×

মুক্তচিন্তা

নারী দিবস আসে যায়, দৃশ্যপট বদলায় না

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২০, ০৮:১১ পিএম

প্রতি বছর দেখা যায় কর্মক্ষেত্রে, উদ্যম ও উদ্যোগে অগ্রণী ভ‚মিকা রাখার জন্য কোনো কোনো নারীকে পুরস্কৃত করা হয়। এই কাজের যৌক্তিকতা আয়োজকরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে আমি মনে করি নারীর প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাব প্রদর্শন ও তা কার্যকর রাখাই উত্তম পুরস্কার।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপিত হলো। বাণী, আলোচনা সভা, পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা, টিভিতে বিশেষ অনুষ্ঠান ইত্যাদি নানা আয়োজন, আনুষ্ঠানিকতা ছিল। নারীর অধিকার, সমতা নিয়ে কথা হলো। কথা হলো নির্যাতনের বিরুদ্ধেও। নারী উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য পুরস্কৃত হলেন কেউ কেউ। প্রসাধনী সংস্থা, আচার কোম্পানিও বসে থাকে না। অথচ এসবে নারীর অধিকার সমুন্নত হয় না। নারী নির্যাতন বন্ধ হয় না। আয়োজননির্ভর আন্তর্জাতিক নারী দিবস শেষ হয়। বছর শেষে আবার ফিরে আসে। ফিরে যায়। ফল একই থাকে। দৃশ্যপট বদলায় না। নারীর অধিকার একসময়ে মৌলবাদীদের ফতোয়াবাজিতে ভ‚লুণ্ঠিত হতো। প্রবল সামাজিক আন্দোলনে ফতোয়ার তেজ কমে গেছে। বেরিয়ে এসেছে ধর্মীয় কুসংস্কারের ছোবল থেকে নারী। এখন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ ধর্মীয় কিংবা যে কোনো প্রতিবন্ধকতার প্রতি তাদের চ্যালেঞ্জকেই প্রতীয়মান করে। এখন একজন নারী নিজের পরিবর্তন নিজেই আনতে সমর্থ। যদিও সামাজিক নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত হয়নি। নিরাপত্তা বিধানে যথেষ্ট আইন প্রণয়ন হলেও, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা থাকলেও নারীরা নিরাপদ হতে পারেননি। নারী যদি হয় দুই বছর কিংবা তিন বছরের, নারী হওয়ার কারণে তার নিরাপত্তা নেই। পরিণত বয়সের পুরুষ দ্বারা কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়, হচ্ছে। এমনকি ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী শিক্ষার্থী শিক্ষক বা ইমাম দ্বারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শাস্তির ঘোষণা, শাসন থাকলেও ধর্ষণ ও হত্যা বন্ধ হয় না, হচ্ছে না। ধর্ষকদের তোয়াক্কা নেই। একে একে আরো শিক্ষক, আরো ইমাম, আরো রাজনীতিক, আরো বখাটে, আরো পুলিশ সদস্য, আরো বেপরোয়া ব্যবসায়ীরা ধর্ষক হয়ে উঠছে। ধর্ষকে সয়লাব হয় সমাজ, দেশ। ধর্ষকরা ছাড় পায়, পার পায়। কেন পায়, কীভাবে পায় যারা ছেড়ে দেন, পার পাইয়ে দেন জবাবটা ভালো তারাই দিতে পারেন। তবে শুধু আইন প্রয়োগ করে নারীর নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাব ইতিবাচক, শ্রদ্ধার মতো করার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ, প্রচেষ্টা ও ইচ্ছে এবং সর্বোপরি শিক্ষা। রাষ্ট্র পারে যে প্রচেষ্টাকে সঠিক দিকে, সঠিক লক্ষ্যে এগিয়ে নিতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে। তেমন মুখ চালানো নয় প্রকৃত নারীবান্ধব প্রশাসন দরকার। কী করে প্রসাধনী কোম্পানি? একবার লিখলাম সমাজকে কীভাবে কুরে কুরে খাচ্ছে প্রসাধনী কোম্পানিগুলো। পণ্যের প্রচার করতে গিয়ে তারা নারীকে পণ্য বানিয়ে ফেলছে পক্ষান্তরে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নারীর সৌন্দর্য ত্বকে এমন অবমূল্যায়ন প্রচারণায় শামিল হয় অনেক সচেতন নারী সেলিব্রেটি এবং তা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে। একজনকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেয়েছিলাম, ত্বক কেন হবে নারীর অপরূপ সৌন্দর্য, কেন নয় মেধা, জ্ঞান কিংবা বিজ্ঞানমনস্কতা? অর্থে বিক্রি হওয়া অর্থহীন সেলিব্রেটি জবাব দিলেন, মানুষ বাহ্যিক রূপে অন্যকে দেখতে পছন্দ করে। বুঝতে হলো তিনি নারীকে একজন মানুষ হিসেবে দেখার প্রয়োজনীয়তা হারিয়ে ফেলেছেন। পণ্যজাত হয়ে গেছে তার বিবেক। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আচার নিয়েও প্রতিযোগিতা হয়। কে কত ভালো রাঁধুনী সেই প্রতিযোগিতাও চলে। আচার তৈরির গুণাগুণের চেয়ে আচার কোম্পানির প্রচারণার এ এক অভিনব আবেগীয় কৌশল। চলতেই পারে। নারী তো বহুগুণে গুণান্বিতা। সন্তান ধারণ, লালন-পালন, সংসার পরিচালনা, অফিস-আদালত সামলানো আরো কত কাজ প্রতিনিয়ত তার। যে তালিকায় পুরুষের দৈনন্দিন কাজ অপেক্ষাকৃত কম। পরিবারে মা-বোন-কন্যার হাতের রান্নার রয়েছে ভিন্ন অমৃত স্বাদ। সন্তান মায়ের হাতের রান্না খেয়েই বেড়ে ওঠে পরিবারে। আচার তো সেই রান্নারই একটা অংশ। আচার কোম্পানি সেই দৃষ্টিতে আচারের সঙ্গে নারীকে সম্পৃক্ত করে উপস্থাপন করার কথা ভাবতেই পারে। যদিও এটা তাদের দায় নয় নেহায়েত ব্যবসা-বাণিজ্য। কারণ অনেক পরিবারে নিরাপদ নন মা, স্ত্রী, বোন কিংবা কন্যা। সেসব ক্ষেত্রে এসব কোম্পানির কোনো প্রতিবাদমূলক ভ‚মিকা নেই। নেই নারীর সার্বিক গুণাগুণকে উপস্থাপনের মর্যাদাকর দৃশ্যমান কোনো প্রচেষ্টা। একজন তরুণকে তারা দেখার উদ্যোগ নেন না যে, একটা পরিবারে একজন মা কতটা আত্মত্যাগে সন্তানকে লালন-পালন করেন, একজন মায়ের কতটা দক্ষতা, মেধা ও যোগ্যতা রয়েছে। পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান পরিষ্কার হতে দেখা যায় না। পরিবারে নারীর কোমল অকৃত্রিম অনুভ‚তিকে এরা পুঁজিবাদে টেনে এনে নিজেদের স্বার্থই হাসিল করছেন। নারীর ক্ষমতাকে সীমিত পরিসরে দেখাবার এ এক হীন মানসিকতা। ‘সুন্দরী’ প্রতিযোগিতা নারীর প্রতি আর এক হীনমন্যতার বহিঃপ্রকাশ। নারীকে দেহসর্বস্বভাবে দেখবার অপচেষ্টা। একসময় নারীকে ভাবা হতো পুরুষের ভোগসামগ্রী। এই ভাবনাকে গুঁড়িয়ে দেয়ার সফল উদ্যোগ ছিল সামাজিক লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ধরনের কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ এবং যেটা নারীরাই করেছেন। মেধা আর যোগ্যতা বলে নারীরা এখন মহাকাশে যাচ্ছেন, আকাশে ডানা মেলছেন, পর্বতশৃঙ্গে পৌঁছে যাচ্ছেন। ক্রিকেট ব্যাটে ছক্কা মেরে, ফুটবলে লাথি মেরে কাপ ছিনিয়ে আনছেন। পড়াশোনায়ও পিছিয়ে নেই নারী। অথচ কালের বিবর্তনে প্রকাশ্যে নারীকে ভোগের সামগ্রী হিসেবে দেখবার কথা প্রকাশ না পেলেও পুরুষতান্ত্রিক অবয়বে পাশাপাশি চলছে সেই অপচেষ্টা। ‘সুন্দরী’ প্রতিযোগিতা তার একটা নমুনামাত্র। ‘সুন্দরী’ প্রতিযোগিতায় মেধা-জ্ঞান অংশে বিচারকদের প্রশ্নোত্তর পর্ব কখনোই একজন নারীর মেধাজ্ঞানের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটায় না। বরং মেধাজ্ঞানে নারীকে ক্ষুদ্রতর বলয়ে রাখার চেষ্টা করা চলে। হরেক রকম পোশাকে স্টেজে হাঁটিয়ে, ইংরেজি কাদায় বাংলা কথা বলিয়ে নারীর সৌন্দর্য বিচার-বিশ্লেষণের উদ্যোগটি পুরুষতন্ত্রের শর্তকে পূরণ করে। আমাদের দেশে অনেক পুরুষ আছেন যারা নারীকে দেহসর্বস্বভাবে দেখতে পছন্দ করেন, গুণ কিংবা মেধায় নয়। এই ধরনের আয়োজন সেসব পুরুষের জন্য কিনা আয়োজকরাই বলতে পারবেন। আবার এ ধরনের প্রতিযোগিতা নিয়ে অনেক ধরনের গল্প বাজারে চালু হয়। যা নারীর সম্মানকেই ক্ষুণœ করে। নারীকে ভোগসামগ্রী হিসেবে দেখবার প্রচেষ্টা চলে। অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে। প্রতি বছর দেখা যায় কর্মক্ষেত্রে, উদ্যম ও উদ্যোগে অগ্রণী ভ‚মিকা রাখার জন্য কোনো কোনো নারীকে পুরস্কৃত করা হয়। এই কাজের যৌক্তিকতা আয়োজকরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে আমি মনে করি নারীর প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাব প্রদর্শন ও তা কার্যকর রাখাই উত্তম পুরস্কার। সনদ বা ক্রেস্ট নয়, সমাজের প্রতিটি সেক্টরে সংবিধানসম্মতভাবে নারীর অধিকার নিশ্চিত করা এবং নিরাপত্তা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণই হতে পারে সর্বোত্তম উদ্যোগ। বছরের একটি দিন নয়, প্রতিটি দিন হতে হবে নারীকে মানুষ হিসেবে দেখবার দিন।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App