×

জাতীয়

সহিংসতা-বঞ্চনায় ম্লান নারীর অগ্রগতির অর্জন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২০, ১০:১৮ এএম

সহিংসতা-বঞ্চনায় ম্লান নারীর অগ্রগতির অর্জন

নারীর অগ্রগতি

বাংলাদেশে নারী-পুরুষের সমতার অগ্রগতির বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে সুখকর। জরিপ বা তথ্য-উপাত্তে তারই ইঙ্গিত রয়েছে। অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নারীর অভাবনীয় অগ্রগতি আজ বিশে^র বিস্ময়। বিশ্বের অনেক দেশই আজ বাংলাদেশকে নিয়েছে রোল মডেল হিসেবে। এত অর্জনের পরেও সাংগঠনিক ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে শতকরা হিসাবে পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ কতটা তা নিয়ে আছে প্রশ্ন। সেই সঙ্গে আছে নারীর প্রতি সহিংসতা, বৈষম্য, আইনি ব্যবস্থা, ভূমি মালিকানায় বঞ্চনা এবং কর্ম পরিবেশের বিষয়টিও। একই কাজ করে নারী-পুরুষের সমান মজুরি পান কিনা এই প্রশ্নও এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদন-২০২০-তে বাংলাদেশের নারীর অগ্রগতির তথ্য উঠে এসেছে। গত বছর ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, নারী-পুরুষের সমতার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। ১৫৩টি দেশের মধ্যে নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগ, শিক্ষায় অংশগ্রহণ, স্বাস্থ্য ও আয়ু এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন- এই চার মূল্য সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখার পাশাপাশি ১৪টি উপসূচকের মধ্যে চারটি উপসূচকে বাংলাদেশ বিশ্বের সব দেশের উপরে স্থান পেয়েছে। ক্ষেত্রগুলো হলো ছেলে ও মেয়ে শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তি, মাধ্যমিকে ছেলে ও মেয়েদের সমতা, জন্মের সময় ছেলে ও মেয়ে শিশুর সংখ্যাগত সমতা এবং সরকারপ্রধান হিসেবে কত সময় ধরে একজন নারী ক্ষমতায় রয়েছেন। ২০১৮ সালেও এই উপসূচকগুলোতে বাংলাদেশ একই অবস্থানে ছিল। প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। দীর্ঘ সময় ধরে (গত ৫০ বছরে) সরকারপ্রধান হিসেবে নারী থাকার রেকর্ডও বাংলাদেশের।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, প্রতিবছর নারীর কর্মসংস্থান বাড়ছে ৬ শতাংশ হারে। এক দশকের ব্যবধানে কর্মক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি সংখ্যা বেড়েছে ৬৬ লাখ ৮২ হাজার। তবে এর অধিকাংশই বেড়েছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে ৭ শতাংশ নারী। সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১০ লাখ ৯৬ হাজার ৩৩৪টি। যার মধ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র ৮৩ হাজার ১৩৩ জন।

বিশিষ্টজনরা বলছেন, নারীর প্রতি সহিংসতা ও কিছু বৈষম্য দেশের সব অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিনই ঘটে যাচ্ছে নারী নির্যাতন-ধর্ষণের ঘটনা। যা স্তম্ভিত করে পুরো জাতিকে। নারী নির্যাতন এখনো অনেকের চোখে খুব স্বাভাবিক বিষয়। যারা স্বাভাবিক বলে মনে করেন, তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা দানকারী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও আছেন।

চলতি বছরের ৫ মার্চ ‘জেন্ডার সোশ্যাল নর্ম’ সূচক প্রকাশ করে জাতিসংঘ। বিবিসি অনলাইনে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নারীর প্রতি বিশ্বের ৯০ শতাংশ নারী-পুরুষেরই নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। অর্থাৎ, ১০০ জনের মধ্যে ৯০ জনই নারীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। বিশ্বব্যাপী ৫০ শতাংশ পুরুষ মনে করেন চাকরির ক্ষেত্রে নারীর চেয়ে তাদের অধিকার বেশি। জরিপে অংশ নেয়া প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মনে করেন, পুরুষ যদি তাদের নারী সঙ্গীকে আঘাত করেন, তা গ্রহণযোগ্য। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের কোনো দেশেই লিঙ্গসমতা নেই। বিশ্বের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারী-পুরুষ বৈষম্য বিদ্যমান। রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি খাতে নারীর অংশগ্রহণ এখনো সুপ্রতিষ্ঠিত নয়।

একই দিনে প্রকাশিত ইউনিসেফ, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও ইউএন উইমেনের এক প্রতিবেদনেও এমন চিত্র উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিক্ষা, পুষ্টি, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর ক্ষেত্রে অগ্রগতি সত্তে¡ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনসহ সহিংসতার শিকার হয় নারী ও মেয়ে শিশুরা। বাংলাদেশে ১৫-৪৯ বছর বয়সী প্রতি চারজন নারীর একজন (২৫ দশমিক ৪ শতাংশ) স্বামীর দ্বারা স্ত্রীকে প্রহার করা ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করেন। স্বামীকে কিছু না জানিয়ে ঘরের বাইরে গেলে, সন্তানদের প্রতি অবহেলা করলে, স্বামীর সঙ্গে তর্ক করলে, স্বামীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে অস্বীকৃতি জানালে এবং খাবার পুড়িয়ে ফেললে এসব সহিংসতার ঘটনা ঘটে।

নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ার বিষয়টি নিয়ে সরকারও উদ্বিগ্ন। এ প্রসঙ্গে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেছা ইন্দিরা বলেন, সরকারের উন্নয়ন এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ড যেমন দৃশ্যমান; তেমনি নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনাও বাড়ছে। তবে শিশু নির্যাতনের ৯০ শতাংশই ঘটছে পরিবারে। কেবল আইন দিয়ে সরকারের পক্ষে এসব সহিংসতা বন্ধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সমষ্টিগত প্রচেষ্টা এবং জনজাগরণ। প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা ও মানসিকতার পরিবর্তন। আর এই কাজটি শুরু করতে হবে পরিবার থেকেই।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী মনে করেন, অর্থনৈতিক ও সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এখনো বাংলাদেশের নারীরা পিছিয়ে আছে। এছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্যেও নারীরা অনেক অবহেলিত। যেহেতু বাংলাদেশ নারী-পুরুষের সমতা এই পর্যায়ে এসেছে, সুতরাং কোথায় পিছিয়ে আছে, তা চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে বাংলাদেশ আরো ভালো করবে।

মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. মালেকা বেগম বলেন, নির্বাচন কমিশনের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলের সব পর্যায়ের কমিটিতে ২০২০ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশ নারী রাখার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলের কোনো কমিটিতেই নারী প্রতিনিধির সংখ্যা ৩৩ শতাংশের ধারে কাছেও নেই। দলগুলো দাবি করে, কমিটিতে নেয়ার মতো পর্যাপ্ত আগ্রহী ও যোগ্য নারী নেই। কিন্তু এ কথা সত্য নয়। নির্বাচনকালে মনোনয়ন প্রত্যাশী নারীদের বিপুল সংখ্যা দেখলে যে কারো কাছে স্পষ্ট হবে।

মানবাধিকার কর্মী খুশি কবীর বলেন, নারী-পুরুষের সমতায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকার ও দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীদের অধিষ্ঠান রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের নারীদের অংশগ্রহণের একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু মোট জনসংখ্যার অর্ধেক জনগোষ্ঠীর দেশে সংখ্যাগতভাবে এ অংশগ্রহণ খুবই কম।

বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বলেন, সিডও সনদ, বেইজিং ঘোষণার ১২টি ইস্যু, এসডিজি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল উদ্দেশ্য হলো- সমতা প্রতিষ্ঠা করা। নারীরা যতটুকু অর্জন করেছে, আজ পর্যন্ত তাকে পেছনে ঠেলে দেয়ার ষড়যন্ত্র সবসময় চলছে। নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্ত হবে না।

শ্রমিক নেত্রী নাজমা আক্তার বলেন, বাংলাদেশের নারীরা এখনো মজুরি বৈষম্যের শিকার। চাকরির ক্ষেত্রে সমতা নাই। নাই অর্থনৈতিক সমতা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App