×

জাতীয়

স্বপ্নের সেতুর উড়ন্ত গতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২০, ১১:০১ এএম

স্বপ্নের সেতুর উড়ন্ত গতি

ফাইল ছবি

স্বপ্নের সেতুর উড়ন্ত গতি

ঢাকার কেরানীগঞ্জের পানগাঁওয়ে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের (সিআরইসি) কার্যালয়ে ঢোকার মুখেই ৫ জন কর্মী করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত যাবতীয় পরীক্ষা করে নিলেন। তখন সাংবাদিকদের চোখে-মুখে আতঙ্ক ফুটে উঠলেও ভেতরে গিয়ে দেখা গেল রীতিমতো ‘উৎসব’। স্বপ্ন ছোঁয়ার উৎসব। পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরুর মধ্য দিয়ে যে স্বপ্নের বীজ রোপিত হয়েছিল, তা রীতিমতো ফলদায়ক বৃক্ষের রূপ নিচ্ছে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় চার কিলোমিটার ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। এরই মধ্যে কিছুটা আতঙ্ক ছড়িয়েছে ‘করোনা’, তৈরি করেছে চীনা শ্রমিক সংকট। তবু কমেনি কাজের গতি, নির্ধারিত সময়ে স্বপ্ন পূরণে নামানো হয়েছে শক্তিশালী ‘রোবট’। শ্রমিক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী মিলিয়ে পদ্মা সেতুতে চীনের ১৭শ জন কাজ করতেন। এখন আছেন ১৩শ শ্রমিক।

চীনা নববর্ষের জন্য ছুটিতে যাওয়ায় বাংলাদেশ সরকার তাদের আপাতত পদ্মা সেতুর কাজে যোগ দিতে নিষেধ করেছে। তবু থামেনি এই মহাযজ্ঞ। শ্রমিকের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে রোবট। আরাধ্য পদ্মা সেতু দিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অর্থাৎ ২০২১ সালে বাস, ট্রাক চলবে। পুরোপুরিভাবে রেল চলবে আরো তিন বছর পর ২০২৪ সালে।

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কিছু কর্মকর্তা চীনে আটকা পড়েছেন বলে জানিয়েছেন দেশটির রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। এর পাশাপাশি চীনের কিছু প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম বন্ধ রাখায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এই অবকাঠামো প্রকল্পের কাজ কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এখন এই প্রকল্পের কাজে গতি আনতে চীনের নাগরিকদের জন্য ‘অন অ্যারাইভাল ভিসা’ পুনরায় চালু করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত লি জিমিং।

গত বুধবার ঢাকার কয়েকজন সাংবাদিককে পদ্মা বহুমুখী সেতু এবং পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ সরেজমিন দেখার সুযোগ করে দেয় সিআরইসি। এ সময় দেখা যায়, দেশের প্রথম এলিভেটেড রেললাইনের প্রথম স্প্যানটি বসানো হয়েছে মুন্সীগঞ্জের পলাশপুরে। এলিভেটেড রেললাইনের ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটারের মধ্যে ১৬ কিলোমিটারে এ রকম মোট ৪১৮টি স্প্যান বসানো হবে। নদী ও নিম্নাঞ্চল থাকায় এ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়েছে। এই রেললাইন সোজা চলে যাবে পদ্মা সেতুতে। পদ্মা পার হয়ে প্রথমবারের মতো রেল যাবে সংশ্লিষ্ট গন্তব্যে।

সিআরইসি জানিয়েছে, পদ্মা সেতুর ৪২টি পিয়ারের মধ্যে ৩৯টির কাজ শেষ হয়েছে। ৪১টি স্প্যানের মধ্যে ২৫টি স্প্যান বসেছে। সবমিলিয়ে ৮৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ কাজের দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। তবে রেল সংযোগের কাজটি একটু পিছিয়ে গেছে। রেল সংযোগে এ পর্যন্ত মাত্র ১১ দশমিক ৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

মাওয়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কাজ শেষ হবে আগামী বছরের মধ্যে। আর পদ্মা সেতুতে বাকি ১৬টি স্প্যান বসবে জুলাইয়ে। এরপর থেকেই শুরু হবে সেতু ছোঁয়ার অপেক্ষা। পদ্মা সেতু শুধু রড, সিমেন্ট ও পাথরের সেতু নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের আবেগ। চ্যালেঞ্জকে জয় করার অদম্য বাসনা। সেতুটি চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনার হাতছানি দেয়ার পাশাপাশি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে।

পদ্মা সেতু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় চার কিলোমিটার সেতু দৃশ্যমান হয়েছে। এপ্রিলের মধ্যে সেতুর বাকি চারটি পিয়ারের নির্মাণ কাজ শেষ হবে। এর তিন মাসের মধ্যেই শেষ হবে অবশিষ্ট স্প্যান বসানোর কাজও। ইতোমধ্যে সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া ১০০ ভাগ শেষ হয়েছে।

করোনার কারণে এলো রোবট : যেসব চীনা প্রকৌশলী ও শ্রমিক স্প্যান জোড়া লাগানোর কাজ করেন তারা করোনা ভাইরাসের কারণে চীনে আটকা পড়ায় প্রকল্পের কাজ নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। তবে বিষয়টি সামলে নিতে দেশে আনা হয়েছে মেশিন রোবট। সিইআরসির দায়িত্বশীলরা বলেছেন, ১৫টি রোবট এরই মধ্যে প্রকল্প এলাকায় পৌঁছেছে। এই রোবট এখন পদ্মা সেতু প্রকল্পে স্প্যান ওয়েল্ডিংয়ের কাজ শুরু করেছে। জানা যায়, দুটি স্প্যানের স্ট্রাকচার তৈরি হয়ে আসা ছাড়া পদ্মা সেতুর আর কোনো কাজ এখন দেশের বাইরে নেই। ওই দুটি স্প্যান সাংহাই বন্দরে আটকা পড়ে আছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এগুলো দেশে আনা হবে।

কর্মকর্তারা জানান, একেকটি রোবট কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ জনের শ্রমিকের কাজ করতে পারে। তার সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমিক যারা এতদিন চীনা শ্রমিকের সঙ্গে মিশে এ কাজ করেছিলেন তারাও দক্ষ হয়ে উঠেছেন। এখন রোবটের পাশাপাশি দক্ষ কিছু বাংলাদেশি শ্রমিক এই ওয়েল্ডিং কাজ করছেন। প্রকল্পের কন্সট্রাকশন ইয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, আগে ক্রেন বা মেশিন পরিচালনায় যে চীনা শ্রমিক কাজ করতেন তার জায়গায় বাংলাদেশিরা কাজ করছেন।

বসেছে স্প্যান, চলছে দেশের প্রথম এলিভেটেড রেললাইনের কাজ : পদ্মা সেতুর উপরের অংশ দিয়ে চলবে যানবাহন। নিচের অংশ দিয়ে চলবে ট্রেন। এ ট্রেন ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে যাত্রা করে পদ্মা সেতু হয়ে যাবে যশোর পর্যন্ত। সে জন্য করা হচ্ছে ১৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন। এর মধ্যে ২৩ কিলোমিটার হবে এলিভেটেড (ভূমি থেকে উঁচুতে) রেলওয়ে। দেশের প্রথম এলিভেটেড রেললাইনটি ঢাকার জুরাইন স্টেশন থেকে শুরু হয়ে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানের কুচিয়ামোড়ায় গিয়ে স্থলভাগের রেললাইনের সঙ্গে মিলবে।

প্রথম স্প্যানের নিচে দাঁড়িয়ে এলিভেটেড রেললাইন করার কারণ ব্যাখ্যা করে প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা সেনা কর্মকর্তা কামাল বলেন, এ এলাকা নিচু এবং ধলেশ্বরীর শাখা নদী ও অন্যান্য নদী রয়েছে। নদীগুলোর জন্য ব্রিজটা উঁচু করতে হচ্ছে। এটা যেহেতু রেললাইন, তাই হঠাৎ করে উপরে উঠে নিচে নামা যাবে না। একটা স্মুথ লাইন করতে হয় রেলের জন্য। তা ছাড়া এখানে যে পরিমাণ নরম মাটি আছে, তাতে বাঁধ দিয়ে করার চেয়ে এলিভেটেড করলে কম খরচ হবে। সেই সঙ্গে জমির পরিমাণও কমে যাবে। তিনি আরো বলেন, কেরানীগঞ্জে দেশে প্রথম এলিভেটেড রেলওয়ে স্টেশন তৈরি করা হচ্ছে। ব্রডগেজে নির্মিত লাইনটি আপাতত সিঙ্গেল হলেও ভবিষ্যতে ডাবল করা হবে।

করোনা ভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলার পদক্ষেপগুলো তুলে ধরে প্রকল্প পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দিন এ চৌধুরী বলেন, করোনার কারণে আমাদের কাজের গতি কমে গেছে। কিন্তু থমকে যায়নি। আমরা যে লক্ষ্য স্থির করেছি, সেই লক্ষ্যেই কাজ শেষ করব। ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে যশোর পর্যন্ত মোট ১৬৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণকাজের এখন পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতির বিষয়ে তিনি বলেন, এলাকাজুড়েই আমাদের কাজ চলছে। এর মধ্যে মাওয়া থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করছি। এ অগ্রাধিকারমূলক অংশের প্রায় ৫০ শতাংশ কাজ শেষ করতে পেরেছি। ২০২১ সালের জুনে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার কথা রয়েছে। একই সময়ে রেল চালুর লক্ষ্যে কাজ করছি আমরা এবং এটা আমাদের পক্ষে সম্ভব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App