×

মুক্তচিন্তা

ফিরিয়ে দাও সে অরণ্য লও এ নগর!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২০, ০৮:১৭ পিএম

বড় বিচিত্র আমাদের দেশ। সেই কবে সেলুকাসের কথা পড়েছিলাম আমরা। আজো তা সত্যি বড় বিচিত্র সমাজ হে সেলুকাস। এই সেদিনও আমাদের দেশের পরিচয় ছিল তলাবিহীন ঝুড়ি। যদিও সে অপবাদ যতটা বাস্তব তারচেয়ে অধিক ছিল বিদ্বেষপ্রসূত। কিন্তু এটা মানতে হবে আমরা ছিলাম দরিদ্র রাষ্ট্র। আমাদের চলতে হতো সাহায্য অনুদানের ওপর। বিশ্বব্যাংকের চোখ রাঙানি আমেরিকার প্রভুত্ব ভারতের সেবাদাস হওয়ার বিকল্প ছিল না। আজ সে বাস্তবতা পাল্টে গেছে। এখন পূর্বাভাস হচ্ছে অচিরেই বাংলাদেশ সাউথ ইস্ট এশিয়ার টপ ইকনোমিক শক্তির একটি হতে পারে। আর এই সত্য আমাদের কাছে বাস্তব করে তুলেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। যার সাহস আর নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের সাহায্য ব্যতিরেকেই নিজেদের উন্নয়ন ও অবকাঠামোর কাজ করতে পারে। আওয়ামী লীগের শাসনমালের দুর্বলতা ছিল তাদের টিকতে না দেয়া বা টিকতে না পারা। সেসব অতীত এখন ইতিহাস। উত্তরপাড়া বা আমলা কিংবা ধর্মান্ধ রাজনীতি কোনোটাই এখন আর পথের বাধা হতে পারছে না। বরং সেসব শক্তি হয় দুর্বল নয়তো বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু আমাদের সামাজিক বাস্তবতা যাবতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর অর্জনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের কুৎসিত চেহারা নিয়ে বেরিয়ে আসছে বারবার। যার পেছনে কাজ করছে সরকারি দলের নাম ও পরিচয়। সন্দেহ নেই শীর্ষ নেতৃত্ব অনেক কিছু জানেন না। জানাটা সম্ভবও না। আওয়ামী লীগ উপমহাদেশের বটগাছতুল্য বড় দল। তাদের শাখা-প্রশাখা এত বেশি মনিটরিং করাও মুশকিল। তারপরও বিগত কিছুদিন ধরে যেসব ঘটনা একের পর এক সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে তাতে আওয়ামী লীগের ইমেজ সংকট ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে পড়তে বাধ্য। কি হচ্ছে এসব? ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি তারপর ভিসি কেলেঙ্কারি অতঃপর যুবলীগ নিয়ে ঝামেলা এবার যোগ হলো পাপিয়া। আমরা এক একবার একেকজনের এমন চেহারা দেখি আর আঁতকে উঠি। কিন্তু ভুলে যাই এক পাপিয়া ধরা পড়লেও হাজার পাপী পাপিয়া বড় হচ্ছে সমাজ গর্ভে। তাদের আশ্রয়দাতারা সরল বা সহজ কেউ না। এদের আমরা বলি গডফাদার। এইসব গডফাদার-মাদারদের আশ্রয়ে গড়ে ওঠা অপরাধীচক্রের মদদদাতা রাজনীতি। তারা রাজনৈতিক আশ্রয়ে থেকেই নিজেদের নিরাপদ মনে করে। আর সেভাবেই গড়ে ওঠে অপরাধ সাম্রাজ্য। এবারের ঘটনাটা দেখুন। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে সাপ বেরিয়ে আসার মতো একে একে বেরিয়ে আসে তাদের অবৈধ সম্পদের তথ্য। অল্প সময়ে এত বিপুল পরিমাণ বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন এ দুই সহোদর, যা রীতিমতো বিস্ময়কর। সর্বশেষ গত সপ্তাহে এনু-রূপনের পুরান ঢাকার এক বাড়িতে ফের অভিযান চালানো হয়েছে। পুরান ঢাকার লালমোহন সাহা স্ট্রিটের ১১৯/১ হোল্ডিংয়ে মমতাজ ভিলা নামে এই ছয়তলা বাড়ির নিচতলায় চলে অভিযান। বাসাটি আকারে ছোট, তাও সংকীর্ণ একটি গলির ভেতরে। যেন এক ‘কুঁড়েঘর’। অথচ ভেতরে টুকে অবাক হতে হয় পরিপাটি ঘরটি দেখে। আর সেই ঘরেই রক্ষিত পাঁচটি সিন্দুকে ও একাধিক ট্রাঙ্কে থরে থরে সাজানো নগদ ২৬ কোটি ৫৫ লাখ ৬০০ টাকা, এক কেজি স্বর্ণালঙ্কার, সোয়া ৫ কোটি টাকার এফডিআরের বই এবং অসংখ্য বিদেশি মুদ্রা (৯ হাজার ২০০ ইউএস ডলার, ১৭৪ মালয়েশিয়ান রিংগিত, ৩৫০ ভারতীয় রুপি, ১ হাজার ৫৯৫ চায়নিজ ইয়েন, ১১ হাজার ৫৬০ থাই বাথ ও ১০০ দিরহাম পাওয়া গেছে। এছাড়া বেশকিছু ক্যাসিনো সরঞ্জামও জব্দ করেছে র‌্যাব। কারা এরা? নামহীন গোত্রহীন দুই সহোদর। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির ভাগিদার। মিডিয়া লিখছে : ক্যাসিনো কারবারের মাধ্যমে মাত্র ৫ থেকে ৬ বছরের মধ্যেই টাকার কুমির বনে গেছেন দুই ভাই গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি এনামুল হক ভুঁইয়া ওরফে এনু এবং সাধারণ সম্পাদক রূপন ভুঁইয়া। গত বছর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর যুবলীগের শীর্ষস্থানীয় কিছু নেতার সঙ্গে তাদের নামও উঠে আসে। এই তাদের পরিচয়। তেমন বড় কোনো নেতা না। তারপরও হেরেমের গুপ্তধনের হিসাব দেখুন। কোথা থেকে এলো এতসব? একটা বিষয় পরিষ্কার এদের যদি এত থাকে বড় বড়দের কত আছে কেউ জানে না। জানে যখন তারা হাজার কোটি মেরে বিদেশ চলে যাব। অর্থ, সম্পত্তি আর নারী এতটা সহজলভ্য হয়েছে যা বলার মতো না। এই তিন ধারাই বলে দেয় নৈতিকতা সম্মান আর সামাজিক মূল্যবোধ আজ নেই বললেই চলে। আমি ভাবি তারুণ্যের কথা। ভাবি কিশোর-কিশোরীদের কথা। দেশের মিডিয়ায় এসব খবরের রমরমা দেখে তারা কীভাবে বড় হবে? তারা কি জানবে না সরকারি দলের পাতি নেতা হতে পারলেই জীবন সফল? টাকাপয়সার চাহিদা যুগ যুগ ধরে আছে, থাকবে। কিন্তু এমন বেপরোয়া চাহিদা আর কোথায় গিয়ে থামতে হবে সেটা না জানা কখনো ছিল না। শুধু ঢাকা না বাংলাদেশের সব এলাকায় এসব চলছে। লীগের নাম ভাঙিয়ে নেতা হওয়ার নামে লুটপাট আর এমন তেলেসমতি কারবার চলমান। মাঝে মাঝে দুয়েকটা খবর হয় এই যা। পাপিয়া যে কি জিনিস আর কি তার কাণ্ড তা জেনে আমাদের বিদেশেও ঘুম হারাম হয়ে গেছে। যে ছবি দেখলাম তা হিন্দি সিনেমার মধুচক্র নামে পরিচিত যৌন কেলেঙ্কারির নেতাদেরও হার মানায়। হাতে গায়ে উল্কি বিশাল বপু আর বসার ভঙ্গি যেন সর্দার। জানলাম তার বাবা ছিলেন ড্রাইভার। একজন সহজ খেটেখাওয়া মানুষের ঘরে এমন এক মহিলার পয়দা বিস্ময়কর। এই যে দুভাই এরাও থাকে কুঁড়েঘরে। আহারে ন্যাপ নেতা মোজাফফর আহমেদ। ভাগ্যিস তিনি মারা গেছেন না হলে কমরেড সাহেব কুঁড়েঘরে পাওয়া সম্পত্তির বহর দেখেই ইন্তেকাল ফরমাতেন। এই হলো কুঁড়েঘরবাসীর হাল। যেটা ভয়ের আমাদের পরিবার সমাজ আর জাতির কোনো জায়গা আর অনাক্রান্ত নেই। আগে জানতাম বনানী, গুলশান বা বড়লোক এলাকা নামে পরিচিত এলাকার মানুষ জনেরাই এত এত টাকা ডলারের মালিক হতে পারে। এখন তা গেণ্ডারিয়ায়ও নেমে এসেছে। সর্বস্তরে আর কিছু চালু না হলেও দুর্নীতি লোভ লালসা যৌনতা চালু হয়ে গেছে। এর বিহিত না হলে যত আর্থিক উন্নয়ন আর অবকাঠামো তৈরি হোক শান্তি মিলবে না। আর সেসব উন্নয়ন ও টেকসই হবে না। উন্নয়ন ও সামাজিক প্রগতি একসঙ্গে না চললে এক সময় আমরা আফ্রিকার দেশগুলোকে ছাপিয়ে ভয়ঙ্কর ও হিংস্র উঠবো। মাদক যৌনতা আর অর্থের অঢেল আনাগোনা সেটাই বলে দিচ্ছে। সরকারি দলের কাছে তখন মানুষ হাতজোড় করে মাফ চাইবে। বলবে ফিরিয়ে দাও সে অরণ্য লও এ নগর। আমরা কি সেটাই দেখতে চলেছি? তাড়াতাড়ি এসব বন্ধ না হলে না থামালে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রূপকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম কি আসলেই মসৃণ পথে চলবে? বিষয়টা গুরুতর বলে ভাবনাও দরকার চটজলদি। অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App