দিন দিন প্রকট হচ্ছে আর্থিক খাতের ভারসাম্যহীনতা। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে যাচ্ছে দেশের ব্যাংকিং খাত। নানাভাবে চেষ্টার পরও রাষ্ট্রায়ত্ত ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী ব্যাংকিং বন্ধ করতে পারছে না সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন রকম সুযোগ দেয়ার পরও নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে ঋণ বিতরণ করছে ১২টি ব্যাংক। এর মধ্যে সরকারি খাতের অগ্রণী ব্যাংকে এডি রেশিও সর্বোচ্চ। বেসরকারি খাতের মধ্যে নাম পরিবর্তন করা পদ্মা ব্যাংক রয়েছে সর্বোচ্চ অবস্থানে।
গত বছর একাধিকবার ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) সমন্বয়ের সময় বাড়ানো হয়। কিন্তু তারপরও সমন্বয়ে ব্যর্থ হয়েছে ব্যাংকগুলো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন ঋণ বিতরণ ও আমানতের অসামঞ্জস্যতার কারণে ব্যাংকগুলো এডিআর সমন্বয় করতে পারছে না।
তারল্য সংকট, মাত্রাতিরিক্তি খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি, নাজুক ঋণ আদায় পরিস্থিতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, টাকা পাচারের মতো নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আর্থিক খাত এখনো মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না।
এদিকে ব্যাংকের তারল্য সংকট, ঋণের উচ্চ সুদের কারণে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কাক্সিক্ষত বাড়ছে না বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত নগদ অর্থ নেই। ঋণ-আমানত অনুপাতের (এডিআর) সমন্বয়ের চাপ রয়েছে। এছাড়া আর্থিক খাতের নানা কেলেঙ্কারি ও সঞ্চয়পত্রে সুদ বেশি হওয়ায় ব্যাংকে আমানত প্রবৃদ্ধি কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ শেষে সীমা অতিক্রম করা ব্যাংকগুলো হলো- অগ্রণী ব্যাংক (ইসলামী), বেসিক ব্যাংক, এবি ব্যাংক (ইসলামী), এক্সিম ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক (ইসলামী), ইউনিয়ন ব্যাংক, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে অগ্রণী ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিং উইং ১১৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা আমানত সংগ্রহ করেছে। এর বিপরীতে ঋণ বিতরণ করেছে ১৯২ কোটি ৯২ লাখ টাকা। হিসাব অনুযায়ী, তাদের এডি রেশিও দাঁড়িয়েছে ১৬২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এদিকে বেসিক ব্যাংকের এডিআর পৌঁছেছে ১০৮ শতাংশে। ব্যাংকটি ১৪ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করলেও বিনিয়োগ করেছে ১৫ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকের মধ্যে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের এডিআর ৯৭ শতাংশ।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংকের ইসলামী উইংয়ের এডিআর এখন ৯৬ শতাংশ, যা বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত সীমার চেয়ে ৬ শতাংশ বেশি। এদিকে ৯০ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ এক্সিম ব্যাংকের ঋণ-আমানত অনুপাত। ন্যাশনাল ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ, এনআরবি ব্যাংক ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এডিআর একই। ব্যাংক ২টির ঋণ-আমানত অনুপাত ৮৮ শতাংশ।
দুর্নীতির জন্য বহুল আলোচিত পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স) ঋণ-আমানতের অনুপাত ১১২ শতাংশ। যদিও ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ব্যাংকটির সব রকমের ঋণ বিতরণ বন্ধ। শুধু আমানত সংগ্রহের অনুমতি থাকলেও এডিআর সমন্বয়ে তা এখনো পর্যাপ্ত নয়।
সমাপ্ত বছরে প্রিমিয়ার ব্যাংকের ইসলামী উইংয়ের এডি রেশিও ১০৫ শতাংশ। ইউনিয়ন ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ৮৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।
১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে ব্যাংকগুলো কী পরিমাণ ঋণ বিতরণ করতে পারবে তা ঠিক করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৭ সালের শেষ দিকে হঠাৎ করে ঋণ প্রবৃদ্ধি ব্যাপক বাড়তে থাকায় ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) কমিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি এক নির্দেশনার মাধ্যমে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর এডিআর ৮৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮৩ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়। ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য ৯০ শতাংশ থেকে নামিয়ে আনা হয়েছিল ৮৯ শতাংশ। তবে গত বছরের (২০১৯) ১৭ সেপ্টেম্বর আগের (প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর ৮৫ ও ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য ৯০ শতাংশ) হারে ঋণ বিতরণে অনুমতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংকাররা জানান, বেশি সুদ দিয়েও আশানুরূপভাবে আমানত পাচ্ছে না অধিকাংশ ব্যাংক। এ কারণে এডিআর বেড়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাংকের এডিআর আগে থেকেই নির্ধারিত সীমার উপরে থাকলেও আমানতের তুলনায় ঋণ বাড়ানো অব্যাহত আছে। যদিও বেসরকারি খাতের তুলনায় সরকারি খাতের ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি। তারপরও বিনিয়োগের চাহিদা অনুযায়ী আমানত পাওয়া যাচ্ছে না।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।