×

মুক্তচিন্তা

বৈশ্বিক অর্থনীতিতে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২০, ১০:৫৯ পিএম

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের মধ্যাঞ্চলীয় হুবেই থেকে ছড়াতে শুরু করে নিউমোনিয়াসদৃশ করোনা ভাইরাস। প্রথমদিকে দেশটি স্বীকার না করলেও মৃত্যুর হার বাড়তে বাড়তে ২০০৩ সালে সার্সের ভয়াবহতাও ছাড়িয়ে গেছে। সার্সের কারণে মৃত্যু হয়েছিল ৭৭ জনের। আর করোনায় এরই মধ্যে সবশেষ তথ্যানুযায়ী ৮ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই চীনের। ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের প্রায় ৬০টিরও বেশি দেশে। চীন ও চীনের বাইরে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে মানুষের মৃত্যু এবং আক্রান্ত হওয়ার হারই যে শুধু বাড়ছে তাই নয়, এর অর্থনৈতিক ক্ষতির মাত্রাও বাড়ছে, প্রধানত চীনের ভেতরে, এমনকি বাইরেও। এই ক্ষতি শুধু ভাইরাস সংক্রমণের কারণে নয়, বরং এর বিস্তার ঠেকানোর জন্য চীনকে বড় ধরনের আর্থিক মাশুল দিতে হচ্ছে। উহান শহর, যেখান থেকে এই সংক্রমণের সূচনা, সেখান থেকে বাইরে যাওয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। উহানের জনসংখ্যা ১ কোটি ১০ লাখ। অবরুদ্ধ শহর এখন শুধু উহান নয়, একই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে হুবেই প্রদেশের অন্যান্য এলাকাতেও এর ফলে ব্যবসা সংক্রান্ত সব রকম ভ্রমণ বন্ধ রয়েছে। পণ্য ও কর্মীদের যাতায়াতও বন্ধ হয়ে গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইতালি। এখানে হাজারের বেশি ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। ইতালির প্রধান শিল্পাঞ্চল লোমবারডি শহর কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। দেশটির শিল্প থেকে মোট আয়ের ৪০ ভাগ আসতো লোমবারডি থেকে। ইতালির ভেনিসে কার্নিভাল উৎসব ও মিলানে ফ্যাশন সপ্তাহ বাতিল করা হয়েছে। করোনায় প্রায় ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ইউরো ক্ষতি হতে পারে। উপরন্তু করোনা মোকাবিলায় ইতালি আরো ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে। আগামী ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত মিলানের সঙ্গে বিমান সার্ভিস বাতিল করেছে আমেরিকান বিমান সংস্থা। ইতালি থেকে যুক্তরাজ্য, স্পেন, গ্রিস, ক্রোয়েশিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, রোমানিয়া, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, সুইডেন, নরওয়ে, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, উত্তর মেসেডোনিয়া, সান মারিনোয়ও করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড জানায়, করোনা ভাইরাসের কারণে চীনা অর্থনীতির ৪২ ভাগ আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্বের বড় বড় গাড়ি উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর অধিকাংশ কাঁচামাল উৎপাদন করে চীন। এসব কোম্পানির মধ্যে ভক্সওয়াগেন, টয়োটা, জেনারেল মোটরস, হোন্ডা, হুন্ডার মতো বড় বড় জায়ান্ট কোম্পানিও রয়েছে। কিন্তু করোনার কারণে চলতি বছরের প্রথমার্ধে গাড়ি উৎপাদন ১৫ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে প্রত্যেক দেশের মধ্যে গভীর বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান। ২০০৩ সালেও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চীনের প্রভাব ছিল মাত্র ৪ ভাগ। কিন্তু বর্তমানে তা ১৮ শতাংশ। ২০১৩ সালে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বযুদ্ধের সমতুল্য হচ্ছে মহামারি। কারণ মহামারির কারণে বিশ্বে মোট জিডিপির ৫ ভাগের কাছাকাছি বা ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার লোকসান হয়। ২০০৯ সালে সামান্য ঐ১ঘ১ ভাইরাসের কারণেই বিশ্বে মোট জিডিপির শূন্য দশমিক পাঁচ ভাগ ক্ষতি হয়। বর্তমানে ওষুধশিল্প, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির কাঁচামাল, স্মার্টফোন, গাড়ির যন্ত্রাংশের অর্ধেকের বেশি উৎপাদন করে চীন। ফলে এত দ্রæত বিকল্প বাজার তৈরি করা কঠিন। গত ১৫ থেকে ২০ বছর আগে চীনকে ‘বিশ্ব কারখানা’ নামে ডাকা হতো। করোনার কারণে গত ৩০ বছরের মধ্যে চীনা অর্থনীতি সবচেয়ে শ্লথ গতিতে এগোচ্ছে। গত বছরের প্রথমার্ধে চীনের অর্থনৈতিক উন্নতি ছিল মাত্র ৬ ভাগ। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৫ ভাগ। ১৯৩০ সালে ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মন্দা হয়েছিল। অর্থনীতিবিদরা ২০০৭-০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সঙ্গে তার তুলনা করেন। করোনার কারণেও সমরূপ অর্থনৈতিক মন্দা ঘটতে পারে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন তারা। বিশ্বের অন্যতম বিলাসবহুল পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানি ব্রিটিশ ব্যান্ড বারবেরি (বিবিআরইউএফ) চীনে নিজেদের ২৬টি দোকান বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, করোনার কারণে বিলাসবহুল পণ্যের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। স্মার্টফোনের চিপস উৎপাদনকারী বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোম্পানি কোয়ালকম (কিউসিওএম) জানায়, করোনার কারণে চিপসের সংকট তৈরি হবে। ফলে বাজারে স্মার্টফোনের সংকট তৈরি হতে পারে। ইতোমধ্যে মার্কিন মোবাইল কোম্পানি অ্যাপল জানায়, নির্দিষ্ট সময়ে নতুন মোবাইল বাজারে ছাড়তে বেগ পেতে হবে। এশিয়ার জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, আফগানিস্তান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ইরাক, ইসরায়েল, কুয়েত, মালয়েশিয়া, নেপাল, ওমান, পাকিস্তান, কাতার, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভিয়েতনামে করোনা শনাক্ত হয়েছে। তবে এশিয়ায় চীনের পরে করোনায় সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গাড়ি উৎপাদনকারী কোম্পানি হুন্ডায় দক্ষিণ কোরিয়ায় সাময়িকভাবে নিজেদের কার্যক্রম স্থগিত করেছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় আমদানি-রপ্তানি ব্যাংক বন্ধ ঘোষণা করেছে। ব্যাংকের ৮০০ কর্মকর্তাকে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, স্প্যানিশ দ্বীপের হোটেলগুলো বন্ধ রয়েছে। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর থাইল্যান্ডে পর্যটকের সংখ্যা ৫০ ভাগ কমে গেছে। সম্প্রতি থাইল্যান্ডে ভাড়া কমানোর দাবিতে ফ্ল্যাশ মবও হয়েছে। দোকানদারদের দাবি, পর্যটক না আসায় প্রত্যাশানুযায়ী বিক্রি হয়নি। ফ্রান্সেও অনুরূপ পরিস্থিতি। করোনার কারণে দেশটিতে ৩০ থেকে ৪০ ভাগ পর্যটক কমে গেছে। এছাড়া একসঙ্গে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষের সমাবেশ নিষেধাজ্ঞার কারণে প্যারিসের লোভর জাদুঘর বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জার্মানিও অর্থনীতিতে বড় ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। কারণ চীন দেশটির সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ। গত শনিবার জার্মানির ব্যাংক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ফ্রাঙ্কফুটে করোনায় আক্রান্ত একজন শনাক্ত হয়েছে। অন্যদিকে করোনা মোকাবিলায় পুরো যুক্তরাজ্য কোয়ারেন্টাইনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফলে যুক্তরাজ্যের মোটা অঙ্কের লোকসান গুনতে হবে। এছাড়া করোনার প্রভাব শেয়ারবাজারেও পড়েছে। গত সপ্তাহে শেয়ারবাজারে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছে, যা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সব কোম্পানির মোট শেয়ারের ১১ ভাগ। ইতোমধ্যে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরেও শেয়ারবাজারে দরপতনের ঘটনা ঘটেছে। প্রাথমিকভাবে চীন সুদের হার কমিয়েছে। গত সপ্তাহে পিপলস ব্যাংক অব চায়না সুদের হার কমানোসহ ব্যাংক ও ঋণগ্রহীতার ওপর থেকে চাপ কমাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছে। কিছুদিনের মধ্যেই কর ও ভর্তুকি সংক্রান্ত নতুন পরিকল্পনা ঘোষণা করবে চীন। ইতোমধ্যে চীনের পথে হাঁটতে শুরু করেছে শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, ব্রাজিল, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত, মেক্সিকো। করোনার কারণে আর্থিক ক্ষতি দ্রæত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে আশা অর্থনীতিবিদদের। তাদের মতে, যদি দ্রæত করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়, তাহলে এই আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। অন্যথায় অর্থনীতির ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ আর্থিক মন্দার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। এই করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মুখে বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম পরাশক্তি চীন যতটা না ঝুঁকিতে রয়েছে, তার চেয়েও বেশি ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। এখনো পর্যন্ত প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া এই মরণব্যাধি গোটা বিশ্বের অর্থনীতি বদলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, করোনার ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেতে থাকলে বড় বড় কোম্পানিগুলো শ্রমিক ছাঁটাই করবে। ইতোমধ্যে চীনে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। ইউরোপেও একইভাবে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটতে পারে। রায়হান আহমেদ তপাদার : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App