×

মুক্তচিন্তা

সব সংকীর্ণতা ও প্রভুত্ববাদ থেকে মুক্তিতেই গণতন্ত্রের মুক্তি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২০, ০৭:১০ পিএম

গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সমাজে রাজনীতিতে তার বাস্তবায়ন নিয়ে একাডেমিক বৃত্তের বাইরেও রাশি রাশি রচনার পরিমাণ পাহাড়প্রমাণ। বাংলাদেশও এদিক থেকে খুব একটা পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের জন্য আহাজারি এক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অভ্যাসে পরিণত। তা সত্ত্বেও গণতন্ত্রের পক্ষে এ লেখা এক ধরনের স্ববিরোধিতারই প্রকাশ। এর কারণও আছে। গণতন্ত্রের এমনই দুর্ভাগ্য যে এ সম্বন্ধে লিংকনের বিশ্বে স্বীকৃত আপ্তবাক্য এবং এর রাজনৈতিক উচ্চমন্যতা নিয়ে বহু কথনের পরও গণতন্ত্রের এমনই দুর্ভাগ্য যে এর চড়াই-উতরাই ভাঙার সে দুর্ভাগ্য আর শেষ হলো না। এখন সবাই একমত যে বর্তমানে বিশ্বজুড়ে রক্ষণশীলতার প্রাধান্য লক্ষ করা যাচ্ছে, বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের প্রতিনিধি ইউরোপ-আমেরিকায়। আদর্শিক সংকীর্ণতার পাশাপাশি রক্ষণশীলতা ও প্রভুত্ববাদ-কর্তৃত্ববাদের ঢেউ বেশ জোরালো হয়ে উঠছে। এ ব্যাপারে পরাশক্তির আগ্রাসী ভ‚মিকা অপ্রতিরোধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আসীন হওয়ার পর থেকে। তার অভিশংসন খারিজ হয়ে যাওয়ার পর থেকে তার অনাচার আরো বেড়ে চলেছে। আর বাকি বিশ্বের শক্তিমানরাও সংকীর্ণতা-রক্ষণশীলতা ও কর্তৃত্ববাদের পথকেই চলার যোগ্য মনে করছে। ব্যতিক্রম নয় এশিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশ। দুই. গণতন্ত্রের তাত্তি¡ক আলোচনায় না যেয়ে এক কথায় বলা যায়, গণতন্ত্র নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধি সুলভ শাসনই নয়, জনগণের ইচ্ছার স্বীকৃতি ও চাহিদা পূরণের শাসন ব্যবস্থা যেখানে সংখ্যালঘু ইচ্ছা-আকাক্সক্ষাও অন্তর্ভুক্ত। গণতান্ত্রিক শাসনের অর্থ সংখ্যাগরিষ্ঠের তোষণ ও সংখ্যালঘুর দমন নয়। সেইসঙ্গে ব্যক্তি থেকে সমষ্টি পর্যন্ত সর্বাত্মক চাহিদার বা আকাক্সক্ষার স্বীকৃতি যাকে আধুনিক ভাষায় আমরা বলি ব্যক্তি স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা (বাক স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা) ইত্যাদি। এক কথায় মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তা প্রকাশ স্বাধীন পরিবেশ ধর্মীয় বা রাজনৈতিক মতাদর্শসহ যা জনস্বার্থ বিরোধী নয়। তর্কের কচকচিতে না যেয়ে বলা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতের সমর্থনে নির্বাচিত হলেই শাসক-প্রতিনিধি সংখ্যালঘু মতামত বা স্বার্থ দলিত করতে পারে না, যেমন করেছিল হিটলার শাসন ক্ষমতার ম্যান্ডেট পেয়ে। সহিষ্ণুতা ও ভিন্নমতকে অগ্রাহ্য না করে যুক্তিসঙ্গত বিবেচনায় রাখাও গণতন্ত্রের স্বীকৃত চরিত্র লক্ষণ। অনেক সময় ভিন্নমতেও জনস্বার্থ বিষয়ক উপাদান উঠে আসতে পারে। একদর্শী বা একমুখী ব্যবস্থা বা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া সব সময় জনহিতকর বা মঙ্গলদায়ক নাও হতে পারে, তাই বহুমতের বিবেচনা হিসেবে রাখা গণতান্ত্রিক চেতনার অংশ স্বরূপ, সন্দেহ নেই। প্রভুত্ববাদ-কর্তৃত্ববাদ এর বিপরীত পথ ধরে চলে। গণতন্ত্রের অপর নাম বহুত্ববাদের সহিষ্ণুতা। তিন. বিভাগ-পূর্ব ভারতীয় উপমহাদেশে বহুত্ববাদের চর্চা এবং সেই ধারায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান অনিবার্য হয়ে উঠেছিল সময়ের দাবি হিসেবে। নদীমাতৃক, উর্বর, শস্য ফলপ্রসূ ভারতীয় উপমহাদেশ দূর জাতি বা জনগোষ্ঠীর বসতির জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। তাই আগমন ঘটে আর্য, দ্রাবিড়, মোঙ্গলীয় প্রাচীন বহিরাগত থেকে কবির ভাষায় ‘শক-হুন দল পাঠান-মুঘল’ তুর্কিসহ অনেকের। সবার বসতি ও অবস্থানে ভারতবর্ষ হয়ে ওঠে বহুভাষী, বহুজাতিক, বহুবর্ণ ও বহু সংস্কৃতির, এমনকি বহু ধর্মবিশ্বাসীর উপমহাদেশ। প্রত্যেকেরই অবস্থানগত সমান অধিকার। সেই অর্থেই তৎকালীন ভারতবর্ষ বহুত্ববাদী আদর্শের কেন্দ্রস্থল। যা সমন্বিত সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতীক। এক সময় ছিল সামন্তভ‚স্বামী ও রাজন্যবাদীদের যুগ। সামরিক শক্তি ও বিচক্ষণ পরিচালনায় ভূখণ্ড জয়, রাজ্যবিস্তার, সাম্রাজ্যের অভ্যুদয় এক কথায় সামরিক শক্তির প্রবলতায় এক একটি রাজ্যের বিলুপ্তি বা সীমারেখা বদল হয়ে উঠেছিল অনিবার্য রাজনৈতিক ঘটনা। বিশ^সহ ভারতবর্ষের অভ্যন্তরেও ঘটেছে রাজ্য ও রাজ্যসীমার পরিবর্তন প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত। অভ্যন্তরে বহুধা বিচ্ছিন্নতা। আধুনিক যুগে ইংরেজ শাসনের কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটায় দীর্ঘ ১৯০ বছরের শাসনে। ভারতীয় উপমহাদেশ তার বহুভাষী বহুজাতিক প্রাদেশিক সত্তাসহ পূর্ণ কাঠামোর একটি ভূ-রাজনৈতিক চরিত্র অর্জন করে যে সংহতি এতটা আগে দেখা যায়নি। ইতোমধ্যে বিদেশি শাসনের অবসান ঘটাতে একদিকে স্বাধীনতা-সংগ্রাম, অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংকীর্ণতা এবং শাসক ক‚টনীতির টানে অভ্যন্তরীণ বিভেদ প্রধান হয়ে ওঠে। ইংরেজ শাসন বাধ্যতামূলক বিদায় নেয়ার সময় (১৯৪৭ আগস্ট) ওই বিভেদমূলক সংকীর্ণতাকে মূলধন করে বিশাল উপমহাদেশকে দ্বিভাজিত করে যায় ভারত ও পাকিস্তান নামের দুই স্বতন্ত্র ভূখণ্ডে। কিন্তু জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের রাজনৈতিক সংকীর্ণতা সার্থক হয় না, অর্থব্যঞ্জক হয় না বাস্তবতার টানে। ভারতে থেকে যায় কয়েক কোটি মুসলমান (সেই বহুত্ববাদের প্রতীকী রূপে) এবং পাকিস্তানে হিন্দু ও খ্রিস্টান। পাকিস্তান বাস্তবে জিন্নাকথিত ইসলামিস্তান হয়ে ওঠে না। কিন্তু চেষ্টা চলে। ভারতসহ বিশ্ব পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক যুগ গণতন্ত্রের যুগ হিসেবে কথিত ও স্বীকৃত। ভাষাভিত্তিক সেই গণতান্ত্রিক চেতনার টানে এবং পাকশাসক সৃষ্ট পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্যের অবসান ঘটাতে গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গে যে আন্দোলন, সংগ্রাম ও অবশেষে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ তা সংকীর্ণ ধর্মবাদী পাকিস্তানি মতাদর্শের পতন ঘটায়, অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের (১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১)। পূর্ববঙ্গের নতুন নাম ‘বাংলাদেশ’ নতুন মানচিত্র ও নতুন পতাকা হাতে। তার ভিত্তি হয়ে ওঠে সেকুলার গণতন্ত্রী সংবিধান (১৯৭২)। দ্বিজাতিতত্তে¡র বিভ্রান্তিকর সংকীর্ণতামুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনে প্রতিবেশী দেশ গণতন্ত্রী ও সংবিধানের বহুত্ববাদী দেশ ভারতের ছিল প্রত্যক্ষ সামরিক-রাজনৈতিক অবদান, সেইসঙ্গে কূটনৈতিক সমর্থন। তবে আন্তর্জাতিক পরিসরে কূটনৈতিক-রাজনৈতিক সমর্থনের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রবল বিরোধিতার মুখে বিচক্ষণ ও বলিষ্ঠ ভ‚মিকা ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তাদের বারবার কঠিন ইতিবাচক ভূমিকা পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল। এমনকি বিজয়ের পূর্ব মুহূর্তে মার্কিন নৌবহরের আক্রমণাত্মক ভূমিকাকেও পরাস্ত করে অগ্রসরমান সোভিয়েত নৌবহর। চার. পরাজয় ঘটে সংকীর্ণতা-রক্ষণশীলতাবাদী ধর্মীয় রাজনীতি ও রাষ্ট্রনৈতিক প্রভুত্ববাদের। এ যুদ্ধ ছিল সেকুলার গণতন্ত্রের বিজয়। বিজয় বহুত্ববাদী শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের। রাজনীতির কুটিলতারও পরাজয় ঘটে এ যুদ্ধে। পাকিস্তানের অপরিণামদর্শী বিভেদনীতির ফলাফলে পূর্ব-পশ্চিমের বিচ্ছিন্নতা, অন্যদিকে জিন্নাহর পূর্বোক্ত অগণতান্ত্রিক, যুক্তিহীন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তি নষ্ট হয়ে যায়। সেই থেকে ভারত মিত্রদেশ হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু রাজনীতির পালাবদল ঘটে অভ্যন্তরীণ নানা কারণে যে বিষয়ে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন নেই, বিষয়টি বহু আলোচিত। সেই পরিবর্তনের ছায়াপাত ঘটেছে বহুদিন থেকে ভারত-বাংলাদেশ রাজনৈতিক সম্পর্কে। সংকীর্ণতা, একমুখী স্বার্থপরতা প্রধান হয়ে উঠেছে। তাই গঙ্গাচুক্তি হলেও তিস্তাচুক্তি আশ্বাসে ঝুলে আছে। সীমান্ত হত্যা যুক্তির নিয়ম মানছে না। ফেলানি হত্যার মামলা দীর্ঘকাল আদালতে ঝুলে আছে। অযোধ্যা সমস্যার সমাধানে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায় প্রশ্নবিদ্ধ। সর্বশেষ ঘটনা বহুখ্যাত বহুত্ববাদের বর্জন চেষ্টায়। সংকীর্ণ ধর্মীয় চেতনার প্রাধান্যের কারণে সিএএ এবং এনআরসি নিয়ে ভারতীয় শাসকদের অনড় ভ‚মিকা গণতন্ত্র ও সেকুলারিজমের সমার্থক নয়। অথচ ভারতেরই গণতন্ত্রী, যুক্তিবাদী, সেকুলার সমাজ শাসকশ্রেণির অগণতান্ত্রিক ভ‚মিকার কঠোর সমালোচক। পূর্বোক্ত সিএএ বিরোধী আন্দোলন শিক্ষার্থীদের সীমানা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়ে দেশের একাধিক রাজ্যে, ক্রমে তা প্রবল থেকে প্রবলতর। এ আন্দোলন বন্ধ করতে পূর্বজদের মতো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা (দাঙ্গা) হয়ে ওঠে সমাধানের অমানবিক, অগণতন্ত্রী পথ। দিল্লি জ্বলেছে, নিরীহ নরনারী শিশু মরেছে। প্রবল সমালোচনা শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে ভারতেরই অভ্যন্তরে সেখানকার বিশিষ্টজনদের। আমাদের কথা একটাই। অতীত যে বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলা হয়েছিল, তা নতুন করে রোপণে কোনো সমস্যারই সমাধান নেই। অতীতে রক্তাক্ত ভারতভাগ তা প্রমাণ করেছে। গোটা উপমহাদেশে সুস্থ সমাজ গড়ার পথ প্রকৃত গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। আর সেক্ষেত্রে সব প্রকার সংকীর্ণতা, সাম্প্রদায়িক দূষণ ও প্রভুত্ববাদ থেকে মুক্তিতেই গণতন্ত্রের মুক্তি, পরিণামে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App