×

সাময়িকী

মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২০, ০৯:১৯ পিএম

মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস

তরুণ প্রজন্মের কাছে অসাধারণ ‘এক রোল মডেল’ বন্ধুবর মুহম্মদ জাফর ইকবাল। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে তরুণদের মনে নতুন করে জাগিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে জাফর ইকবালের অবদান অসামান্য। এই জনপ্রিয় লেখক যথার্থই লিখেছেন যে, ‘এই ভাষণটি সত্যিকারভাবে অনুভব করতে হলে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে শুনতে হবে; তাঁর কথা বলার ভঙ্গিটি নিজের চোখে দেখতে হবে; তাঁর আবেগ, ক্রোধ, ক্ষোভ এবং বেদনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে।

৭ মার্চ থেকেই ‘স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের হলো’ বলে জানিয়েছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। সেদিন বঙ্গবন্ধুও এক অনুপম কবিতা উচ্চারণ করেছিলেন তাঁর হৃদয়ের গহীন তলদেশ থেকে। লক্ষ লক্ষ মানুষ দারুণ উত্তেজনায় শুনেছিলেন তাঁর সেই হৃদয়গ্রাহী অমর কবিতা। রবীন্দ্রনাথের মতোই এসে দাঁড়িয়েছিলেন আমাদের এই নান্দনিক ‘দিঘল পুরুষ’। মাথা উঁচু করে তর্জনী হেলিয়ে এক বিস্ময়কর অমৃতবাণী শুনিয়েছিলেন সেদিন তিনি। কি ভাষা, কি উচ্চারণ, কি ছন্দ, কি আত্মপ্রত্যয়- সব মিলেই তৈরি করেছিলেন এক অসাধারণ দৃশ্যপট। ‘পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চিরজাগরুক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।’ (এডওয়ার্ড হিথ, যুক্তরাজ্যের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী)। এমনটি ভাবতেন বলেই প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়ার আগেই পরিপূর্ণ রাষ্ট্র প্রধানের সম্মান দিয়ে তাঁকে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে স্বাগত জানিয়েছিলেন।

নির্যাতিত, নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের স্বপ্নের সম্রাট বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আজ ইউনেস্কোর কল্যাণে বিশ্বের ঐতিহাসিক এক অমূল্য সাংস্কৃতিক দলিল। এই ভাষণের বৈশিষ্ট্যগুলোর অন্যতম বেশ কিছু দিক নিয়ে বাংলাদেশের কয়েকজন মননশীল মানুষের মূল্যায়ন তুলে ধরতে চাই আজকের এই নিবন্ধে। আইসিটি বিভাগ (২০১৭) থেকে প্রকাশিত অজিত সরকারের সম্পাদনায় ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : রাজনীতির মহাকাব্য’ শিরোনামের বইটি থেকে নেয়া এসব মূল্যায়ন স্থান করে নিয়েছে এই নিবন্ধে।

নিঃসন্দেহে টান টান উত্তেজনা, নাটকীয়তা, ক্ষোভ, শ্লেষ, প্রত্যাখ্যান, নমনীয়তা, ভাষার বৈচিত্র্য, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা, মুক্তির বার্তা, স্বপ্নের বিস্তার, ছোট গল্পের মতো সব বলেও না বলার মতো এক অসাধারণ মহাকাব্য উপস্থাপন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ মার্চে। সংক্ষিপ্ত, প্রাঞ্জল, ছন্দময়, সাসপেন্স, মানবিকতা, গেরিলা রণকৌশলের দিকনির্দেশনাসহ এই ভাষণটি যতই দিন যাচ্ছে ততই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- এই শেষ বাক্যটি কিন্তু আবেগে ভরা কোনো তাৎক্ষণিক উক্তি ছিল না। এই বাক্যটি শোনার জন্য হাজার বছর ধরে এদেশের জনসাধারণ অধীর অপেক্ষায় ছিলেন। এ বাক্যটি বলার জন্য বঙ্গবন্ধুও আজীবন ধরে মনের ভেতরে স্বপ্ন বুনেছেন। পরিকল্পনা করেছেন। তাই ভাষণটি ছিল এতটা ভারসাম্যপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী। তাই এর আবেদন হতে পেরেছে পুরোটাই একটি শ্রেষ্ঠ কবিতার মতোই।

অনেক ইতিহাসবিদ ও গবেষক মার্টিন লুথার কিং, আব্রাহাম লিংকন এবং চার্চিলের কালজয়ী ভাষণের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর এই অসাধারণ ভাষণটিকে যুক্ত করেছেন। কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন, এ এক ‘অমর রাজনৈতিক কবিতা’। ইতিহাসবিদ ও লেখক জ্যাকব এফ ফিল্ডের বিশ^সেরা ভাষণগুলো নিয়ে লেখা ‘ডব ংযধষষ ঋরমযঃ ড়হ ঃযব ইবধপযবং : ঞযব ঝঢ়ববপযবং ঞযধঃ ওহংঢ়রৎবফ ঐরংঃড়ৎু’ গ্রন্থে এই ভাষণটি স্থান করে নিয়েছে। এই ভাষণের প্রতিটি বাক্য বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের গভীর বেদনা ও অভ্যুদয়ের তীব্র আকাক্সক্ষার কথা বলে। তাই যুগে যুগে এই ভাষণটির বিচার-বিশ্লেষণ হতেই থাকবে। তবে আইসিটি বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত (২০১৭) অজিত সরকার সম্পাদিত বইটি (রাজনীতির মহাকাব্য) নানা কারণেই ইতিহাসের এই অনন্য ভাষণটির মর্মকথা জানার এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে থাকবে। বইটির মুখবন্ধ লিখেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিজেই। বঙ্গবন্ধুকন্যা তার সংক্ষিপ্ত মুখবন্ধেই বইটির সারকথা চুম্বকের মতো তুলে এনেছেন। তিনি যথাযথই লিখেছেন, ‘বাঙালির মুক্তির পথ-নকশা নির্মাণে অনন্য-দূরদর্শী ভাষণ এটি। এ ভাষণের ভাব, ভাষা, শব্দচয়ন ও সাহসী উচ্চারণ মানবজাতির সংগ্রাম ও আন্দোলনের ইতিহাসের অবিস্মরণীয় উপদানে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি বাক্যে উঠে এসেছে একটি জাতির ইতিহাস, আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সংগ্রাম ও বাঙালি জাতির প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ের কথা।’ তিনি আরো লিখেছেন যে, এ ভাষণে বাঙালির প্রাণের দাবিটিই প্রতিফলিত হয়েছিল। কি ছিল সেই দাবি? সে কথাও একটি মাত্র বাক্যে খুবই স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি লিখেছেন, ‘একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের আবশ্যকতা ও আকাক্সক্ষা ছিল এই ভাষণের মূল লক্ষ্য।’ একই সঙ্গে তিনি এও লিখেছেন যে এই ভাষণেই বঙ্গবন্ধু আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের জন্য সবাইকে ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত’ থাকতে বলেছিলেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিরা ৭ মার্চের ভাষণের নানা দিক নিয়ে লিখেছেন। ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়’ শিরোনামে প্রথম লেখাটি লিখেছেন প্রয়াত অধ্যাপক মুস্তফা নূরউল ইসলাম। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধুকে চিনতেন এবং জানতেন। তাঁর শাসনামলেই তিনি বাংলা একাডেমির দায়িত্বে ছিলেন। বাঙালির শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিষয়ে তাঁর অগাধ লেখাপড়ার কথা আমাদের সবারই জানা। প্রয়াত এই বুদ্ধিজীবীর মতে, “বাংলাদেশের ইতিহাসের অত্যন্ত উজ্জ¦ল ও দিকনির্দেশক হিসেবে চিহ্নিত ৭ মার্চ এক উল্লেখযোগ্য বাঁক, যে বাঁক আমাদের দিয়েছে স্বাধীন এই দেশ। লক্ষ করার বিষয়, ৭ মার্চকে অবলম্বন করে এসেছে মানুষের অধিকার, মুক্তি, স্বাধীনতা, রাজনৈতিক দাবি ও সাধারণের স্বার্থে তাদের নিজেদের সরকার। আমাদের সবার হয়ে সুস্পষ্ট করে মহান নেতা জানিয়ে দিলেন এই দেশ ‘বাংলাদেশ’।” আরো খোলাসা করে তিনি লিখেছেন, আমাদের মুক্তির সড়ক নির্মাণে তাঁর এই অনন্য-দূরদর্শী ভাষণ কিংবা বক্তৃতাই নয়; এই বাক্যটির মাধ্যমে বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। বিষয়টি এক প্রকারের মোটা দাগে খতিয়ে দেখা যেতে পারে। বুঝতে চাই যে সবটা মিলিয়ে যে প্রত্যয়, এরই নাম ‘৭ মার্চ’ এবং সেই প্রত্যয়ের মহোত্তম বজ্রকণ্ঠ :

“সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না”। তিনি আরো লিখেছেন যে, বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনাসহ নানাবিধ নেতিবাচক বিষয় থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার অভিলাষের কথা উচ্চারিত হয়েছিল ওই ৭ মার্চের ভাষণে। এর পরের লেখাটি আমার। ‘এ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে’ শিরোনামে আমার লেখাটিতে আমি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তির দিশারি একটি দর্শন ও চেতনা হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি। আমি বরাবরই মনে করেছি, ‘তিনিই বাংলাদেশ’। তাই আমার মোটা দাগের কথা হচ্ছে, ‘এই প্রবাদপুরুষের রাজনৈতিক দর্শনের মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি আসে।’ ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরের ইতিহাস যে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করারই ইতিহাস, সে কথাটি খুব স্পষ্ট করে বঙ্গবন্ধুর জবানিতে তুলে ধরেছেন। তিনি আরো লিখেছেন, এই ২৩ বছরের ইতিহাস কথাটি বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে দুবার উল্লেখ করেছেন। বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হওয়ার ইতিহাস বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে নানা উপমায় সেদিনের রেসকোর্স ময়দানে ইতিহাসের পর্বে পর্বে সমবেত বিক্ষুব্ধ জনতার সামনে তুলে ধরেন। বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান তাঁর লেখায় ইতিহাসের নানা বাঁকের কথা কীভাবে বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে এনেছিলেন, সে কথাই তুলে ধরেছেন। ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, একুশ দফার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলার জনগণের সঙ্গে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রতারণার খতিয়ান কীভাবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উঠে এসেছে, সে বিষয়টি তাঁর লেখায় প্রাধান্য পেয়েছে।

তরুণ প্রজন্মের কাছে অসাধারণ ‘এক রোল মডেল’ বন্ধুবর মুহম্মদ জাফর ইকবাল। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে তরুণদের মনে নতুন করে জাগিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে জাফর ইকবালের অবদান অসামান্য। এই জনপ্রিয় লেখক যথার্থই লিখেছেন যে, ‘এই ভাষণটি সত্যিকারভাবে অনুভব করতে হলে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে শুনতে হবে; তাঁর কথা বলার ভঙ্গিটি নিজের চোখে দেখতে হবে; তাঁর আবেগ, ক্রোধ, ক্ষোভ এবং বেদনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, ভাষণের মর্ম উপলব্ধি করতে গেলে ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চ সম্পর্কে জানতে হবে, পাকিস্তানি মিলিটারি-সৃষ্ট ভয়াবহ ও আতঙ্কজনক বিভীষিকার পরিবেশটি বুঝতে হবে। কেউ যদি এই পুরো বিষয়টি অনুভব করতে পারেন, তাহলে ৭ মার্চের ভাষণটি নিশ্চিতভাবে তাঁর ভেতরে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে নতুন এক উপলব্ধির জন্ম দেবে।’ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের গুণ বিষয়ে বলতে গিয়ে জাফর ইকবাল আরো লিখেছেন, “পুরো দেশের সকল মানুষের দায়ভার একা নিজের ওপর নেয়ার এরকম উদাহরণ আমার মনে হয় খুব বেশি নেই। সেটি সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতার পক্ষেই।” কবি নাসির আহমেদ বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিষয়টি তাঁর লেখার শিরোনামেই স্পষ্ট করেছেন। ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজনও যদি হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব’- বঙ্গবন্ধুর এই উক্তিই প্রমাণ করে তিনি কতটা পরমতসহিষ্ণু ও অস্থিমজ্জায় একজন গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ ছিলেন। নাসির আহমেদ ঠিকই বলেছেন যে ‘ন্যায়ের প্রতি অবিচল ছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু এত সাহসী হতে পেরেছিলেন।’ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম তাঁর লেখায় বঙ্গবন্ধুকে একজন উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মহানুভব নেতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শাসনতন্ত্র তৈরির সময় সকল পক্ষের সাথে তিনি আলাপের তাগিদ দিয়েছেন। আর তাই তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে ‘আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি’ বাক্যটি স্থান করে নিয়েছে। সাংবাদিক সৈয়দ বদরুল আহসান তাঁর লেখায় দেখিয়েছেন যে জুলফিকার আলী ভুট্টোই মূল ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন। এ কথাটি বঙ্গবন্ধু আগেভাগেই ধরে ফেলেছিলেন। তাই তাঁর ভাষণে একাধিকবার ভুট্টোর প্রতি ক্ষোভ ফুটে উঠেছে। আর সে কারণেই বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে ভিন্ন এক পথের দিশা দিয়েছিলেন বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। আর সে পথ ছিল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নের পথ। সাংবাদিক আবু সাঈদ খান তাঁর লেখায় বঙ্গবন্ধু অবহেলিত বাংলার মানুষের মর্মবেদনা কতটা গভীরভাবে অনুভব করতেন তাই তুলে এনেছেন। তাঁর লেখার শিরোনাম ‘দোষ দেওয়া হলো বাঙলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে’ বলে দেয় বঙ্গবন্ধুর অন্তজ্বালার কথা। কথা সাহিত্যিক আনিসুল হকের লেখার শিরোনাম ‘আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে’। এই শিরোনামই বলে দেয় বাঙালির ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস একটি মাত্র বাক্যেই কি চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। আনিসুল হক যথার্থই লিখেছেন, ‘তিনি ছিলেন অসাধারণ কথাকারও; অপরূপ বাগ্মী; তুলনারহিত দেশপ্রেমিক; যিনি দেশের মুক্তির জন্য আত্মত্যাগে ও আত্মদানে সদা প্রস্তুত। যাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বাংলার মানুষের মুক্তি।’ বর্তমান সময়ের শ্রেষ্ঠ বাঙালি কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ‘রক্তের দাগ শুকায় নাই’ শিরোনামের লেখায়, যেমনটি আমরা আশা করি, তেমনটিই উচ্চারণ করেছেন। তিনি লিখেছেন ‘কোনো দিন শুকোবে না। বাইরের দাগ যদি কখনো মুছেও যায়, বাঙালির হৃদয় থেকে যে রক্তক্ষরণ হয়েছে, তা শুকোনোর তো প্রশ্নই ওঠে না, বরং আজো ক্ষরণ চলছে। গোটা জাতির অবিরত এই রক্তক্ষরণের একমাত্র ন্যায্য প্রতিশোধ হচ্ছে অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামে বাঙালির উজ্জীবিত হওয়া’। শহীদের রক্ত মাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু যে কোনো আপস আলোচনায় যোগ দেবেন না, সে কথাটিই সুস্পষ্ট করেছেন ইতিহাসবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন তাঁর লেখায়। রাজনীতিবিদ এবং উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদের লেখায় শিরোনাম ‘জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে’। প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী নেতা বঙ্গবন্ধু বরাবরই রাজনৈতিক বৈধতার শক্তির জোর বিষয়ে আস্থাবান ছিলেন। তাই জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধের বৈধতা অর্জন করেছিলেন। ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই’- এ কথা ক’টির মাধ্যমে প্রবীণ সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী সঠিকভাবেই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে বাংলার নিপীড়িত মানুষের অধিকারের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু কতটা আপসহীন ছিলেন। প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু গোড়া থেকেই জনগণের সঙ্গে থেকে রাজনীতি করেছেন।... নিজের ওপর নিজের চাপানো দায় সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বরাবরই সচেতন ছিলেন। তাই এ পথে কোনো বাধা এলে তিনি তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন।’ জনসংলগ্ন এই মহান নেতার উক্তি ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়’ তাই সহজেই আবুল মোমেনের লেখার শিরোনাম হয়ে যায়। শিল্পী হাশেম খান এই বইয়ের শুধু প্রচ্ছদই আঁকেননি, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো’ শিরোনামে একটি লেখাও লিখেছেন। এই একটি বাক্যে যে আসন্ন গেরিলা যুদ্ধের স্পষ্ট নির্দেশনা ছিল, গণমানুষের মুক্তির বার্তা প্রতিধ্বনিত হয়েছিল সে কথাটিই হাশেম খানের লেখায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের লেখায়ও এই জনমানুষের মুক্তিযুদ্ধের কথাই ফুটে উঠেছে। ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে’। বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানকেই শিরোনাম করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। যেকোনো মূল্যে ‘চাই স্বাধীনতা, চাই মুক্তি’- সে কথাটিই পরিষ্কার করে তুলে ধরেছেন লেখক তাঁর গোছানো লেখায়। প্রায় একই সুর বাজে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের লেখায়। ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায় রাখতে পারবা না’ শিরোনামের লেখায় সেলিনা হোসেন আমাদের জানিয়েছেন যে ‘সময় বঙ্গবন্ধুকে সৃষ্টি করেনি, বরং তিনিই সময়কে নিজের করতলে নিয়ে এসেছেন।’ প্রয়াত অধ্যাপক অজয় রায় আপাদমস্তক এক অসাম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি তুলে ধরেছেন তাঁর লেখায়। জাতি গঠনে গণমাধ্যমের ভ‚মিকা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু অবহিত ছিলেন। সে কারণেই অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক তাঁর লেখায় ৭ মার্চের ভাষণে বৈরী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে বঙ্গবন্ধু কেন হুমকি দিয়েছিলেন, তার ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন। যদি তাঁর ভাষণ প্রচারে বাধা দেওয়া হয়, তাহলে যেন রেডিও-টেলিভিশনের বাঙালি কর্মীরা প্রতিবাদ করে কর্মক্ষেত্র থেকে বের হয়ে আসেন, সেই আহ্বান জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে। এই হুমকি কাজে লেগেছিল। অনেক টালবাহানার পর পরের দিন গণমাধ্যমে তাঁর ভাষণ প্রচার করতে বাধ্য হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। আর সেই ভাষণ শুনে বাঙালির রক্ত টগবগ করে জ¦লে উঠেছিল। তারা আসন্ন জনযুদ্ধের জন্য যার যার মতো প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করেন। ‘জয় বাংলা’ শিরোনামে লিখেছেন প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। কী করে এই স্লোগান ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নির্বিশেষে সব বাঙালিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিল, সেই প্রসঙ্গেরই অবতারণা করেছেন লেখক তাঁর নিবন্ধে। বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি এবং রাজনীতিবিদ এস এ মালেক মুক্তি ও স্বাধীনতার অন্তর্নিহিত সংযোগের কথা লিখেছেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ শিরোনামে। এ ছাড়া শিক্ষাবিদ আব্দুল খালেক, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন, কবি কামাল চৌধুরী ও সাংবাদিক আবেদ খান বর্ণনা করেছেন, কেমন করে ৭ মার্চের ভাষণটি আমাদের জনযুদ্ধের অনুপ্রেরণার অংশ হয়ে গিয়েছিল। এই বইটির গুরুত্ব বেড়ে গেছে এতো জন চিন্তকের ভাবনাকে এক মলাটের ভেতর আবদ্ধ করার কারণে। তরুণ প্রজন্মের কাছে ৭ মার্চের ভাষণ এক অসাধারণ মূল্যমানের। আমরা সম্প্রতি ১,৫২৩ জন তরুণের (যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছর) ওপর একটি অনলাইন জরিপ পরিচালনা করেছি। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৭৬ শতাংশ তরুণই জানিয়েছেন যে বঙ্গবন্ধুর নামটি উচ্চারিত হবার সাথে সাথেই তাদের মনে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের দৃশ্যপট ভেসে ওঠে। এদের ৭৯ শতাংশ মনে করেন ঐ ভাষণে বঙ্গবন্ধুর বালিষ্ঠ ও দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণ পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল। এই ভাষণটিই তরুণদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চরম ত্যাগ স্বীকারে অনুপ্রাণিত করেছিল। চলমান মুজিব বর্ষে তরুণ প্রজন্মের মনে বঙ্গবন্ধুকে গেঁথে দেবার সবচেয়ে ধারালো অস্ত্রটি হতে পারে ৭ মার্চের এই অসাধারণ ভাষণটি। এই ভাষণই তরুণদের মনে নান্দনিক সেই ‘দিঘল পুরুষে’র সন্ধান দিতে পারে- “আমি এক দিঘল পুরুষের কথা বলছি যার বজ্র নির্ঘোষ কণ্ঠ বেজে উঠলে ভূত-পেত্নীরা মুখ লুকাতো পালিয়ে যেতো দিগন্তের ওপাড়ে মানুষেরা তখন মাটির শানকির মতো লাল সূর্য স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনে দিঘল পুরুষের পায়ের কাছে রেখে দিত অনায়াসে” [‘দিঘল পুরুষ’, বাবলু জোয়ারদার]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App