×

সাময়িকী

৭ মার্চ এবং বাঙালির উজ্জীবন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২০, ০৮:৪৮ পিএম

৭ মার্চ এবং বাঙালির উজ্জীবন

বাঙালির মহান নেতা শেখ মুজিব যেমন জাতিকে স্বাধিকার আর স্বশাসিত হবার স্বপ্নের সাথে যুক্ত করেছিলেন নিজের বিশ্বাস-প্রেম-নিষ্ঠা আর সততায়; তেমনি নিজেকেও বাঙালি জাতির অনিবার্য-অবিসংবাদিত নেতা হিসেবেও প্রস্তুত করেছিলেন তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের একাগ্রতা-নিবেদন আর ত্যাগে। আমরা তাঁর জীবনসংগ্রামকে পর্যালোচনা করলে দেখি ১৯৪৭-এ দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে ভারত ভাগ হবার পর পূর্ববাংলার মানুষের ওপর নেমে আসে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দুঃশাসন, মুসলিম লীগের বাঙালিবিদ্বেষ; তখন থেকেই তরুণ বাঙালি রাজনৈতিক কর্মী শেখ মুজিবের বাঙালিপ্রীতি-বাংলাপ্রীতি এবং পূর্ববঙ্গপ্রীতি প্রকাশ্য হয়ে যায়। ১৯৫৩-৫৪ তে শেখ মুজিব বাঙালির কাছে প্রিয় নেতা, ক্রমশ জনপ্রিয়; ১৯৬৬-তে যখন শেখ মুজিব বাঙালি জাতির মুক্তিরাকাক্সক্ষায় ৬ দফা দাবি উপস্থাপন করেন, এরপর তিনি রাতারাতি পাকিস্তানি দুঃশাসনের শিরপীড়ার কারণ আর বাঙালির স্বপ্নাকাক্সক্ষার ধন।

পাকিস্তানি দুঃশাসন যখন শেখ মুজিবকে প্রতিহত এবং চিরতরে স্তব্ধ করতে ষড়যন্ত্রে পা বাড়ালো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে, শেখ মুজিব তখন হয়ে উঠলেন অপ্রতিদ্ব›দ্বী নেতা। ১৯৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে নিষ্কৃতি লাভ এবং কারামুক্ত হলে ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স মাঠে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত সমাবেশে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভ‚ষিত করা হয়; এরপর শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। ৮ মার্চ ঢাকা বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করা হলে শেখ মুজিব বাংলাদেশে সর্বব্যাপী হয়ে ওঠেন, হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির মুক্তির দিশা। আমরা তাই প্রত্যক্ষ করি ১৯৭১-এ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাসকাল বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকলেও বাংলাদেশ তাঁর নামে, তাঁকে নিজেদের পাশে চেতনায় ধারণ করেই যুদ্ধ করেছে হানাদার দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে। ১৯৭১-এর ৭ মার্চের পর বঙ্গবন্ধু মুজিব, সেই যে বাংলার বিস্তীর্ণ জনপদে সর্বব্যাপী হলেন; এরপর শেখ মুজিব মুক্তিকামী বাঙালির চৈতন্যে নিত্য নাড়া দিয়ে যান। বাংলার কৃষক-শ্রমিক-কামার-কুমোর-তাঁতি-জেলে-মাঝি-মাল্লা-কৃষাণী-ছাত্র-যুবক-দরিদ্র-নিঃস্ব-ধনী-নির্ধন সবার যিনি প্রাণের মানুষ, যখন তাঁকে নিয়ে বাঙালির নিত্য প্রাণোচ্ছ¡াস; তখন বাংলার ঘরে ঘরে বঙ্গবন্ধু নিত্য উপস্থিত; এ কথা ভুলে গেলে চলবে না।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে পৃথিবীর অন্যতম ‘ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টরি হেরিটেজ’ বলে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ উচ্চারিত হবার ছেচল্লিশ বছর পর। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্যের বিষয়টি বাঙালি ১৯৭১-এ এক নদী রক্ত দিয়ে এবং বিজয় অর্জনের মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছে। ১৯৭১-এর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে কিছু লেখালেখি অবশ্যই হয়েছে, বক্তৃতাও অল্পবিস্তর হয়েছে; কিন্তু প্রায় অর্ধশতাব্দী পর বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা যখন বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণকে বিশ্বপ্রেক্ষাপটে অন্যতম প্রভাববিস্তারকারী ঐতিহাসিক ভাষণ বলে স্বীকৃতি দেয়, তখন সচেতন মানুষ মাত্রই একবার নড়েচড়ে বসেন। আমরা আগেই জেনেছি বিশ্বসেরা ভাষণের তালিকায় গৌরবান্বিত হয়েছে মার্টিন লুথার কিং, আব্রাহাম লিংকনের ভাষণ। যতবার আমরা তাদের ভাষণের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণকে বিবেচনায় এনেছি, ততবারই মনে হয়েছে, যে কোনো বিবেচনায়ই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পৃথিবীর যে কোনো ঐতিহাসিক ভাষণের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যমণ্ডিতও বটে; কিন্তু যেহেতু বঙ্গবন্ধুর ভাষণ তৃতীয় বিশ্বের পশ্চাৎপদ মানুষের একজন বিশ্বপ্রভাববলয়হীন নেতার ভাষণ এবং যেহেতু সে ভাষণের অনিবার্য ফল বিশ্বের পরাশক্তির ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছে; সঙ্গত কারণেই তাঁর ভাষণকে অনেকেই বড় ধরনের স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠাবোধ করেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যে বিশ্বের প্রভাবশালী ভাষণগুলোর অন্যতম সে কথা বিশ্বের জ্ঞানী-গুণীরা সবাই জানেন; কিন্তু যে জাতি তাঁর স্বপ্ন পূরণকারী নেতাকে এভাবে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করতে পারে, সেই জাতির নেতাকে বিশ্ব কেন সম্মান জানাবে? ধারণা করি, এই একটি মাত্র কারণেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের দলিল হিসেবে স্বীকৃতি পেতে বিলম্ব হলো। আজ ইতিহাসের অমোঘ সত্যি হিসেবেই ছেচল্লিশ বছর পর সত্যিটা সামনে এসেছে এবং ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় ভাষণটিকে মর্যাদা দিয়েছে। তাঁর ভাষণকে সম্মান দেয়ার অর্থ বাঙালি জাতিকে সম্মান দেয়া।

যাঁর বয়স ষাট বছরের বেশি, তিনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণে আজও আবেগতাড়িত হবেন; কিন্তু কেন? কারণ তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন ১৮ মিনিটের একটা ভাষণ কীভাবে গোটা বাঙালি জাতিকে প্রভাবান্বিত করেছে। একটা বক্তৃতায় কী পরিমাণ প্রাণশক্তি থাকলে মানুষ এতটা উদ্বেল হতে পারে; কী শক্তি থাকলে মানুষ এভাবে বুকের রক্ত দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রত্ত্যুত্তর দিতে পারে! স্বার্থান্ধতার রাজনীতি আর ষড়যন্ত্রের সংস্কৃতিই ১৯৭৫-এর আগস্ট থেকে বঙ্গবন্ধু নামের ঔজ্জ্বল্যকে ‘গ্রহণ’ লাগিয়ে রেখেছে দীর্ঘ একুশ বছর; দীর্ঘ একুশ বছর ধরেই বাংলাদেশে চলেছে স্বাধীনতাবিরোধীদের দৌরাত্ম্য। একুশ বছর ধরে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন তাদের সবার ভয় ছিল বঙ্গবন্ধুর নামের ওপর; যে কারণে দীর্ঘ একুশ বছর ধরেই বাংলাদেশে অনুচ্চারিত থেকেছে বঙ্গবন্ধুর নাম; এবং এই একুশ বছরে বেশ ক’টি প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে ভুল ইতিহাসে- ভুল ব্যাখ্যায়। মৃত্তিকার স্পর্শবিহীন বৃক্ষ যেমন উন্মূল, নিজস্ব সংস্কৃতি-কৃষ্টি আর ইতিহাসবিচ্ছিন্ন মানুষও উন্মূল হতে বাধ্য; এবং দীর্ঘ একুশ বছর উন্মূল হয়ে বেড়ে উঠেছে বাংলার শিশুরা। আমাদের শিশুদের বাঙালির সৌর্য-বীর্য, পূর্বপুরুষের আত্মদানের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে এবং এভাবেই চেষ্টা চলেছে ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে; কিন্তু পাহাড়ের আড়াল দিয়ে কি সূর্যালোককে লুকিয়ে রাখা যায়? যায় না বলেই বঙ্গবন্ধু ফিরে আসছেন স্বমহিমায়; বঙ্গবন্ধু ফিরে আসছেন তাঁর নিজের মহানুভবত্বের দ্যুতিতে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের এই স্বীকৃতি তাঁর সগৌরব ফিরে আসার দৃষ্টান্ত।

৭ মার্চের ভাষণের দিকনির্দেশনা বাঙালি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে, বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে ১৯৭১-এ বাঙালি দা-বল্লম-লাঠি-তীর-ধনুক এমন কী ইট-পাথর নিয়ে সুসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মোকাবেলা করার জন্যে বেরিয়ে এসেছে পথে। বাঙালির সেদিনের উন্মাদনার চিত্র লিখে বোঝানো অসম্ভব। বলতে পারি সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি যেন আক্ষরিক অর্থেই বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর মাথায় উঠে এসেছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, “যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হচ্ছে, ততদিন খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো- কেউ দেবে না। শুনুন মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায়- হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, অ-বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আমাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা যদি রেডিও আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোনো বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মাইনা-পত্র নিতে পারে। পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ববাংলায় চলবে এবং বিদেশের সাথে দেয়া-নেয়া চলবে না।” সামান্য মনোযোগ দিলেই বোঝা যায় ভাষণের এ অংশে কতটা দূরদর্শিতা বিদ্যমান। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ কোনো লিখিত ভাষণ নয়। তাৎক্ষণিকভাবে তার মাথায় বা চিন্তায় যা এসেছে, তাই তিনি উচ্চারণ করেছেন স্বতঃস্ফ‚র্ত ব্যাঞ্জনায়। ১৮ মিনিটের ভাষণে তিনি যত কথা বলেছেন সবই তাঁর সম্মক উপলব্ধির কথা, সবই তাঁর জীবনাভিজ্ঞতার সাহসী উচ্চারণ; তাঁর এ ভাষণ তাঁর দেশপ্রেমেরও উদাহরণ। তাঁর ভাষণে তিনি যেসব কথা উচ্চারণ করেছেন; তার ফল যে তাঁর নিজের জন্য ভয়াবহ হতে পারে সে কথা তিনি জানতেন; এবং জানতেন বলেই তিনি বলেছেন, “আমি যদি হুকুম দিবার না-ও পারি” কিন্তু বঙ্গবন্ধু কাপুরুষ ছিলেন না; কাপুরুষ ছিলেন না বলেই মৃত্যুকে হাসিমুখে আলিঙ্গনের স্পর্ধা দেখাতে পেরেছেন। বিদ্রোহী কবিতায় নজরুল বিদ্রোহীর যে চিত্র এঁকেছেন তারই যেন বাস্তব প্রতিফলন দেখলাম আমরা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা! আমি মহামারি, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির-অধীর। (বিদ্রোহী \ অগ্নি-বীণা \ কাজী নজরুল ইসলাম) দ্বিতীয়ত, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের জন্য অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে ‘পয়েট অব পলেটিক্স’ বলে উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিদগ্ধ মানুষের এ উচ্চারণে বিন্দুমাত্র অতিশয়োক্তি নেই, সেটি সামান্য মনোযোগ দিয়ে তাঁর ভাষণটি শুনলেই উপলব্ধি করা যাবে। বঙ্গবন্ধুকে যে ‘পয়েট অব পলেটিক্স’ বলা হয়েছে তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য এবং আমাদের এই অবিসংবাদিত কবি তাঁর ভাষণে যা কিছু উচ্চারণ করেছেন, তা যেন বাঙালির জীবনে অমোঘ হয়ে উঠেছে। আর তাঁর কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তি চিরকালীন ব্যাঞ্জনা নিয়ে বাঙালির জীবনে প্রতিভাত হচ্ছে, প্রতিদিন অনুরণিত হচ্ছে। এমন একজন যোগ্য কবিকে মহাকালের কবি বলে মেনে না নিয়ে উপায় কি?

৭ মার্চের ভাষণ একদিকে যেমন নায়কোচিত উপলব্ধির সাবলীল উচ্চারণ, অন্যদিকে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দলিল। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু নৃশংসভাবে শহীদ হবার পর তাঁর জীবনসংগ্রাম পর্যালোচনা করে বলা যায়, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে যদি কাউকে নায়ক করে মহাকাব্য রচনা করা হয়, তাহলে সে মহাকাব্যের একমাত্র ‘মহানায়ক’ হবেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নায়ক হয়ে ওঠার বৈশিষ্ট্য তাঁর চরিত্রে দেখা দিয়েছিল শৈশবেই; এবং নিজের জীবনটিকে তিনি রচনা করেছেন নায়কোচিত বৈশিষ্ট্যে, আর নিয়তি তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে বীরোচিত মহাপ্রয়াণের দিকে। তারচেয়েও বড় কথা বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক দৃঢ়তা-আত্মবিশ্বাস এবং সৎসাহস তাঁকে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাত্রিতে যেমন সমগ্র জাতিকে অরক্ষিত রেখে পালিয়ে যেতে প্ররোচিত করেনি, একইভাবে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট রাতে দুর্বৃত্তদের বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতেও ভীত করেনি। বাঙালির এই মহানায়ক তাই আজ পূজিত হচ্ছেন বিশ্বে এবং তাঁকে ঘিরে এ বন্দনা চলতেই থাকবে। তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের সেই মহানায়ককে চিনে নিতে সাহায্য করে।

একজন শেখ মুজিব বাঙালি জাতির জন্য যে সম্মান বয়ে আনলেন, তার প্রতিদান কতিপয় অকৃতজ্ঞ বাঙালি তাঁকে ভালোই দিয়েছে। আমরা তাঁর সাথে হওয়া নির্মমতার বিচার সম্পূর্ণ করলেও আজও সে বিচারের রায় সম্পূর্ণ কর্যকর করতে পারিনি। আজও স্বঘোষিত খুনিরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহাল তবিয়তে আছে। যে ৭ মার্চ বাঙালি জাতিকে পথের দিশা দিলো; স্বশাসিত হবার স্বপ্ন দেখালো; বিশ্বে বাঙালিকে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করলো, সেই ৭ মার্চকে আমরা কাঙালি ভোজে খিচুড়িতে ‘সব্জি বা স্বল্প মাংশ’ করে মিশিয়ে উৎসব করে খাচ্ছি, আর তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি। আমরা কি ৭ মার্চের গৌরবকে আগামী প্রজন্মের কাছে সমুন্নত করে রাখতে তেমন কোনো কার্যকর কর্মসূচি আজও নিতে পেরেছি?

২০০৭-এর বইমেলায় প্রকাশিত আমার ‘মুখোমুখি দুঃসময়’ নামের কাব্যে মার্চ উদযাপন শিরোনামে একটি কবিতা সংকলিত হয়েছিল; যার রচনাকাল ৮ জুলাই ২০০৬। প্রসঙ্গক্রমে কবিতাটির কয়েকটি পঙ্ক্তি নিচে উপস্থাপন করছি- মার্চ দিয়েছে নিজস্ব নদীর নাব্যতা কৃষিভূমি পাহাড়ের ঢাল আপন পতাকা ওড়াবার দুরন্ত সাহস দিয়েছে তপ্তদুপুর রৌদ্রোজ্জ্বল অবাক সকাল; জাগে বাঙালির স্মরণ-প্রদেশে ফাল্গুন-উত্তাল। মার্চ আমাদের উৎসবের শুভারম্ভ মার্চে আমাদের পিতা, জাতির পুরুষোত্তম স্থপতির জন্মদিন ঘরে ঘরে জেগে ওঠা, বাঙালির শ্লোগান-মুখর দিন নির্মম রাত্রির গণহত্যা বিষাদ-ঘৃণার স্মৃতি অমলীন; আর মার্চ মানে সাত মার্চ রেসকোর্স উত্তাল সমাবেশ বঙ্গবন্ধুর দরাজ কণ্ঠ-তর্জনীর ইশারায় ফুঁসে ওঠে বাংলাদেশ। পবিত্রতা ছুঁয়ে প্রত্যুষে বিশুদ্ধ জলে স্নান সুবহে সাদিকে জায়নামাযে আত্মসমর্পণ ইচ্ছা স্বাধীন সূর্য-বন্দনা স্তোত্রপাঠ সুদীর্ঘ সময় প্রভাতে গির্জায় ঘণ্টাধ্বনি সুসমাচার আবৃত্তি সাত মার্চে চাই নিকানো উঠোন পরিমিত সাজগোজ ধুপ-দুরস্ত পাজামা-পাঞ্জাবী কুর্তা-কামিজ প্রথম সাক্ষাতে নিঃশর্ত করমর্দন উষ্ণ আলিঙ্গন প্রেমিকের ঠোঁটে প্রেমিকার প্রথম চুম্বন। মহিলাদের লাল পাড় শাদা শাড়ি কপালে চন্দন সাত মার্চ মার্চপাস্ট ব্যান্ড দলের কুচকাওয়াজ সড়ক-বাদন। বিকেলে ঘুড়ি ওড়ানো দাড়িয়াবাঁধা কবাডি গোল্লাছুট প্রতিযোগ বিকেলে ফুটবল-প্রীতিম্যাচ মোরগ লড়াই আনন্দভ্রমণ। বিকেলের শেষে বড় মাঠে আয়োজন হোক আসরের প্রধান জামাত মন্দিরে মন্দিরে কাঁসাঘণ্টা পূজা-আর্চা উলুধ্বনি পূজা ও নামায শেষে জয় বাংলা বলে মিছিলের সাথে ফেরা। সাত মার্চ বাঙালির সব বিপণী বিতানে মূল্যহ্রাস বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা সৌজন্য আইন সহায়তা সন্ধ্যায় মুক্তির গান সন্ধ্যায় পালাকীর্তন রামপ্রসাদীর সুর সন্ধ্যায় মুর্শিদী দেহতত্ত¡ বাউল ভাটিয়ালি বাড়িতে বাড়িতে শোকর গোজার মিলাদ শরিফ; রাতে পরিমিত আহার এবং নৈশ আড্ডা শেষে সুস্বাদু মাশরুম মুক্ত স্বদেশের স্বপ্ন বুকে সাহসী পিতার পারলৌকিক মঙ্গল কামনায় ঘুম। (মার্চ উদযাপন \ মুখোমুখি দুঃসময় \ পৃষ্ঠা-৪১) কবিতার মাধ্যমে ৭ মার্চ উদযাপনের যে প্রস্তাব তখন আমি করেছিলাম, একই প্রস্তাব আজ চৌদ্দবছর পর সেই একই প্রস্তাব জাতির সামনে উপস্থাপন করছি; বিকল্প প্রস্তাব যে কেউ উপস্থাপন করতে পারেন; প্রয়োজনে আমার প্রস্তাবগুলোকে সংশোধন-পরিমার্জন করে নতুন প্রস্তাবও কেউ উপস্থাপন করতে পারেন; কিন্তু আমি চাই বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষে বাঙালির অহংকার-গৌরব আর বেদনার মার্চ মাসে সুদূরপ্রসারী কোনো কর্মপরিকল্পনা করা হোক এবং নিষ্ঠা ও সততার সাথে তা বাস্তবায়ন করা হোক; যে কর্মপরিকল্পনায় সম্পৃক্ত হয়ে নতুন প্রজন্মের বাঙালি বাঙালির শৌর্য-বীর্যকে হৃদয়ে ধারণ করবে; ধারণ করবে বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে; বিশ্বমানব হবার জন্য নতুন প্রজন্ম প্রথমত সম্পন্ন বাঙালি হয়ে উঠবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App