×

মুক্তচিন্তা

বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ কেন?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২০, ১১:০২ পিএম

মফস্বলের ছোট্ট শহর পিরোজপুর। তাও আবার দেশের সর্ব দক্ষিণে। উত্তর-পূর্ব-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের তেমন প্রয়োজন সচরাচর পড়ে না। সেখানকার সাংবাদিকদের কল্যাণে মাঝেমধ্যে দুয়েকটি খবর ঢাকার পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত হলে বা টিভি চ্যানেলগুলো দেখালে তখনই কেবল কিছু কিছু ঘটনা দেশবাসীর জানার সুযোগ ঘটে। তেমনই একটি খবর গত ৪ মার্চ টিভির নানা চ্যানেল মারফত এবং পরদিন সংবাদগুলো মারফত জানতে পেরে দেশবাসী নিশ্চয়ই শঙ্কিত বোধ করছেন। ঘটনাটি ঘটেছিল পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে। ঘটনাটি সংক্ষেপে নিম্নরূপ : পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম আউয়াল, আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য ও তার স্ত্রী জেলা আওয়ামী মহিলা লীগের সভানেত্রী লায়লা পারভীন আদালতে হাজির হয়ে জামিন প্রার্থনা করলে আদালত দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ওই দুই নেতানেত্রীর দরখাস্ত নামঞ্জুর করেন এবং উভয়কে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। ৪ মার্চ দুপুর ১২টার দিকে পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ আবদুল মান্নান ওই আদেশ প্রদান করেন। ৩ ঘণ্টা যেতে না যেতেই বেলা ৩টায় জেলা ও দায়রা জজকে (তিনি ওই জেলার সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক) ওএসডি করে তাৎক্ষণিক বদলির আদেশ প্রদান করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ নাহিদ নাসরিনকে পদোন্নতি দিয়ে জেলা ও দায়রা বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বিচারাঙ্গনে অভিনীত এই বিস্ময়কর নাটকের যবনিকাপাত ঘটল যখন দুই অভিযুক্ত নেতানেত্রী অতঃপর দ্রুততার সঙ্গে পুনরায় জামিন আবেদন দায়ের করেন। এবারে ততধিক দ্রুততার সঙ্গে নতুন জেলা ও দায়রা জজ নাহিদ নাসরিন দুর্নীতির দায়ে দুদক কর্তৃক আনীত মামলায় ওই দুজন অভিযুক্ত নেতানেত্রীকে জামিন প্রদান করেন। মাত্র ৪ ঘণ্টার মধ্যে নাটকটি অভিনীত হলো এবং তার যবনিকাপাতও ঘটল। সব মহল এ ঘটনাকে নজিরবিহীন বলে অভিহিত করেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর এমন নগ্ন হস্তক্ষেপ করেছে আইন মন্ত্রণালয়, হাইকোর্ট নন। যদিও আইনত ও ন্যায়ত বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি প্রভৃতির দায়িত্ব হাইকোর্টের-নির্বাহী বিভাগের নয়। আরো কৌতুকের ব্যাপার হলো নাটকীয়ভাবে জামিন আবেদন মঞ্জুর হওয়ার অব্যবহিত পরেই স্থানীয় সরকারি দলের নেতারা পাল্টাপাল্টি অবস্থান নেন। অভিযুক্ত আউয়াল সংবাদ সম্মেলন করে তার জামিনের প্রার্থনা প্রথমে নামঞ্জুর হওয়ার জন্য স্থানীয় সাংসদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে আদালতকে প্রভাবিত করার অভিযোগ উত্থাপন করেন। যতদূর জানা যায়, দ্বিতীয় দফায় দায়েরকৃত তাদের জামিনের প্রার্থনা নবনিযুক্ত জেলা ও দায়রা জজ কার প্রভাবে মঞ্জুর করলেন সে সম্পর্কে আউয়াল সাহেব কিছু বলেননি। এমনকি হঠাৎ করে কার নির্দেশে পটুয়াখালী জেলা ও দায়রা জজ আবদুল মান্নানকে ওএসডি করে বদলির আদেশ এবং যুগ্ম জেলা জজ নাহিদ নাসরিনকে মুহূর্তে পদোন্নতি দিয়ে একই আদালতের জেলা ও দায়রা জজ পদে নিয়োগ দেয়া হলো তা নিয়েও তিনি কিছু বলেননি। না বললেও এই প্রশ্নগুলোই মানুষের মনকে আলোড়িত করছে বেশি। বিষয়টি এখন আর ‘টক অব পিরোজপুর’ নয় বরং সব অর্থেই তা ‘টক অব দ্য কান্ট্রিতে’ পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, মানুষের শেষ ভরসাস্থল যে বিচার বিভাগ, তার ওপর এমন নগ্ন হস্তক্ষেপ মানুষকে আতঙ্কিত করেও তুলেছে। গত ৪ মার্চ সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘রূঢ় ব্যবহারের’ কারণে এমন একটি অবস্থা দাঁড়ায় যে আইনজীবী সমিতির সবাই আদালত বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। এমনকি রাস্তায়ও গোলযোগ শুরু হয়ে যায়। রাস্তায় ‘লোকজন’ বেরিয়ে গিয়েছিল। সেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য তাকে সেখান থেকে ‘স্ট্যান্ড রিলিজ’ করা হয় এবং পরে তার স্ত্রীসহ আউয়ালকে জামিন দেয়া হয়। আইনমন্ত্রী আরো বলেন, জামিন দেয়া না দেয়ার সম্পূর্ণ এখতিয়ার আদালতের। কিন্তু আদালত যদি এমন কোনো ব্যবহার করেন, এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং আইনের শাসন রক্ষা করা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তখন কিন্তু একটা ব্যবস্থা নিতে হয়। সেই অবস্থার আলোকেই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এই ঘটনা থেকে কি ‘জামিন দেয়া না দেয়ার সম্পূর্ণ এখতিয়ার আদালতের’ আইনমন্ত্রীর এই উক্তির সত্যতা প্রমাণিত হয়? সাদা চোখে দেখা গেল, জেলা ও দায়েরা জজ জামিনের আবেদন নাকচ করে দেয়ার পরপরই তাকে ‘ওএসডি’ বা ‘স্ট্যান্ড রিলিজ’ করা হলো এবং পরক্ষণেই তাকে পটুয়াখালী থেকে বদলি করে দেয়া হলো। যেন তিনিই অপরাধী। জেলা ও দায়রা জজ আবদুল মান্নানের তা হলে অপরাধ কী? দৃশ্যতই তা হচ্ছে তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতির ও তার স্ত্রীর জামিন আবেদন নাকচ করার স্পর্ধা দেখিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগটাও আদৌ কোনো গুরুতর ঘটনা নয়, কারণ দুর্নীতিটি যারা করেছেন বলে অভিযোগ এসেছে তারা উভয়ই আওয়ামী লীগ তথা শাসক দলের জেলা পর্যায়ের সর্বোচ্চ নেতা ও নেত্রী। সুতরাং এ অপরাধে ওই জেলা ও দায়রা জজকে যে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়নি এই তো মেলা। আর কী চাই? বিস্তর খাতির করা হয়েছে, সরকারি ইঙ্গিত তেমনটাই। এখন যদি প্রশ্ন করা যায়, ওই একই অপরাধে যদি বিরোধীদলীয় কোনো নেতা-নেত্রী জামিন আবেদন করতেন এবং একইভাবে তা যদি বিচারক নাকচ করে দিতেন এবং সেই বিরোধী দলের চ্যালাচামুণ্ডারা রাস্তাঘাটে অবরোধ রচনা করে জনদুর্ভোগের সৃষ্টি করত তখনো কি সরকার ওই বিচারককে ওএসডি, স্ট্যান্ড রিলিজ, বদলি ইত্যাদি করতেন? অথবা বিচারক যদি ওই বিরোধীদলীয় নেতা-নেত্রীর জামিন আবেদন শুনানিকালে তাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু কট‚ক্তি করতেন তখনো কি আবদুল মান্নানের বিরুদ্ধে এমন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হতো? পিরোজপুরের আওয়ামী লীগ সভাপতি এম এ আউয়াল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির মামলার জামিন আবেদন নাকচ করার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সেখানকার আওয়ামী লীগের একটি গ্রুপ, তাদের লালিত সূর্য সৈনিক ছাত্রলীগ, যুবলীগ, মহিলা লীগের বেপরোয়া ক্যাডারার রাস্তা অবরোধ করে যে তাণ্ডবের সৃষ্টি করেছিল তার জন্য অপরাধী বলে বিবেচিত হবেন কি আদালতের বিচারে? না কি যে পুলিশ ওই তাণ্ডব দেখেও না দেখার ভান করে নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে ওই ক্যাডারদের তাদের বেআইনি কাজে সহযোগিতা করল তাদের কি সরকার মহাআদরে লালন করবেন? পদোন্নতি দিয়ে পুরস্কৃত করবেন? আবার জানতে ইচ্ছে করে ওই জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী সূর্যসন্তানরা যদি বিরোধীদলীয় ছাত্র-যুব-মহিলা অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী হতো তখনো কি পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখত বা চুপচাপ থেকে তাদের তাণ্ডব সৃষ্টির কাজে সহায়তা করত? সরকারের কার্যকলাপ দেখে বা তাদের আচরণে তেমনটা ধারণা করার কোনোই অবকাশ নেই। সে ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই পুলিশ ওই তথাকথিত বিক্ষোভকারীদের অন্ততপক্ষে লাঠিপেটা করে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে বাধ্য করত। একটি পত্রিকায় গত ৪ মার্চ প্রকাশিত খবরে জানা যায়, দুপুরে পিরোজপুর সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল আউয়াল ও তার স্ত্রী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লায়লা পারভীনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশকে কেন্দ্র করে তাদের অনুসারীরা তাণ্ডব সৃষ্টি করে। তারা পিরোজপুর শহর থেকে সার্কিট হাউস পর্যন্ত রাস্তার কয়েকটি স্থানে গাছের গুঁড়ি ফেলে ও আগুন জ্বালিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পাড়ের হাট সড়ক অবরোধ করে। জোর করে দোকানপাট বন্ধ করতে বাধ্য করে ব্যবসায়ীদের। এমনকি বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি সংবলিত বিলবোর্ডগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। পত্রিকাটি আরো জানায় দুপুরে আউয়াল দম্পতিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশদানের পর তাদের আইনজীবীরা আদালতে তাদের মক্কেলদের অসুস্থতার কারণে চিকিৎসা প্রতিবেদন দাখিল করেন এবং তাদের হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা প্রদান ও ডিভিশন দেয়ার আবেদন করেন। দুপুর পৌনে ৩টার দিকে বিচারক ডিভিশনসহ আসামিদের হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ প্রদান করেন। এর কিছুক্ষণ পর জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ আবদুল মান্নান ছুটিতে চলে যান ও তার পূর্ব মুহূর্তে যুগ্ম জেলা জজ নাহিদ নাসরিনের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। অতঃপর ওই আইনজীবীরাই নতুন করে ওই দুই অভিযুক্ত নেতা-নেত্রীর জামিনের আবেদন দাখিল করেন। মাত্র ১৫ মিনিটের শুনানি শেষে নতুন বিচারক বিকাল ৪টার দিকে দুই আসামির জামিনের আবেদন মঞ্জুর করেন। প্রসঙ্গত, দুদক ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা, জালিয়াতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে গত ৩০ ডিসেম্বর পৃথকভাবে তিনটি মামলা দায়ের করে ওই দুই নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে। আবদুল আউয়াল তিনটি মামলারই এবং তার স্ত্রী লায়লা পারভীন একটি মামলার আসামি। তারা উভয়েই ৭ জানুয়ারি হাইকোর্ট থেকে আট সপ্তাহের জামিন নেন। ওই জামিনের মেয়াদ শেষ হলে তারা পিরোজপুর আদালতে হাজির হয়ে জামিন প্রার্থনা করেন। দুদক কর্তৃক আনীত অভিযোগগুলো হলো তারা অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে নাজিরপুর উপজেলার বুইছাকাঠি মৌজায় .০৩ একর খাসজমি বন্দোবস্ত নিয়ে পাকা দ্বিতল ভবন নির্মাণ করেন। অন্য দুই মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, পিরোজপুর পৌরসভার খুমুরিয়া মৌজায় রাজার পুকুর নামে পরিচিত অর্পিত সম্পত্তির ৪৪ শতাংশ জমি দখল করে চার পাশে দেয়াল নির্মাণ করেন। এছাড়া নেছারাবাদ উপজেলার স্বরূপকাঠি মৌজায় .৫ একর অর্পিত সম্পত্তি বন্দোবস্ত নিয়ে শর্ত ভঙ্গ করে ‘আউয়াল ফাউন্ডেশনের’ নামে দ্বিতল পাকা ভবন নির্মাণ করেন। আবদুল আউয়াল এক সময় দল থেকে বহিষ্কৃতও হয়েছিলেন। ফিরিস্তি না বাড়িয়ে যা বলা যায়, এহেন নেতা-নেত্রীকে জেলে পাঠানোর দুঃসাহস যে বিচারক দেখালেন, সরকার তাকে কেনই বা চাকরিতে বহাল রাখবে বা তাকে শাস্তি না দিয়ে থাকবে? এই নজিরবিহীন ঘটনার দ্বারা আইনমন্ত্রী যে বার্তাগুলো দিলেন তা হলো এক. কোনো বিচারক যদি সরকারদলীয় নেতা-নেত্রীকে দুর্নীতির অভিযোগ অভিযুক্ত হলেও কারাগারে পাঠান বা জামিন না দেন তাহলে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে; দুই. সরকারদলীয় ক্যাডাররা রাস্তা অবরোধ ও দোকানপাট বন্ধ করতে ব্যবসায়ীদের বাধ্য করলে বা গাছের গুঁড়ি রাস্তার মধ্যে ফেলে আগুন ধরিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করলে বা ভাঙচুর করলেও পুলিশ তাদের কিছু না বলে দাঁড়িয়ে দেখতে বাধ্য থাকবে তবে পুলিশ নয়, শাস্তি পাবেন জামিন না দেয়া বিচারক। তিন. আদালতে অপরাধীদের বিপক্ষে কোনো বিরূপ মন্তব্য বিচারক করতে পারবেন না যদি অপরাধীরা সরকারদলীয় কেউ হন। চার. কোনো বিচারক জামিন না দিয়ে জেলে পাঠানোর আদেশ দিলে তাকে তৎক্ষণাৎ ওএসডি ও বদলির মুখোমুখি করা হবে এবং নতুন একজনকে পদোন্নতি দিয়ে ওই চেয়ারে বসিয়ে মুহূর্তেই তাদের জামিন দেয়ানো হবে। এভাবে বিচারকদের অপরাধীদের কাছে নতি স্বীকার করতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে। এই বার্তাগুলো দেশের গণতন্ত্রের, আইনের শাসনের ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App