×

মুক্তচিন্তা

দ্রোহের মার্চ, স্বাধীনতার মার্চ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২০, ০৬:১৩ পিএম

৭ মার্চের ভাষণ-পরবর্তী বাঙালি স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে উঠল। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার প্রত্যয়দৃঢ় সবাই। সেদিনই কার্যত পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৃত্যু হয়েছিল। আজো ভাবলে অবাক লাগে, এখনকার মতো এত উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা না থাকা সত্তে¡ও কীভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছেছিল বঙ্গবন্ধুর বার্তা। স্বাধীনতাহীনতায় বাঁচতে না চাওয়ার মন্ত্র বাঙালির কানে পৌঁছে দেয়ার একক কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। অসম সাহসী এই নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

কতগুলো তারিখ এবং মাস আছে যেগুলো বাঙালির জাগরণ ও জাতিসত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কয়েকটি মাসকে আমরা বিশেষভাবে বিশেষিত করেছি আমাদের জাতীয় ইতিহাসের পরিচিতি হিসেবে। যেমন ফেব্রুয়ারি হলো আমাদের কাছে ভাষার মাস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বুকের রক্ত দিয়ে ইতিহাস তৈরি করেছিল আমাদের পূর্বসূরিরা। ভাষাশহীদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনার হয়ে উঠেছে আমাদের সাহসের প্রতীক, অন্যায়-অনাচার-অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের শপথ গ্রহণের পীঠস্থান। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই বাঙালি স্বাধীনতার পথে হেঁটেছে। ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী ধারা থেকে ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তার পথ চিনিয়েছে ভাষা আন্দোলন। যা কিছু ন্যায়সঙ্গত তার পক্ষে থাকার প্রেরণাও আমরা একুশের কাছ থেকেই পেয়েছি। তাই ফেব্রুয়ারি বাঙালির কাছে নিছক একটি সময় নির্দেশক মাস নয়, ফেব্রুয়ারি আমাদের কাছে একটি চেতনাসঞ্চারী মাস। এরপর মার্চ মাস। মার্চ মাস আমাদের কাছে দ্রোহের মাস। স্বাধীনতার মাস। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকেই বাঙালির কাছে মৃত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল পাকিস্তান। ১ মার্চ থেকেই উচ্চারিত হয়েছিল স্বাধীনতার স্লোগান। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ। মুক্তি ও স্বাধীনতার ডাক। যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান। বাঙালি প্রস্তুত হতে শুরু করে। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার কাজও চলতে থাকে মার্চের গোড়া থেকে। সশস্ত্র লড়াই যে অনিবার্য সেটাও অনেকের কাছেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু করে। রাজপথে ছাত্রছাত্রীদের রাইফেল কাঁধে মিছিলের ছবি সারাদেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করেছিল। ওটা ছিল নিরস্ত্র বাঙালির সশস্ত্র হয়ে ওঠার প্রতীক। তারপর আসে সেই কালরাত ২৫ মার্চ। পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনী রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি নিধনযজ্ঞে। কিন্তু বাঙালি ততদিনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলেছে। ওরা মারছে, আগুনে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছে বসতবাড়ি থেকে শুরু করে আরো কত কিছু। কিন্তু বাঙালি অকুতোভয় ‘জ্বলে-পুড়ে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’। সত্তরের নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট পাওয়া বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হয় স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। মার্চ হয় আমাদের স্বাধীনতার মাস। আগস্ট আমাদের কাছে শোকের মাস, বেদনার মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বাঙালির জীবনে নেমে এসেছিল মহাদুর্যোগ। একদল জাতিবৈরী বর্বর সেনাসদস্য চরম মোনাফেকের ভ‚মিকায় নেমে সপরিবারে হত্যা করেছিল স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। অমন দুর্দিন-দুঃসময় বাঙালির জীবনে আর কখনো আসেনি। ডিসেম্বর মাস আমাদের বিজয়ের মাস। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের অবসান ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ওইদিন বিকালে রমনা রেসকোর্স ময়দানে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে অবনত মস্তকে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তানি ৯০ হাজার সেনা সদস্য। সেটা ছিল আমাদের চরম আনন্দ ও উল্লাসের দিন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে প্রাণের আবেগ উথলে উঠেছিল গোটা জাতির। অবশ্য চরম বেদনার ঘটনাও ঘটেছিল বিজয়ের দুদিন আগে। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী এবং তাদের দেশীয় দোসর আলবদর, আলশামস বাহিনী। উদ্দেশ্য ছিল মেধা-মননে বাঙালি জাতিকে হীনবল করা। ২৫ মার্চ রাত থেকে শুরু করে শেষ দিন পর্যন্ত হত্যা-নির্যাতন-ধর্ষণ, অগ্নিকাণ্ডের মতো মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছিল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসররা। মুক্তির মন্দির সোপান তলে ৩০ লাখ প্রাণ বলিদান হয়েছে। ১ কোটি মানুষকে উদ্বাস্তুর জীবন বেছে নিতে হয়েছিল। এদের আশ্রয় দিয়ে পরম মিত্রের কাজ করেছিল ভারত। মার্চ মাস এলে স্বাভাবিকভাবেই একাত্তের কথা মনে পড়ে। একাত্তরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিটি দিন ছিল বাঙালির জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামমুখর দিন। সে এক অন্যরকম সময়। বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি, বুঝে নিয়েছিল দুর্বৃত্ত। আজ বিশেষভাবে মনে পড়ছে ৭ মার্চের কথা। তখন আমি ঢাকায় ছিলাম না। রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধুর সেই বজ্রকণ্ঠ শোনার সৌভাগ্য ঢাকার বাইরে থাকা আমার মতো অনেকেরই হয়নি। তবে ঢাকা থেকে অনেক দূরে উত্তরের এক নিভৃত জনপদে থেকেও আমরা একাত্ম ছিলাম রেসকোর্স ময়দানের উত্তাল জনতরঙ্গের সঙ্গে। বর্তমান পঞ্চগড় জেলার বোদা বাজারে আমার মতো আরো শত শত মানুষ ৭ মার্চ দুপুর থেকেই সমবেত হয়েছিলেন রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য। তখন ঘরে ঘরে রেডিও ছিল না। টেলিভিশন তো একটিও না। খবর শোনার মাধ্যম ছিল বিবিসি রেডিও এবং ভয়েস অব আমেরিকা। প্রতিদিনের সংবাদপত্র প্রতিদিন পাওয়া যেত না। একদিন পর আমরা ঢাকার পত্রিকা পেতাম। হাতেগোনা মাত্র দুটি দৈনিক আমরা পেতাম। দৈনিক ইত্তেফাক এবং দৈনিক আজাদ। দৈনিক পাকিস্তান দেখেছি বলে মনে পড়ে না। একাত্তরের ১ মার্চ থেকেই সারাদেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল। আমরা জেনেছিলাম বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ নীতিনির্ধারণী ভাষণ দেবেন। কী বলবেন তিনি তা নিয়ে ছিল নানা জল্পনা-কল্পনা। ৭ মার্চই কি বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন, নাকি প্রস্তুতির জন্য আরো সময় নেবেন? বঙ্গবন্ধু একতরফাভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে পাকিস্তানিরা কী করবে তা নিয়েও কারো কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি রেডিওতে সম্প্রচার হবে শুনে বোদা বাজারে আশপাশের গ্রাম থেকেও নানা বয়সের মানুষ সমবেত হতে থাকেন। বাজারে সব দোকানে রেডিও ছিল না। বিস্কুট কোম্পানি নামে পরিচিত একটি চা-বিস্কুটের দোকান ছিল স্থানীয় রাজনৈতিক ও ছাত্র কর্মীদের আড্ডাস্থল। সেখানে একটি রেডিও ছিল। মানুষ ভিড় করে ওই রেডিওতেই বিবিসি-ভয়েস অব আমেরিকার খবর শুনত। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য বিপুলসংখ্যক মানুষের জমায়েত হওয়ায় প্রশ্ন ওঠে, মাইকের ব্যবস্থা না হলে তো সবার পক্ষে ভাষণ শোনা সম্ভব না। আব্দুল লতিফ নামে একজন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক ছিলেন। বাজারে তার একটি বইয়ের দোকান ছিল। তিনি বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। তিনি নিজ উদ্যোগে তার বইয়ের দোকানে একটি মাইক লাগালেন। ভাষণ শোনার জন্য কয়েক হাজার মানুষ গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। বোদা বাজার সেদিন হয়ে উঠেছিল যেন এক বিরাট জনসভাস্থল। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যায়, ভাষণ আর প্রচার হয় না। মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ে। কী হলো ঢাকায় তা নিয়ে চলতে থাকে অনুমাননির্ভর আলোচনা। জনসভা কি করতে দেয়া হলো না? বঙ্গবন্ধুকে কী গ্রেপ্তার করা হয়েছে? নাকি তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন বলে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ ভাষণ প্রচারে বাধা দিয়েছে? সন্ধ্যার বিবিসির খবরে জানা গেল, বিশাল জনসভা হয়েছে রেসকোর্সে। ঢাকা শহরের সব মানুষ যেন উপস্থিত হয়েছেন রেসকোর্সে। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছেন। বলেছেন এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। খবরে তো বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। তাই বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে আর কী বললেন, তার পুরো ভাষণ শোনার উপায় কী তা নিয়ে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়। অনেক রাত পর্যন্ত বাজারে মানুষের জটলা চলল। সকালে জানা যায়, ভাষণ সম্প্রচার না করায় রেডিওর বাঙালি কর্মী-কলাকুশলীরা ধর্মঘট করতে চাওয়ায় বঙ্গবন্ধুর রেকর্ডকৃত ভাষণ বাজানোর অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছে। ক্রমে সে খবর রটে গেল সর্বত্র। মুহূর্তের মধ্যে বাজারে আবার মানুষের জমায়েত তৈরি হলো। আশপাশের গ্রাম থেকেও আসতে থাকে মানুষের স্রোত। লতিফ স্যার হন্তদন্ত হয়ে এসে আবার মাইক লাগালেন। এক সময় অপেক্ষার অবসান হলো। ইথারে ভেসে এলো বঙ্গবন্ধুর সেই ভরাট গলা, ‘ভাইয়েরা আমার ...’। মুহূর্তে থেমে গেল সব কোলাহল। মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পিনপতন নীরবতায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনলেন। তাঁর প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ মানুষকে উদ্বেলিত করছিল। তিনি যেন সব বাঙালির মনের কথাই দৃপ্তকণ্ঠ বলছিলেন। তিনি যখন বললেন, কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না তখন জনতার সে কী উল্লাস! তিনি বললেন, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাল্লাহ তখন জনতা হয়ে ওঠেন স্লোগান মুখর। জয় বাংলা বলে ভাষণ শেষ করেন রাজনীতির মহান কবি। কিন্তু শ্রোতাদের মধ্যে তখনো আরো কিছু শোনার আগ্রহ। একটি ভাষণ যে মানুষকে কতটা উজ্জীবিত করতে পারে, বদলে দিতে পারে সেদিনই সেটা উপলব্ধি করেছিলাম। একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাষণের আগে এবং পরে বাঙালি আর একই রকম থাকল না। ৭ মার্চের ভাষণ-পরবর্তী বাঙালি স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে উঠল। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার প্রত্যয়দৃঢ় সবাই। সেদিনই কার্যত পাকিস্তান রাষ্ট্রের মৃত্যু হয়েছিল। আজো ভাবলে অবাক লাগে, এখনকার মতো এত উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা না থাকা সত্তে¡ও কীভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছেছিল বঙ্গবন্ধুর বার্তা। স্বাধীনতাহীনতায় বাঁচতে না চাওয়ার মন্ত্র বাঙালির কানে পৌঁছে দেয়ার একক কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। অসমসাহসী এই নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App