত্র ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছিল। ১৮১৭ সালে শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারি কর্তৃপক্ষ অসমিয়া ভাষায় অনূদিত বাইবেল বাংলা ভাষায় প্রকাশ করে। এতে প্রমাণ করাও সহজ হয় বাংলা বর্ণমালাই অসমিয়া বর্ণমালা। একমাত্র ‘র’ ব্যতীত অসমিয়া বর্ণমালায় আর কোনো পৃথক বৈশিষ্ট্য নেই। অসমিয়া ভাষা বাংলা ভাষার উপভাষার অমর্যাদায় কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ওড়িশায়ও বাঙালি রাজ-কর্মচারীরা ওড়িয়া ভাষার ক্ষেত্রে একই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল। ওড়িশায় বসবাসকারী সচেতন বাঙালিদের হস্তক্ষেপে ওড়িয়া ভাষা জীবন ফিরে পেয়েছিল। আসামে অসমিয়া ভাষা সরকারি ভাষার মর্যাদা হারানোর পর সঙ্গত কারণে অসমীয়রা প্রবল বাংলা ভাষা ও বাঙালি বিদ্বেষী হয়ে ওঠে। ব্রিটিশদের আসাম রাজ্য দখলদারিত্বে অসমীয়রা একাধারে পরাজিত হলো ইংরেজদের দ্বারা, বাঙালিদের দ্বারাও। অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমেরিকান মিশনারিরা দীর্ঘকাল আন্দোলন করে। অসমিয়া ভাষায় অসংখ্য গ্রন্থ লিখে ও প্রকাশ করে তারা প্রমাণ করে যে অসমিয়া একটি পূর্ণাঙ্গ স্বতন্ত্র ভাষা। বাংলা ভাষার উপভাষা নয়। কলকাতার হিন্দু কলেজ থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকন এই ভাষা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অবশেষে ব্রিটিশ শাসকরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অসমীয় অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা প্রদান করে। তবে সামান্য হের-ফেরে প্রবর্তিত অসমিয়া ভাষার বর্ণমালা বাংলাই থেকে যায়। ভাষা এবং বর্ণমালার ওপর অন্যায় হস্তক্ষেপে অসমীয়মাত্রই বাঙালি বিদ্বেষী হয়ে পড়ে। অসমীয় জাতিসত্তার ওপর এমন হস্তক্ষেপ অন্যায় বলেই গণ্য করা যায়।
ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা তুর্কি-মোগলদের অধীনে কখনো ছিল না। পশ্চিমের সব আগ্রাসন প্রবলভাবে তারা প্রতিহত করেছিল। গৌড়বিজেতা মহম্মদ বিন বখতিয়ারকে পর্যন্ত তারা প্রতিহত করেছিল। হটিয়ে দিয়েছিল মীর জুমলাকেও। একমাত্র আগ্রাসী বর্মী-মগদের প্রতিহত করতেই ব্রিটিশদের পক্ষে আসামের দখলদারিত্বের পথ সুগম হয়। পরিণাম যে শুভ হয়নি, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। যে ব্রিটিশরা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা দখলে বারবার পরাস্ত হয়েছিল। একমাত্র আগ্রাসী বর্মী-মগদের আগ্রাসন ঠেকাতে তাদের আসাম বিজয় সম্ভব হয়েছিল। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার পশ্চিমাঞ্চল কামরূপ কেন্দ্রানুগ না হয়েও বাংলা প্রদেশের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত ছিল। কোচবিহারকেও কামরূপ বলা হতো। অসমিয়া ভাষার কবি-সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কোচ নৃপতি। বার্মার শান রাজ্য থেকে পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা ডিঙিয়ে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় প্রবেশ করেছিল অহোমদের আদি জাতি। এরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিল না। ছিল প্রবল হিন্দুবিরোধী। বংশ পরম্পরায় এদের চিন্তা-চেতনা, নীতি-নৈতিকতার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। এরা ক্রমেই হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে এবং নিজেদের স্থানীয় আদিবাসী রূপে ভাবতে শেখে। তিন-চারশ বছরের ব্যবধানে এরা পার্শ্ববর্তী ভারতীয় লোকাচার-সংস্কৃতি অনুসরণ করে স্বতন্ত্র ভাষা-সংস্কৃতির আচার গড়ে তোলে।
আসামের বাঙালি বিদ্বেষী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে ১৯৬০ সালে। শিলংয়ে অসমিয়া ভাষা রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষার ঘোষণার পরমুহূর্তে পার্বত্য জাতিসত্তার মানুষরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তবে বাঙালিরা অসমিয়া ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার সমমর্যাদার দাবি তোলে। অসমীয় প্রচার মাধ্যমগুলো বাঙালিদের প্রকৃত দাবিকে আড়াল করে অসমিয়া ভাষার প্রতি বাঙালিদের অশ্রদ্ধার মিথ্যা সংবাদ প্রচার করে। এতে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশে বাঙালিবিরোধী সহিংস হয়ে ওঠে অসমীয়রা। বিক্ষোভকারী পার্বত্য খাসি জাতিসত্তার কাউকে নাগালে না পেয়ে তাদের সহিংস লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বসবাসকারী বাঙালিরা। অথচ ব্রহ্মপুত্র ও কাছাড়ের বাসিন্দারা অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষার ঘোষণায় নিশ্চুপ ছিল। অথচ তাদেরই সহিংসতার শিকার হতে হয়েছিল।
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই অসম রাজ্যে অসমীয়দের প্রাধান্য থাকবে। বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে তাদের সর্বাধিক বসবাস। সেসব অঞ্চলে তাদের ভাষার অবাধ প্রচলন থাকবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। তবে বরাক উপত্যকায় সুদীর্ঘকালের বসবাসকারী বাংলাভাষীদের ওপর জোরপূর্বক অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেয়া, তাদের উচ্ছেদ-উৎপীড়ন করাকে সমর্থন করা যায় না। অসমীয়দের ভয় দুই বাংলার জনসংখ্যার প্রভাবে তাদের না-সংখ্যালঘুতে পরিণত হতে হয়! এতে আসাম রাজ্যটি হয়ে পড়বে বাংলার উপনিবেশ। তাদের দশা ত্রিপুরা ও কাছাড়ের আদিবাসীদের অনুরূপ হয় কিনা এই আতঙ্ক অসমীয়দের মধ্যে আজো ক্রিয়াশীল। মেঘালয়ের ন্যায় কাছাড়কেও আসাম রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করাকে তারা বোধকরি সানন্দে গ্রহণ করবে। পলাশীর যুদ্ধের পর একমাত্র গোয়ালপাড়া ইংরেজরা দখল করলে ইংরেজদের সঙ্গে অসমীয়দের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গোয়ালপাড়া বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল হলেও আসাম রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত। অথচ গোয়ালপাড়া অখণ্ড বাংলারই অংশরূপে সুদীর্ঘকাল বাঙালি অধ্যুষিত। ভারতের স্বাধীনতার পূর্বে সুরমা ও বরাক উপত্যকাসহ আসাম রাজ্যে বাঙালিরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। অসমীয়দের ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায় ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা এবং অপরিণামদর্শী দেশভাগে। তখন থেকেই অসমীয়দের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। ইংরেজ বিদায় নেয়ায় দেশভাগে আসামে বাঙালিরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। অসমীয়দের সব অপ্রাপ্তির দুয়ার উন্মোচিত হয় অনাবিল প্রাপ্তিতে। রাজ্য সরকার, বিধানসভা, প্রশাসন, আদালত, শিক্ষাঙ্গন সর্বত্র অসমীয়দের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। বাঙালিরা তাদের অধিকার-মর্যাদা পুনরুদ্ধারে অসমীয়দের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। অসমীয়রা ইংরেজদের ন্যায় বাঙালি বিতাড়নেও সক্রিয় হয়ে ওঠে। যার ধারাবাহিকতা আজো চলমান।
নিজ ভাষার দাবিতে যে অসমীয়রা আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিল, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগে তারাই বাংলাভাষী এবং পার্বত্য জাতিদের ভাষা-সংস্কৃতি হরণে তৎপর হয়ে ওঠে। আসাম রাজ্যের কাছাড়, মিকির, বোড়ো অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভাষার অধিকার অসমীয়রা স্বাধীনতার (১৯৪৭) পর হতে এ যাবৎ স্বীকার করতে নারাজ। স্বাধীনতার পর আসাম রাজ্যের অঙ্গচ্ছেদ ঘটে। নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মেঘালয় প্রভৃতি রাজ্য সৃষ্টি করা হয় ভাষা সমস্যার অজুহাতে। ভারতের শাসকশ্রেণি ভাষা সমস্যার বিষয়টি সামনে আনলেও নেপথ্যে যে ভিন্ন অভিসন্ধি ছিল না তা কিন্তু নয়। যে অসমীয়রা নিজেদের রাজ্যের নিরঙ্কুশ অধিকারে অপর জাতিসত্তাদের অনুপ্রবেশকারী বলছে, তাদের পূর্বপুরুষরা দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তিব্বত, মিয়ানমার থেকে এসে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বসতি স্থাপন করেছিল। তারা প্রকৃতই ছিল না যেমন আসামের তেমনি তাদের ভাষাও ছিল না অসমিয়া। ইংরেজ শাসনাধীনে উত্তর ও পূর্ব অঞ্চল সুরক্ষিত হলে, দক্ষিণ অঞ্চল বাংলাভাষী এবং উত্তর-পূর্ব অঞ্চল নেপালিভাষী ও হিন্দিভাষী রাজস্থানিরা বসতি গড়ে তোলে। অগ্রসর বাংলাভাষীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে মাতৃভাষার শিক্ষা-প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হলেও নেপালিভাষী ও হিন্দিভাষী রাজস্থানিরা ভাষার প্রশ্নে অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতি নীরবে মেনে নেয়। সে কারণে তাদের প্রতি অসমীয়দের বিরাগ নেই। রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় অগ্রসর বাঙালিরা অসমিয়া ভাষার কর্তৃত্ব স্বীকার না করে অসমীয়দের প্রতিপক্ষ বহুকাল-বহুযুগের। আসামে বাঙালি খেদাও আন্দোলনে বিদেশি অনুপ্রবেশকারী দাবি তুলে বাঙালিদের জনগণনা বা নির্বাচনে ভোটের অধিকার হরণের জোর চেষ্টা চলছে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে অনুপ্রবেশকারী ঠেকানোর দাবিও তুলেছে। এতে ভারতের শাসকশ্রেণির সহানুভূতি অসমীয়রা পেয়েছে। বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি এই জাতিগত বিভাজনকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের হাতিয়ারে পরিণত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কংগ্রেসের পরাজয় ও বিজেপির উত্থানের মূলেই ছিল হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতা। বিজেপি বাঙালি হিন্দুদের প্রশ্নে ছাড় দিতে আপত্তি না তুললেও বাঙালি মুসলমানদের বিতাড়নে অসমীয়দের ক্রমাগত উসকানি দিয়ে যাচ্ছে। পুনরায় রাজ্যের ক্ষমতা লাভে মরিয়া বিজেপি তুরুপের তাস রূপে মুসলিম বাঙালি বিদ্বেষী আওয়াজ তুলে তাদের বিতাড়নে অসমীয়দের ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছে।
ভাষা ও সম্প্রদায়গত সংমিশ্রণে ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে দাঙ্গা-সংঘাত সংঘটিত হয়েছিল। অসংখ্য বসতবাড়ি অগ্নিসংযোগসহ সহিংস সেই দাঙ্গায় দেড় হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। ১৯৮৩ সালের নির্বাচনের চার বছর পূর্বেই আসামের বহিরাগতদের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের ভোটাধিকার বঞ্চিত ও বহিষ্কারের দাবিতে সোচ্চার হয় অসু (অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন) এবং আপসপ (অল অসম গণসংগ্রাম পরিষদ)। আসামের ভাষা সংঘাতের সমাধানে অন্নদাশঙ্কর রায় ‘অ’মোর চিকুনি দেশ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আসামকে অবিভক্ত রেখে সেখানকার মাইনরিটির মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে এমন এক মীমাংসাসূত্র আবিষ্কার করতে হবে যেটা আসামের বাইরেও প্রয়োজ্য। আসাম এ বিষয়ে সৃষ্টিছাড়া নয়। অন্যত্র একই সমস্যা। কোথাও কম, কোথাও বেশি। অসমিয়া ভাষাগোষ্ঠীকে মেজরিটি দেয়া হয়েছে, কিন্তু মেজরিটি মানে টোটালিটি নয়।’ আসামের অর্থনীতিতে অবদান রাখা বাঙালিদের প্রশ্নে আসামের উগ্রবাদী উলফা তাদের একটি দলিলে স্বীকার করেছে- ‘বহিরাগতরা কঠোর পরিশ্রমী ও আসামের উৎপাদন ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা আছে এবং তারা আসামের জনজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।’ (টাইমস অব ইন্ডিয়া ২৯ জুলাই ১৯৯২)
জাতিসত্তার প্রধান উপাদান ভাষা। আর এই ভাষাকে কেন্দ্র করে আসামে ভাষার সংঘাত দীর্ঘ মেয়াদে ঘটে এসেছে। রাজ্যের শাসক দল বিজেপি জাতিগত সমস্যাকে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টিকে আদা-জল খেয়ে নেমেছে। আসামের ঐক্যবদ্ধ হিন্দু-মুসলিম বাঙালিদের বিভাজিত করার চক্রান্ত করে চলেছে ধর্মের বিভাজনে। জাতিগত সংঘাত সাম্প্রদায়িক সংঘাতের পথে ঠেলে দিচ্ছে রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যে। আসামের বাঙালিরা যদি সেটা উপলব্ধি করতে সচেষ্ট হয় তবেই বিজেপির হিন্দুত্ববাদী তৎপরতা বন্ধ হবে। নচেত ভাষিক সমস্যাকে আড়াল করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আসাম উত্তপ্ত হলে সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সাংবিধানিক অস্তিত্ব বিলীন হতে খুব বেশি সময় নেবে না।