×

সাময়িকী

মহাদেশের মতো এক দেশে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২০, ০৮:১৩ পিএম

মহাদেশের মতো এক দেশে
(গত সংখ্যার পর) সকলের পাঠানো বিবিধ কাগজপত্র পারভেজের মেইলে স্ত‚পিকৃত হচ্ছিল। পারভেজের দুই সন্তান সেসব সাজিয়ে ভিসা এজেন্টকে পাঠাচ্ছিল। কেননা এসব পেপারওয়ার্ক সময়সাপেক্ষ এবং ভিসা এজেন্টকে দিয়ে করালে ব্যয়বহুল। ভিসা আসছিল স্বর্গনদী পারাপারের টিকেটের মতো- একটি-দুটি করে, বহু হাস্যরস ও কৌতুকের জন্ম দিয়ে। যেমন ডা. অলোক ভিসা পেল, কিন্তু অলোক গিন্নী অঞ্জলি ভিসা পেল না, ডা. মুজতবা পেল, মুজতবার পরিবারের অন্য কেউ পেল না। ডা. ঝোরা জানাল, ছেলের ভিসা না হলে সে যাবে না। একটি একটি করে ভিসা আসছে, পারভেজ আনন্দের সঙ্গে তা সবাইকে জানাচ্ছে। তখন ক্যালেন্ডারে ভ্রমণমাস ডিসেম্বরও উঁকি মারছে। আমার ফ্লাইট ১৪ তারিখে, আমি টেনশন অনুভব করি। টেনশন অনুভব করে অনেকেই। কেননা ভিসা প্রাপ্তির পর ভ্রমণপ্রস্তুতি আছে, আছে কর্মব্যস্ত জীবনে সাময়িক বিরতির গোছানো। এমনি টেনশনের ভেতর গেছি ভাঙা উপজেলায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের গ্রামে তাঁর স্মরণে আয়োজিত স্মরণসভায় যোগ দিতে। শেষ বিকেলে দিল্লিস্থ অস্ট্রেলীয় দূতাবাস থেকে এক ভারতীয় নারীর ফোন আসে। তিনি আমার একটি টেলিফোন ইন্টারভ্যুও নেন। আমি ডাক্তার না হয়েও কে-৩৭ ব্যাচের সদস্য কী করে হলাম, সংক্রামক ব্যাধি সংক্রান্ত চিকিৎসাশাস্ত্রের একটি বিষয় সম্পর্কে আমি কী জানি, কনফারেন্সে আমার ভ‚মিকা কী হবে, গত পাঁচ বছরে আমি কোনো কোনো দেশ ভ্রমণ করেছি- ইত্যাদি জানতে চাইল। আমি সবগুলো প্রশ্নেরই পড়হারহপরহম উত্তর দিলাম। জানালাম কে-৩৭ ব্যাচে আমার মেডিকেল কলেজে ভর্তি, দেড় বছর পড়াশোনা, ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে আইআইটি খড়গপুরে প্রকৌশলশাস্ত্র অধ্যয়ন (এটা ইচ্ছা করেই বললাম, কেননা প্রত্যেক শিক্ষিত ভারতীয় জানে আইআইটি কী প্রতিষ্ঠান), ২০১৫ সালে যুক্তরাজ্য ভ্রমণ ইত্যাদি জানালাম। এর একটু পরেই ব্রিসবেন থেকে পারভেজের ফোন এল ‘কধসৎঁষ, মঁবংং যিধঃ?’ বুঝলাম শিকে ছিঁড়েছে, ভাগ্যদেবী মুখ তুলে তাকিয়েছেন। বুঝলাম, ভিসা দিবে কি দিবে না তার চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার জন্যই ওই শেষ মুহূর্তের টেলিফোন আলাপ। অস্ট্রেলিয়ায় কে-৩৭ ব্যাচের ট্যুরটি শুরু হওয়ার কথা ১৮ ডিসেম্বর থেকে। সকলের জড়ো হওয়ার কথা একদিন আগে ব্রিসবেনের হিলটন হোটেলে। বাংলাদেশ থেকে মূল দলটি ঢাকা থেকে উড়বে ১৬ তারিখে, হংকং হয়ে ব্রিসবেন পৌঁছাবে ১৭ তারিখে। তারা বাংলাদেশি এক ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমে গ্রæপ টিকেট বুক করেছিল। ফিরতি যাত্রার তারিখ ও পোর্ট অব এক্সিট না মেলায় আমাকে আলাদাভাবে টিকেট কিনতে হয়েছিল। ঢাকা ফিরে আমি বাকি ৫১ হাজার টাকা নিজের পকেট থেকে দিয়ে বিমানের টিকেট কেটে নেই। বুঝলাম মহাদেশীয় যাত্রায় পারভেজই আমার প্রধান ভরসা, বাকিটা নিজেকেই জোগাড় করতে হবে। কেননা ফিরে যাবার উপায় নেই, অস্ট্রেলিয়া আমায় চুম্বকের মতো টানছে। ১. আগেভাগেই ঠিক করে রেখেছিলাম মূল ভ্রমণসূচির ক’দিন আগেই ব্রিসবেন গিয়ে পৌঁছাব। এত দূরদেশ থেকে মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে অত স্বল্পদিন থাকলে বিমানভাড়াই তো উশুল হবে না, উপরন্তু আমার লক্ষ্য অস্ট্রেলিয়া নিয়ে একটি নতুন ভ্রমণকাহিনী লেখা। বেশিরভাগ নামি এয়ারলাইন্সই ব্রিসবেন যায় না, যে এয়ারলাইন্সটি যায়, তার নাম ক্যাথে প্যাসিফিক। বাংলাদেশ থেকে যে বড়ো দলটি যাবে তারাও যাবে ক্যাথে প্যাসিফিকে। দলছুট আমরা কজন- আমি, ডা. রৌশনি, ডা. মুজতবা, ডা. অলোক- আমরা যে যার মতো টিকেট কেটে ফেলি। এর মাঝে রৌশনিও ঠিক করে রেখেছে, সেও আগেভাগে ব্রিসবেন যাবে। আমি যে এজেন্ট থেকে টিকেট কিনেছি, রৌশনিও সে এয়ারলাইন্স থেকেই টিকেট কিনল, আমার ভ‚মিকা ছিল অনুঘটকের। সাত তারিখ পর্যন্ত রেগুলার ক্লাস, ফাইনাল পরীক্ষা আগেভাগে নিয়ে খাতা দেখে গ্রেড জমা দিয়ে তবে আমি যেতে পারব, নইলে নয়। পরীক্ষার খাতা দেখা হলো শিক্ষকতার সবচেয়ে বিরক্তিকর কাজ। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো হাজির হলো আরেকটি কাজ। যে কাজ আমি ফেলে রেখেছিলাম, তাই আমার মাথায় বিরাট বোঝা হয়ে দেখা দিল। আমি ব্যাগ গোছাব কী, খাতা দেখতে দেখতেই আমার দিনরাত পার হতে লাগল। এমনি করতে করতে দ্রুতই ক্যালেন্ডারে উঁকি দিল ১৪ ডিসেম্বর, আমার উড্ডয়নের তারিখ। ১২ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রেড জমা দিয়ে নির্ভার হলাম। কেবল একটি দিন পেলাম ক্রেডিট কার্ড অথরাইজেশন ও ডলার কেনার জন্য। লুবনা ও সন্তানরা আমার হরহামেশা ব্যাগ গুছিয়ে বিদেশযাত্রার সঙ্গে এতটা অভ্যস্ত যে ওই যে অতবড়ো মহাদেশে যাচ্ছি- তাদের তেমন ভাবাবেগ নেই। না, থাকারই কথা, কেননা লোকান্তরে তারা জানতে পেরেছে অন্যান্য ডাক্তার বন্ধুরা অনেকেই পরিবার নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে। আমার ব্যর্থতা তাদের চোখে করুণা আনে কেবল, তাদের ব্রিলিয়ান্ট বাবা তেমন ক্যারিয়ার গড়তে পারেনি ভেবে তারা বিমর্ষ। সহপাঠীরা পারে, সে কেন পারে না, এমনি প্রশ্ন তাদের ঠোঁটে ভিড় করে। আমিও অধোবদন থাকি, কেননা স্বর্গের সিঁড়ি থেকে স্বেচ্ছায় আমি নিজেই নেমে গেছি। নরকে যাইনি সত্যি, নিজের মতো স্বর্গ বানিয়ে নিয়েছি। চিত্রকল্প, প্রতীক, রূপক আর উপমার সে জগতে আমি নিঃসঙ্গ। এ ব্যাপারে লুবনা নিঃসংশয় যে কবিতাই আমাকে ডুবিয়েছে। কবিতা অলক্ষীর সঙ্গে এখন জুটেছে গদ্যের অসুর। আমার ভেতরে যতই নাচুক ভ্রমণময়ূর, তাদের চোখে তা মোহনীয় নয় মোটেই। সুতরাং ঢাকঢোল না পিটিয়ে নীরবে বিমানবন্দরের দিকে রওনা হই। সেদিনটি অবশেষে এসে গেল যেদিনটিকে এক সময় দূরবর্তী মনে হচ্ছিল। পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ, সবচেয়ে একাকী মহাদেশটিতে উড়ে যাবার দিন। অমন এক মহাযাত্রার জন্য যে আড়ম্বরপূর্ণ প্রস্তুতির প্রয়োজন তার কিছুই নিতে পারিনি, শেষদিনটি পর্যন্ত আমাকে দৌড়াতে হলো পেশার দায়িত্ব পেশি থেকে নামাতে। অবশেষে ছুটলাম বিমানবন্দরের দিকে। ক্যাথে প্যাসিফিকের কাউন্টার থেকে বোর্ডিং পাস নিয়ে ভারি লাগেজটিকে বিমানের পেটের উদ্দেশে চলন্ত বেল্টে চড়িয়ে ইমিগ্রেশন লাইনে এসে দাঁড়াই। আমার পাসপোর্টে অস্ট্রেলিয়ার ভিসার কোনো সিল নেই, হাতে রয়েছে অভিবাসন দপ্তরের ভিসাপ্রদানের ই-টিকেট জাতীয় কাগজ। তবে সেসবের প্রয়োজন নেই, কেননা ভিসা ঢুকে আছে অনলাইনে, পাসপোর্ট স্ক্যান করলেই ভিসা পাখি গান গেয়ে ওঠে। অস্ট্রেলিয়ার ভিসা যেহেতু, সেহেতু উটপাখিও হতে পারে, তবে উটপাখি আদৌ গান গায় কিনা জানা না থাকায় অন্য পাখি খুঁজতে থাকি। এরপরে আমি মুক্তবিহঙ্গ, উড়ে যাবার অনুমতিপ্রাপ্ত। আজ আমরা তিনজন সহপাঠী বিমানে চড়ব, রৌশনি ও আমি একই বিমানে, মুজতবা অন্য বিমানে। শুনে মনে হতে পারে রৌশনি বোধহয় আমার সঙ্গে ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে, সত্য হচ্ছে তার প্রহরায় রয়েছে স্বামী, সঙ্গে বড়ো মেয়ে, অর্থাৎ ওরা তিনজন। আমি পৌঁছার আগেই পৌঁছে গেছে। মুজতবারাও তিনজন- মুজতবা, হেনা ও ওদের ছোট মেয়ে। ওদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল সে স্থানেই যেখানে ভিসা বা মাস্টার কার্ড হোল্ডাররা বিমানে চড়ার আগে জিরোয়, পানীয়ের পাত্রে ঠোঁট রাখে। একই ব্যাচের হলে হবে কী আমাদের প্রত্যেকের ক্রেডিট কার্ড ভিন্ন, আমাদের বিশ্রামের লাউঞ্জগুলোও ভিন্ন। আমার যেমন ইস্টার্ন ব্যাংকের সুবাদে স্কাইলাউঞ্জে আতিথ্যগ্রহণ, রোশনি সিটি ব্যাংকের সুবাদে বলাকা লাউঞ্জে আতিথ্যগ্রহণ করল। আয়েস করে বসেছি কমলার রস ও হালকা পানীয় নিয়ে, রৌশনির ডাক এল বলাকা থেকে। তার আবার দুটো কার্ড, চারজন আতিথ্য নিতে পারে, আমিসহ চারজনই হই, কিন্তু যখন নিজেরই ঘর আছে, কে আর পরঘরমুখী হয়? কিছুক্ষণ ওদের সঙ্গে কাটিয়ে স্কাইলাউঞ্জে ফিরে আসি আরাম করে ডিনার খাবার জন্য। আসার আগে রোশনির পরিবারের ছবি তুলে দেই। রোশনি নিজের ছবি তুলতে পছন্দ করে, আমি অন্যের, দুয়ের যোগফল হলো ছবি আর ছবি। পুরনো দিনের নায়কের মতো দেখতে সুপুরুষ বাবুল ভাই বেশ শান্ত স্বভাবের, খুব কম কথা বলেন। তুলনায় রোশনি বেশ চঞ্চল ও কথাপ্রিয়। ওদের মেয়ে আনিকা ভীষণ মায়াময় সুন্দর- দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। স্কাইলাউঞ্জে পরিতৃপ্তির সঙ্গে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করে পুনর্বার বলাকা লাউঞ্জে যাই। রোশনি আমায় জানায় হংকংয়ে আমাদের ১০ ঘণ্টার বেশি যাত্রাবিরতি, নিয়মমাফিক আমাদের হংকংয়ে লাউঞ্জ সুবিধা পাবার কথা। (চলবে)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App