×

মুক্তচিন্তা

জনমিতিক লভ্যাংশ ও আমাদের প্রস্তুতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২০, ০৭:০৪ পিএম

সময়ের স্রোতে পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, বসে নেই আমরাও। বৈশ্বিক গড় প্রবৃদ্ধিকে পেছনে ফেলে বিশ্বে যে কয়টি দেশ দ্রুত নিজেদের প্রবৃদ্ধি ক্রমান্বয়ে উন্নত করে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ আবদান রাখছে, এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আমরা আজকে উন্নয়নের মহাসড়কে ধাবমান এবং নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছি, বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে। গত এক দশকে বাংলাদেশের মোট দেশজ আয় বা জিডিপি গড়ে ৬.০৩ শতাংশ হারে বেড়েছে, যা ৭ শতাংশ হারে বাড়বে আগামী ১৫ বছর। সিইবিআরের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ সূচক (ডব্লিউইএলটি) অনুযায়ী, আকারের দিক থেকে ২০১৯ সালে বিশ্বে ১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪১তম। ২০২৩ সালে তা ছাড়াবে ৩৬তম। আর ২৪তম অবস্থানে পৌঁছাবে ২০৩৩ সাল নাগাদ। এ সময় বাংলাদেশের পেছনে থাকবে মালয়েশিয়া, সুইডেন, পাকিস্তান, সুইজারল্যান্ডের মতো দেশ। এই উন্নয়নের একমাত্র কারিগর আমাদের সস্তা জনশক্তি। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেকটা নির্ভর করে সে দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যার ওপর। সেখানে আমরা এখন সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছি। জনমিতিক লভ্যাংশ একটি দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের প্রভাব ফেলে। এজন্য অনেক চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেই একটি দেশকে জনসংখ্যার এই সুযোগ নিতে হয়। জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা আজ উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে। পক্ষান্তরে নাইজেরিয়া এই সুযোগটি ব্যবহার করতে পারেনি বলেই সম্পদশালী হওয়া সত্তে¡ও দারিদ্র্যে নিমজ্জিত। বাংলাদেশের মতো ছোট ঘন বসতিপূর্ণ দেশে সবার জন্য কর্মসংস্থান জোগান কষ্টসাধ্য ও দুরূহ বটে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ১৬ কোটি ৬৩ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ১১ কোটি ১৫ লাখ মানুষ কর্মক্ষম, যাদের বয়স ১৫ বছরের ওপরে। এদের মধ্যে শ্রম বাজারে রয়েছে ৬ কোটি ৩৯ লাখ মানুষ। আর কর্মে নিয়োজিত রয়েছে ৬ কোটি ১৯ লাখ। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) হিসাবে ২০১০ সালে বাংলাদেশে ২০ লাখ লোক বেকার ছিল। ২০১২ সালে ২৪ লাখ। ২০১৬ সালে তা ২৮ লাখে উঠেছে। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ৩০ লাখে ওঠার আশঙ্কা করেছিল সংস্থাটি। তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী, কাজ প্রত্যাশীদের মধ্যে সপ্তাহে ন্যূনতম এক ঘণ্টা মজুরির বিনিময়ে কাজের সুযোগ না পেলে বেকার হিসেবে ধরা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে এমন বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেন সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করার হিসাব দিয়ে বেকারত্বের সত্যিকার চিত্র পাওয়া যাবে না। এ সংজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। বাংলাদেশের বেকারত্বের হার আরো অনেক বেশি। প্রকৃত কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার। এর মধ্যে কর্মক্ষম কিন্তু শ্রমশক্তিতে যোগ হয়নি এমন মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৫৬ লাখ। অথচ আইএলওর সংজ্ঞা অনুযায়ী এদের বেকার বলা হচ্ছে না। একটু ঘুরিয়ে বলা হচ্ছে। এরা কর্মের সঙ্গে যুক্ত নয়, এরা শ্রমশক্তির বাইরে, প্রশ্ন হচ্ছে এই বিশাল জনগোষ্ঠী শ্রমশক্তির বাইরে বসিয়ে রেখে কীভাবে দেশ উন্নয়ন সম্ভব? বেকারের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বরাবরই একটি ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়। একেক সংস্থার হিসাব একেক রকম হয়ে থাকে। কাঁটায় কাঁটায় হিসাব করাও সম্ভব নয়। পরিসংখ্যানে এটা স্পষ্ট ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) হিসাবে দেখা যায়, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকার হচ্ছে ৩৮.৬ শতাংশ। বিশেষ করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রথম শ্রেণি প্রাপ্তদের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশই বেকার। স্নাতক পর্যায়ে এমন মেধাবীদের বেকারত্বের হার প্রায় ২৮ শতাংশ। উচ্চ শিক্ষিত মেধাবীদের বেকারত্বের চিত্র সত্যিই হতাশাজনক। অথচ এত বেকারের দেশে ৫ লাখ বিদেশি কর্মী কাজ করছে। উচ্চ বেতনে তারা দেশের গার্মেন্টস, ওষুধ খাতসহ বিভিন্ন খাতে চাকরি করে বছরে নিয়ে যাচ্ছে ৫০০-৬০০ কোটি ইউএস ডলার। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) তথ্য মতে বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতে কাজ করছে ২০ হাজারের অধিক বিদেশি কর্মী। তারা বেতন নিচ্ছে গার্মেন্টস খাতে দেশীয় মোট শ্রমিকের প্রায় অর্ধেকের মজুরির সমপরিমাণ। কিছু সুনির্দিষ্ট পদে দক্ষতার দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে দেশের শ্রমিকরা। দেশি শ্রমিকদের দক্ষ করে গড়ে তুলে এই বিশাল অঙ্কের টাকা দেশে রাখা সম্ভব। এভাবে এ দেশে কাজ করছেন ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির লোকরা, বলা হয় এরা দক্ষ কর্মী। আমাদের দেশে তাদের মানের কর্মী পাওয়া যায় না। সর্বাধিক সংখ্যক বিদেশি কর্মী কাজ করছেন বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে। নিয়োগদাতাদের মতে বাংলাদেশে ফ্যাশন ও ডিজাইনিং, ভারী যন্ত্রপাতি পরিচালনা, বিপণন, সরবরাহ চেইন ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি খাতে দক্ষ কর্মীর যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ ঘাটতি পূরণ করতে বিদেশি কর্মী নিয়োগ দিয়ে উন্নয়ন, উৎপাদন ও রপ্তানি কার্যক্রম চালু রাখতে হচ্ছে। আমাদের এই মানবগোষ্ঠীকে যথাযথ সময়োপযোগী শিক্ষা, দক্ষতা, প্রযুক্তির জ্ঞান দিয়ে মানবসম্পদে পরিণত করে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে জনমিতিক লভ্যাংশকে কাজে লাগাতে হবে। জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনডিপি) পরিসংখ্যানে মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে বিশ্বে ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে, যা ১৩৫তম। এখানেও হতাশার চিত্রই দেখা যাচ্ছে, অন্যদিকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মানুষের জীবনধারা ও পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি ব্যাপকভাবে বদলে দিচ্ছে। জৈবিক, পার্থিব ও ডিজিটাল জগতের মধ্যকার পার্থক্যের দেয়ালে চির ধরিয়েছে। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবটিক্স, ইন্টারনেট অব থিংস, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, থ্রিডি প্রিন্টিং, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, বায়োটেকনোলজি, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স ও অন্যান্য প্রযুক্তি মিলেই এ বিপ্লব। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্যানুযায়ী, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রয়োজনীয় দক্ষতা ঘাটতির কারণে বিশ্বে প্রায় ৮০ কোটি মানুষ চাকরি হারাতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দেশে-বিদেশে চাকরিরত প্রায় ৫৭ লাখ অদক্ষ শ্রমিক এ প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থতার কারণে বেকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিবেদন বলছে পুরনো অনেক চাকরি হারিয়ে গেলেও নতুন অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এজন্য নতুন করে ২ কোটি ও পুরনো ৭ কোটি ৩০ লাখ কর্মীকে প্র্রশিক্ষিত করতে হবে আগামী ২০ বছরের মধ্যে। সুতরাং প্রযুক্তিনির্ভর ও প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষা আমাদের জন্য অবধারিত। এর সঙ্গে বাড়াতে হবে যথেষ্ট কর্মসংস্থান, যাতে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা না বাড়ে। এজন্য ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দক্ষতা ও উন্নয়নে জোর দিতে হবে। কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হলো আমাদের যে হারে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে সে হারে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। কারণ বেসরকারি খাতে যথেষ্ট বিনিয়োগ না হওয়া। এটা ২০-২২ শতাংশের মধ্যেই রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও সহজ ব্যবসার সূচকে অনেক পিছিয়ে আছে। বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করার সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮তম। তাই দুর্নীতি নির্মূল ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা দূর করে, আর্থিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্থিতিশীল ও টেকসই ব্যবসায়িক বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করে, কর্মসংস্থান বাড়িয়ে জনমিতিক লভ্যাংশকে কাজে লাগাতে হবে। তাহলেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের যে স্বপ্ন ছিল, তারই ধারাবাহিকতায় তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেয়া রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়ন করে আমরা বিশ্বের বুকে দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত হবো। মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম : পুঁজিবাজার বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App