×

জাতীয়

‘রাজনীতির কবির’ স্বাধীনতার ডাক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২০, ১২:০৯ এএম

একটি কবিতা লেখা হবে, তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর, ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি’? রেসকোর্স ময়দানে জনসমুদ্রে সেদিন এক অমর কবিতা পাঠ করেছিলেন বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে কবিতা ঠাসা ছিল হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতার চেতনার বারুদে। বাংলার ঘরে ঘরে সে বারুদ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বাংলার স্বাধীনতার মহানায়কের মুক্তির ডাক সেদিন সে বারুদে আগুন জালিয়ে দিয়েছিল। যার বিস্ফোরণ ঘটেছিল রেসকোর্স ময়দানে। একাত্তরের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দান ছিল জনসমুদ্রে উত্তাল। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়েছিলেন উত্থিত বাঁশের লাঠি হাতে সমবেত বিক্ষুব্ধ জনতা। বাতাসে উড়ছিল বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল সূর্যের অসংখ্য পতাকা। জনস্রোতের সেই সুনামির গর্জনের মধ্যেই সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা কালো কোট পরে দৃপ্তপায়ে রেসকোর্সের মঞ্চে উঠে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আকাশ-কাঁপানো স্লোগান আর মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন অপেক্ষমাণ জনসমুদ্রের উদ্দেশে। এরপর সেই বজ্রকণ্ঠ… আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তারা আজ তার অধিকার চায়।…আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস, এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।… তৎকালীন পাকিস্তানের শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্তির ডাক দেয়া বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ রেডিও টেলিভিশনে প্রচার করার অনুমতি ছিল না। তবে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র করপোরেশনের চেয়ারম্যান এএইচএম সালাহউদ্দিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আবুল খায়ের ভাষণটি ধারণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণটির ভিডিও করেছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের চলচ্চিত্র বিভাগের পরিচালক অভিনেতা আবুল খায়ের। আর অডিও রেকর্ড করেছিলেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রযুক্তিবিদ এইচ এন খোন্দকার। পরে রেকর্ডিংয়ের অনুলিপি বঙ্গবন্ধুকে হস্তান্তর করা হয়। ভারতে পাঠানো অডিওর তিন হাজার কপি করে সারাবিশ্বে বিতরণ করেছিল ভারতীয় রেকর্ড লেবেল এইচএমভি (হিজ মাস্টার্স ভয়েস)। সেদিনের ভাষণ দিতে গিয়ে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত না হওয়া। এমনই ভাবনা মাথায় ছিল। ভাষণের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের ওপর হত্যা করা হয়- তোমাদের ওপর আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। অতি সতর্কতার সঙ্গেই বঙ্গবন্ধু এভাবে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তাঁর সেই সতর্ক দৃষ্টির কারণেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সেদিন জনসভায় হামলার প্রস্তুতি নিলেও তা সফল করতে পারেনি। পাকিস্তানের এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এক কর্মকর্তা আপসোস করে লিখেছিলেন, শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলো, আর আমরা কিছুই করতে পারলাম না। ভাষণের এক ফাঁকে বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশনা দিয়ে বলেছিলেন, সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মূল্যায়ন করতে গিয়ে লন্ডনের ‘অবজারভার’ পত্রিকার তৎকালীন রাজনীতি বিশ্লেষক সিরিল ডান লিখেছিলেন, ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল একটি জাতির স্বাধীনতা ও স্বাধীন অস্তিত্ব পুনর্নির্মাণের ডাক। এই ডাক সারাবিশ্বের নির্যাতিত মানুষের মনে সাড়া জাগাবে তাতে সন্দেহ নেই। লন্ডনের সানডে টাইমস বঙ্গবন্ধুকে ‘এ পোয়েট অব পলিটিক্স’ বা রাজনীতির কবি আখ্যা দিয়েছে। ফরাসি দার্শনিক আঁদ্রে জিতের মতে, ৭ মার্চের ভাষণ শুধু ঐতিহাসিক নয়, এটি একটি ধ্রুপদী ভাষণ। এ ভাষণের গর্ভ থেকে একটি স্বাধীন জাতির জন্ম হয়েছে। ভাষণের এক পর্যায়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়া নির্দেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু উদাত্ত কণ্ঠে বলেন, প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক ইউনিয়নে, প্রত্যেক সাব-ডিবি-সনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ্‌। সম্প্রচারতত্ত্বমতে, প্রতি মিনিটে ৬০ শব্দের উচ্চারণ আদর্শ মানের। ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধু প্রতি মিনিটে গড়ে ৫৮ থেকে ৬০টি শব্দ উচ্চারণ করে ১৯ মিনিটে তার কালজয়ী ভাষণ শেষ করেছিলেন। এক হাজার একশ সাতটি শব্দের এ ভাষণে কোনো বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি, বাহুল্য ছিল না। ছিল শুধু সারকথা। দু’একটি স্থানে পুনরাবৃত্তি বক্তব্যের অন্তর্লীন তাৎপর্যকে বেগবান করেছে বলে মনে করা হয়। বিশ্বের ১২টি ভাষায় অনুবাদ করা ৭ মার্চের অবিস্মরণীয় সেই ভাষণটি ইউনেস্কো ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইতোমধ্যে ৭ই মার্চকে জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ ছিল মুক্তিকামী বাঙালির যুদ্ধ স্লোগান। আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র এই ভাষণ আজও শুনলে শিশু-কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ থেকে শুরু করে সবার গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়- শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/ রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি— ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App